শমী কায়সার একজন বাংলাদেশী মডেল, অভিনেত্রী তথা প্রযোজক। নব্বই এর দশকের একজন নামকরা অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। একান্নবর্তী পরিবার আর সেই পরিবারের প্রথম সন্তান হওয়ায় শমীর বেড়ে ওঠাটা হয়েছে অনেক আদরেই। পরবর্তীতে পুরো দেশের মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন তিনি।
অভিনেত্রী শমী’ র শৈশব এবং পরিবার পরিচয়, Childhood and Family Background of Shomi :
শমী ১৯৭০ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। অভিনেত্রীর পিতার নাম শহীদুল্লাহ কায়সার ও মাতার নাম পান্না কায়সার। অভিনেত্রীর মা পান্না একজন লেখিকা এবং সাবেক সংসদ সদস্য।
ছোটবেলায় বাবার কোলেই ঘুমনোর অভ্যাস ছিল অভিনেত্রীর, তবে শমী এই আনন্দ বেশি দিন উপভোগ করতে পারেননি। উপভোগের সেই সময়ের ছোটবেলায় মাত্র দুই বছর বয়সে তাঁর বাবা জীবন দিয়েছিলেন দেশের তরে।
বাংলার এক সূর্য সন্তান ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসর আল বদর-রাজাকারেরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে, এই তালিকায় শমীর বাবাও ছিলেন।
যে তারিখে তাঁর পৃথিবীতে আসার কথা, এর দেড় মাস আগেই জন্ম হয় শমী’ র। তবে তাকে লড়াই করতে হয়েছিল টিকে থাকর জন্য। ইনকিউবেটরে কাটিয়েছেন দুই সপ্তাহ। শমী’ র মায়ের কথা থেকে জানা যায়, মাত্র নয় মাস বয়সেই শমী হাঁটা শুরু করেছিলেন।
শমীর পরিবারে তাঁর এক ছোট ভাইও আছে, যার নাম অমিতাভ কায়সার। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দুজা চৌধুরীর স্ত্রী পান্নার বোন, যার নাম মায়া।
শমী ও রাজনীতিবিদ মাহি বি চৌধুরী খালাতো ভাই-বোন। পরিবারের সদস্যদের পরিচয় থেকে বুঝতেই পারছেন যে শমী’ র আত্মীয়দের অনেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত।
শমী কায়সারের শিক্ষাগত যোগ্যতা, Educational Qualification of Shomi Kaiser :
শমী কায়সার তিন বছর বয়সে গ্রিন হ্যারল্ড স্কুলে ভর্তি হন, সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে উদয়ন স্কুলে চলে যান। সেখানেও বেশি দিন ছিলেন না। ক্রমে ১৯৭৭ সালে হলিক্রস স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেন।
এরপর লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ভর্তি হন, সেখান থেকে বি.কম বিষয়ে পড়াশুনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কোর্স করেন অভিনেত্রী শমী।
শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ, Interest in art and literature :
শিল্প-সাহিত্যের প্রতি শমী’ র ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। পত্রিকার পাতায় মাত্র ৭ বছর বয়স থেকেই তার হাতে আঁকা ছবি ছাপা শুরু হয়, এছাড়াও ডায়েরিতে গল্প লিখতেন ছোটবেলাতেই।
বাবাকে নিয়ে লিখেছিলেন মাত্র আট বছর বয়সেই। মাত্র ১১ বছর বয়সেই পটুয়া কামরুল হাসানের সাক্ষাৎকার নেন তিনি। কৈশোর বয়সে পত্রিকার পাতায় তাঁর লেখা ছোট গল্প ছাপা হয়।
শমী কায়সারের কর্মজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, Career experiences of Shomi Kaiser :
