বৃষ্টি ভালবাসেনা এমন মানুষ হয়তো কমই আছেন। সামাজিক মাধ্যমে মনসুনের সময়ে বহু ছবি ও ভিডিও দেখা যায়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম খুললেই দেখা যায় বৃষ্টির দিনের কোনো ছবি পোস্ট করে তাতে #Rainlover লিখে নিজেকে বৃষ্টি প্রেমী হিসেবে অভিহিত করেন অনেকে।
তবে এটাও ঠিক যে বৃষ্টির অনুভূতি খুব প্রশান্তি দায়ক। কারও কাছে গরমের দিনে স্বস্তিদায়ক বিষয় হল বৃষ্টি। অন্যদিকে কেউ কেউ সময়ে অসময়ে বৃষ্টি হলেই মনে অনেক আনন্দ পান।
এর নেপথ্যে হয়তো বিশেষ কোনো কার নেই। এটি শুধুমাত্র একটি মধুর অনুভূতি। আজকের এই প্রতিবেদনে বৃষ্টির দিনের অনুভূতি নিজে আমার এক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তুলে ধরবো।
বৃষ্টির অনুভূতি, The feeling of rain:
কয়েক বছর আগের কথা। তখন শ্রাবণ মাস চলছে। বেশ কিছুদিন ধরে খুব গরম পড়েছে। রোদের প্রতাপে যেন গাছ পালা শুকিয়ে কাঠ হবার মত অবস্থা। শুধু তাই নয়, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু করে দিন ধরে প্রচন্ড গরমের প্রকোপ।
বলতে গেলে গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। কোথাও গিয়ে শান্তি নেই, কিছু করে শান্তি নেই। ঘরে কোনো কাজ করতে গিয়ে গরমে ঘেমে অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছে। এদিকে রোদের তাপে বাইরে কোথাও গিয়েও শান্তি নেই।
এমনই শ্রাবণের এক সোমবারে আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি গরম যেন আজ অন্য দিনের চেয়ে আরেকটু বেশি। শিবের উপোস করবো সেদিন। আমাদের বাড়ির উঠোন অনেক বড়, এবং উঠোনের একপাশে একটি বড় আকৃতির শিবলিঙ্গ আছে।
পাড়ার সকল মেয়ে ও মহিলারা এখানেই শ্রাবণের প্রতি সোমবার এসে পুজো করে। সেদিনও একই হবার ছিল। তাই আমি গিয়ে শিবলিঙ্গের চারপাশ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে গেলাম। গিয়ে পাথরের শিবলিঙ্গ হাত লাগতেই মনে হল যেন হাত পুড়ে যাবে। রোদের তাপে পছন্দ গরম হয়ে আছে সেটা। তাড়াতাড়ি গিয়ে আগে এক কলসি জল এনে ঢেলে দিলাম তার উপর। তারপর পুরোনো ফুল পাতা এইসব পরিষ্কার করতে শুরু করলাম।
হঠাৎ অনুভব করলাম যে রোদের তাপ কিছুটা কম হয়ে আসছে। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশে এক টুকরো কালো মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি আমার কাজ শেষ ঘরে যেতে যেতে দেখলাম প্রায় অর্ধেক আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে।
যাই হোক, বাড়ির বাকি সবাই নিজেদের দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত। তাই আমি ভাবলাম স্নান সেরে নেই, তাহলে পাড়ার অন্যান্যরা আসার আগে আমি পুজো করে নিতে পারবো। কিন্তু স্নান সেরে আসতেই দেখি বৃষ্টি আসছে বলে অনেকেই তাড়াতাড়ি এসে গেছে পুজো করতে।
সকলেই একসাথে মিলে পুজো শুরু করতে গেলাম। কিন্তু শিবের মাথায় জল ঢালতে দেরি, বৃষ্টি পড়তে আর দেরি হলো না। কিন্তু কেউ তাতে থেমে যায় নি। সবাই এক এক করে বৃষ্টির মাঝেই শিবের পুজো করলাম।
এত গরম স্নান করেও এতটা আরাম পাই নি যতটা এই বৃষ্টির জলে ভিজে অনুভব হচ্ছিল। পুজো সেরে সকলে ভেজা গায়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেল। এদিকে আমি নিজের ভিজে কাপড়গুলো বদলে নিলাম। বৃষ্টি তখনও থামে না।
জানালা থেকে বৃষ্টি দেখা, Watching rain from window :
