জন্মাষ্টমী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি। শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমীতে। এই দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জন্মাষ্টমী পালন করে থাকেন। বিশ্বাস অনুযায়ী, পাশবিক শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়, তখনই ধর্মকে পুনঃসংস্থাপন করার জন্য ভক্তের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর পাপ বিনাশকারী অবতার রূপে পৃথিবীতে আসেন। ভগবান কৃষ্ণ ষড়গুণ অর্থাৎ শৌর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্যসম্পন্ন পূর্ণাবতাররূপে প্রকাশিত হন।
কৃষ্ণের জন্ম কবে হয় ? When was Krishna born?
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ অষ্টমী তিথিতে মথুরায় কংসের কারাগারে মনুষ্য রূপে জন্ম নিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। সেই পুণ্য তিথির স্মরণেই জন্মাষ্টমী পালন করা হয়।
জন্মাষ্টমীর ইতিহাস ও তাৎপর্য, History and Significance of Janmashtami :
সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, পৃথিবীতে যখনই অধর্ম বেড়ে ধার্মিক ও সাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মাধ্যমে ধর্ম রক্ষার জন্য শ্রীকৃষ্ণ অবতাররূপে ধরাধামে আসেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনী অনুসারে, দ্বাপর যুগে অত্যাচারী রাজা কংসের নৃশংসতায় মথুরাবাসী (ভারতের) অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। কংসের হাত থেকে জনগণকে নিস্তার দেওয়ার জন্য কৃষ্ণের জন্ম হয়।
রাজা কংস দৈববাণী পেয়েছিলেন, ‘বোন দেবকীর অষ্টম সন্তানই হবে তোর মৃত্যুর কারণ।’ তাই তিনি বোনকে হত্যা করতে উদ্যত হন, তখন বোন দেবকি ও ভগিনী পতি বসুদেব বলেন, ‘আমাদের দুজনকে কারাগারে আটকে রাখুন। আমাদের সন্তান হলে আপনার হাতে তুলে দেয়া হবে। জন্মের পরই আপনি তাদের হত্যা করে নিজের প্রাণ সংশয় কাটাবেন।’
বসুদেবের যুক্তি কংসের মনঃপুত হওয়ায় তিনি তাদের কারাবন্দি করে রাখলেন। তারপর থেকে একে একে সাতটি সন্তান কংসের হাতে তুলে দেন। পরে ভাদ্র মাসের শুক্লা পক্ষের অষ্টমী তিথির রাতে অষ্টম সন্তানের জন্ম দেন দেবকি।
সেই রাত ছিল ঝড়-ঝঞ্চাপূর্ণ। কারাগারের ফটকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে কোনো রক্ষী পাহারায় ছিল না। তখন বসুদেবকে এক দৈববাণীতে সদ্যোজাত ছেলেসন্তানকে নিরাপদে গোকুলে নন্দ-যশোদা দম্পতির কাছে রেখে আসতে বলা হয়। কারাগারের দরজাও তখন খুলে যায়। বসুদেব ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছেলেকে নিয়ে গোকুলে রেখে আসেন। ফেরার পথে সঙ্গে নিয়ে আসেন যশোদার সদ্যোজাত মেয়েকে। এভাবে গোকুলেই বড় হতে থাকেন শ্রীকৃষ্ণ।
১৪ বছর পর দ্বারকার রাজা হয়ে তিনি যুদ্ধে মথুরারাজ কংসকে পরাজিত ও হত্যা করেন। সেই থেকে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমী পালন করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তাদের বিশ্বাস, পাশবিক শক্তি সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হলেই ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ঈশ্বর অবতার রূপে পৃথিবীতে আসেন। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানম ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্। পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’
জন্মাষ্টমীতে কেন উপবাস করা হয়? Why do devotees fast on the day of Janmashtami?