পরিবার থেকে সকলের ইচ্ছে ছিল যে শমী একজন গায়িকা হবেন। খুব ছোটবেলাতেই তাঁকে তানপুরা কিনে দিয়েছিলেন তাঁর মা। শিক্ষক হিসেবে গানের ওস্তাদ ছিলেন গোপাল চন্দ্র দে আর ভারতী মাসী। গানেরই এক অনুষ্ঠানে গিয়ে শমী’ র সাক্ষাৎ হয় বিটিভির প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরীর সাথে।
প্রথম দেখাতেই তিনি শমীকে তাঁর নাটকে কাজ করার প্রস্তাব দেন। তবে লেখাপড়ার ক্ষতির কথা ভেবে শমী’ র মা এক্ষেত্রে বারণ করে দিলেন।
কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার আগে আতিকুল হকের কাছ থেকেই আবারও নাটক করার প্রস্তাব পান তিনি।
টিভি- তে অভিনয়
পরিচালক আতিকুল হক চৌধুরী ১৯৮৯ সালের দিকে তার নাটকে অভিনয় করার জন্য এমন একজন মেয়ে খুঁজছিলেন, যে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারে। নাটকটির নাম ছিল ‘কেবা আপন কেবা পর’। এখানেই শমী প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান।
এরপর তিনি আব্দুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় তিন পর্বের ধারাবাহিক নাটক ‘ যত দূরে যাই ‘ তে অভিনয় করে পরিচিত লাভ করেন। ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস অবলম্বনে এই নাটক তৈরি হয়।
১৯৮৯ সালের দিকে তিন পর্বের একটি খণ্ড নাটক ‘যত দূরে যাই’ দর্শক মহলে বেশ আলোড়ন জাগিয়েছিল। নাটকের কলাকুশলীরা অবশ্যই আলোড়ন তোলার মতোই ছিলেন। রামেন্দু মজুমদার, আসাদুজ্জামান নূর, ফেরদৌসী মজুমদার, তারানা হালিম এই নাটকের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন; কিন্তু উক্ত কলাকুশলীর মাঝে নতুন একটি মেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
উক্ত নাটকে ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সেই সময়ে সাধারণ দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন শমী কায়সার। নব্বইয়ের দশক জুড়ে যে ক’জন অভিনেত্রী বাংলাদেশের দর্শকদের মুগ্ধ করে রেখেছিলেন, তাদের মাঝে শমী কায়সার অন্যতম নাম।
তারপর তিনি একের পর এক করে বহু নাটকে অভিনয় করেন; যেমন, নক্ষত্রের রাত, ছোট ছোট ঢেউ, স্পর্শ, একজন, অরণ্য, আকাশে অনেক রাত, মুক্তি, অন্তরে নিরন্তরে, স্বপ্ন, ঠিকানা ইত্যাদি।
শমী ১২ বছর ধরে ঢাকা থিয়েটারে কাজ করেছিলেন। তিনি ‘হাত হোদাই’ শহীদুজ্জামান সেলিমের সাথে নাটকে অভিনয় করেন।
চলচ্চিত্রে অভিনয়
২০০৪ সালে লালন, হাছন রাজা প্রমুখ সিনেমায় শমীকে অভিনয় করতে দেখা যায়।
২০০২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের জীবনী নিয়ে নির্মিত ‘ দ্য নেম অব এ রিভার ’ সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। এটাই ছিল তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র। কিন্তু সিনেমাটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখানো হলেও বাংলাদেশে মুক্তি পায়নি।
প্রযোজনার কাজ
শমী অভিনয় ছাড়াও একজন প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। পরিচালনা জীবনের শুরুটা করেন বিজ্ঞাপনচিত্র দিয়ে। তবে পরিচালনার চেয়ে প্রযোজনাতেই তার আগ্রহ বেশি ছিল।
তিনি ১৯৯৭ সালে নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ধানসিড়ি প্রোডাকশন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রযোজনায় নির্মিত হয় ‘মুক্তি’ এবং ‘অন্তরে নিরন্তরে’ নাটক। এরপর একে একে তৈরি করেন ‘দূরে কোথাও’, ‘স্বপ্ন’, ‘আরিয়ানা’ এবং আরো কয়েকটি নাটক।