ঘরে এসে আমার রুমের জানালায় বসলাম। ঘরের ভেতরটা আলো আঁধারিতে ভরে আছে। শুধু ঐ জানালা দিয়েই কিছুটা আলো আসছে। বৃষ্টি হচ্ছে বলে আলোর তীব্রতায় কম।
জানালার সামনে একটা টেবিল আর চেয়ার ছিল, সেখানে বসে আমি বিভিন্ন কাজ করি। ভাবলাম এখানে বসেই বৃষ্টি দেখব। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাইরে বৃষ্টির জল দেখছিলাম, আমার যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো অবস্থা তখন। আমি এই জানালায় বসে আরো অনেক বার এভাবে বৃষ্টি দেখেছি। কেন জানিনা, এই অবস্থায় আমার মনে ঠিক কি অনুভূতি তা বুঝে উঠতে পারি না।
মন আনন্দিত, নাকি মন খারাপ লাগছে নিজেই বুঝি না; শুধু মনে হয় যেন বৃষ্টি থেমে যাওয়া অবধি এখানেই বসে থাকি। এই সময় কবিগুরুর “বর্ষার দিনে” কবিতার দুটো পংক্তি খুব মনে পড়ছিল,
“ব্যাকুল বেগে অজি বহে বায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।”
বৃষ্টি দেখতে দেখতে গল্প, Brishti dekhte dekhte golpo
আমি যখন জানালার ধারে বসে আছি, তখন হঠাৎ দরজার শব্দ পেয়ে পেছন ঘুরে দেখি আমার ঘরে আমার দিদা এসেছেন। তাঁর হাতে গরম গরম আলুর পকোড়া। এসে বললেন তিনিও বসবেন আমার সাথে। একটু সময় বসে নানান কথা বলতে বলতে দিদা হঠাৎ গুনগুন করে ওঠলেন একটি গান, শুনে আমিও সুর ধরলাম আর দুজনে রবি ঠাকুরের কথায় গেয়ে উঠলাম
‘মন মোর মেঘের সঙ্গী।
উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে।
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে।
রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম……’
তারপর একসাথে ওই জায়গায় বসে আমরা দুজনে পকোরাগুলো খেতে খেতে গল্প শুরু করলাম। সেই দিদার ছোটবেলার গল্প থেকে আমার ছোটবেলার গল্প, দিদার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেল।
বৃষ্টির পরের পরিবেশের সৌন্দর্য , The beauty of the environment after rain :
দুপুর হতে হতে বৃষ্টিও থেমে গেল। সূর্য মেঘকে আড়াল করে আবার বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। দিদা তখন নিজের ঘরে চলে গেল। আমি সকলের ভেজা কাপড় নিয়ে রোদে ছড়িয়ে দিতে গেলাম।
কাপড় টাঙানোর দড়িগুলো থেকে জলের আটকে থাকা ফোটাগুলো ঝরে গেল, রোদের আলোয় এগুলো চমক বেড়ে গিয়েছিল। তারপর আমাদের ফুলের বাগানে দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি বেশ কিছু ফুলের পাপড়িতে ও গাছের পাতায় বৃষ্টির জল জমে আছে। বৃষ্টির রোদের আলো যেন পরিবেশকে আরো সুন্দর করে তুলেছে।
দৌঁড়ে গেলাম ঘরে, মোবাইল ফোন নিয়ে এসে ফুলগুলোর ছবি নিলাম। একটা পাতা থেকে বৃষ্টির জলের একটি বিন্দু ঝুলছিল, সেই বিন্দুতে রোদের আলো পড়ে একদম যেন হীরের মত চমক সৃষ্টি করেছে। সেই ফটোও তুলে রাখলাম।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘ কেটে গেছে। আজ মনে আর বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা নেই। তবে বেশ কিছুক্ষন বৃষ্টি পড়ায় গরম অনেকটা কম বোধ হচ্ছে। হঠাৎ দেখি মা ডাকছেন খাবার খাওয়ার জন্য। তাই ঘরে চলে গেলাম।
পরিশেষে :
বৃষ্টির অনুভূতি নিজে শেষে একটা কথাই বলার আছে যে, বেশ কয়েকদিন প্রচণ্ড গরম সহ্য করার পর, হঠাৎ আজকের এই বৃষ্টি অনেকটা প্রশান্তি এনে দিয়েছে। দুঃখের পর সুখ এলে ঠিক যে অনুভূতি হয়, এই বৃষ্টি যেন সেই অনুভূতি দিয়ে গেছে। তবে শুধু আমাদেরকেই নয়, বরং গাছ, ফুল, মাটি, বলতে গেলে পুরো পরিবেশই হয়তো এমনটা অনুভব করেছে।