পরবর্তীতে এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে অসংখ্য বিজ্ঞাপনচিত্রও নির্মিত হয়েছে।
২০১৩ সালে নভেম্বর মাসে তাঁর এই প্রতিষ্ঠান, ধানসিড়ি কমিউনিকেশন লিমিটেড, রেডিও অ্যাক্টিভ নামে একটি বেতার কেন্দ্রের জন্য লাইসেন্স পায়।
জীবনের অর্জন, Achievements in Life :
২০০১ সালের দিকে দিল্লীতে ‘হিউম্যান রাইটস ইন সাউথ এশিয়া’ সংগঠনের সাধারণ সদস্যদের নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন, পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান; নোবেল বিজয়ী আসমা জাহাঙ্গীরের মতো বিশিষ্ঠ মানুষের পাশাপাশি শমী কায়সারও আমন্ত্রিত ছিলেন।
সেই সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। এই ঘটনাটিকে শমী নিজের জীবনের একটি অর্জন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে জার্মানিতে ২০০২ সালে, ‘ফ্রিডম অব স্পিচ ইন মিডিয়া’ শিরোনামে এক সম্মেলন আয়োজিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন ড. আনিসুজ্জামান এবং শমী কায়সার। একেও নিজের ক্যারিয়ারের একটি বড় অর্জন বলে মনে করেন অভিনেত্রী।
অভিনেত্রী শমী’ র ব্যক্তিগত জীবন, Personal Life of Actress Shomi :
শমী ভারতীয় নাগরিক ব্যবসায়ী অর্নব ব্যানার্জী রিঙ্গোকে বিয়ে করেন। তাদের বিয়ে হয় ১৯৯৯ সালে। বিয়ের জন্য তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তবে বিয়ের দুই বছর পর অর্থাৎ ২০০১ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।
পরবর্তী সময়ে শমী ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মোহাম্মদ আরাফাতকে, ২০০৮ সালের ২৪ জুলাই বিয়ে করেন। নানা কারণে সেই সংসারও টেকেনি বেশিদিন। ২০১৫ সালে বিচ্ছেদের পথে হাঁটেন দুজনে।
২০২০ সালের ৯ অক্টোবর তিনি তৃতীয় বিয়ে করেন। তাঁর তৃতীয় স্বামী ব্যবসায়ী রেজা আমিন সুমন। র্যাংগস গ্রুপের প্রাক্তন কর্মকর্তা ছিলেন সুমন। বর্তমানে তিনি গ্রুপ ফোর দুবাই এর দায়িত্বে রয়েছেন।
শমী কায়সারের পুরস্কার প্রাপ্তি, Awards received by Shomi Kaiser :
১৯৭৭ সালে, খুব ছোটবেলাতেই ছবি আঁকার জন্য ভারত থেকে শঙ্কর পুরষ্কার পান শমী। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে পান শিশু একাডেমী পুরষ্কার।
অভিনয়ের জন্য প্রথম পুরস্কার পান ১৯৯৪ সালে, মেরিল-যায়-দিন এর পক্ষ থেকে।
পাশাপাশি ভোরের কাগজ, বাচসাস, মেরিল-প্রথম আলো, ইমপ্রেস-অন্যদিন ইত্যাদি সংস্থা থেকেও পুরস্কৃত হয়েছিন তিনি। এছাড়াও জার্নালিস্ট রিপোর্টস অ্যাওয়ার্ড ও সিজেএফবি সহ আরো কিছু পুরস্কার তার ঘরে গিয়েছে।
শেষ কথা, Conclusion :
শমীর ক্যারিয়ারের সিনেমার সংখ্যা অল্প। তবুও বাংলাদেশ টিভিতে তাঁর ছাপ থেকে গেছে বহুকাল ধরেই। শমীর জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হচ্ছেন তার মা।
এছাড়া একমাত্র ভাই অমিতাভ কায়সারের সাথেও সম্পর্ক বন্ধুর মতো। বর্তমানে শমী কায়সার যুক্ত আছেন দেশীয় উদ্যোক্তাদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েসন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর সাথে। আশা করা যায়, চলচ্চিত্র পরিচালনায় এলে সেখানেও তিনি দর্শকপ্রিয়তা পাবেন।
Frequently Asked Questions :
একজন বাংলাদেশী মডেল, অভিনেত্রী তথা প্রযোজক।
শহীদুল্লাহ কায়সার।
দ্য নেম অব এ রিভার।