জন্মাষ্টমীতে মানুষ কৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করার জন্য অভুক্ত থাকে, ধর্মীয় গান গায় এবং উপবাস পালন করে। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তিথিতে মধ্যরাতে তার ছোট ছোট মূর্তি কে স্নান করিয়ে কাপড় দিয়ে মোছা হয় এবং দোলনায় সাজানো হয়। তারপর উপাসক মন্ডলী নিজেদের মধ্যে খাদ্য ও মিষ্টান্ন বিনিময় করে উপবাস ভঙ্গ করে। বিশ্বাস অনুযায়ী, এই দিনটিতে ব্রত পালন করলে মনের ময়লা দূর হয়; সৎগুণের জয় হয় এবং এর ফলস্বরূপ মৃত্যুর পর জীবাত্মার মুক্তি হয়।
জন্মাষ্টমীর উপবাস কিভাবে করতে হয়? How to fast on Janmashtami?
জন্মাষ্টমীতে ফল, দুধ এবং জল সেবন করা হয়। এছাড়া শস্য, শাকসবজি, পেঁয়াজ এবং রসুন থেকে দূরে থাকতে হয়। জন্মাষ্টমীর উপবাসে চাল, শস্য, ডাল এবং লবণ সবই নিষিদ্ধ।
জন্মাষ্টমী উপবাসে কি কি খাওয়া যায়? What can be eaten on Janmashtami fasting?
জন্মাষ্টমীতে উপবাস করে হরিনাম জপ, কৃষ্ণ লীলা শ্রবণ, ভগবানকে দর্শন, ভক্ত সঙ্গে হরিনাম কীর্তন, অভিষেক দর্শন করতে হবে এবং ভগবানকে অভিষেক করে একাদশীর দিনের মতো অনুকল্প প্রসাদ সেবন করতে হবে। তবে যাঁদের উপবাস পালনে সমস্যা, অসুস্থ, তাঁরা অবশ্যই দুপুর ১২ টার পরে, কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা চেয়ে, একটু দুধ, বা ফল খেতে পারবেন।
জন্মাষ্টমী 2024 বাংলা তারিখ কত? What is Janmashtami 2024 Bengali Date?
জন্মাষ্টমী 2024 সালের 26 এবং 27 আগস্ট উদযাপিত হয়েছে৷ এদিন ভক্তরা উপবাস, প্রার্থনা এবং প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত হয়ে থাকেন৷ জন্মাষ্টমীর দিনটিতে শ্রীকৃষ্ণের পূজাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
নিজের জন্ম নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ‘আমার জন্ম-মৃত্যু সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়, কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া—দুটিই আমার অলৌকিক লীলা।’
জন্মাষ্টমীতে কি কি করা উচিত নয়? What should not be done on Janmashtami?
জ্যোতিষীরা বলেন, জন্মাষ্টমীর দিনে কিছু কাজ রয়েছে যা করা নিষিদ্ধ; যেমন চুল, দাড়ি, নখ ইত্যাদি কাটবেন না। জন্মাষ্টমীর দিন কোনো ব্যক্তির ভুল করেও চুল, নখ ইত্যাদি কাটা উচিত নয়। জন্মাষ্টমীর দিন ভুল করেও কালো কাপড় ব্যবহার করা উচিত নয়।
বাড়িতে জন্মাষ্টমী পূজা কিভাবে করবেন? How to do Janmashtami Puja at home?
বাড়িতে জন্মাষ্টমী পূজা করতে চাইলে একটি দিনব্যাপী উপবাস বা আংশিক উপবাস পালন করুন, মধ্যরাত্রি পূজার পরেই তা ভঙ্গ করুন। ধূপ, ফুল এবং মিষ্টি সহ একটি পূজা থালি সাজিয়ে নিন। গোপালের জন্য ভোগ (প্রসাদ) যেমন দুধ, দই, মাখন বা মিষ্টি রাখুন। মাটির প্রদীপ বা কর্পূর শিখায় কৃষ্ণের আরতি করুন।
গোপালের প্রিয় খাবার কি? What is Gopal’s favorite food?
গোপালের প্রিয় খাবার মাখন। এটা সকলেরই হয়তো জানা আছে। তাই জন্মাষ্টমীর ভোগে মাখন রাখা খুবই জরুরি। পাশাপাশি নাড়ু বা লাড্ডু ভোগে রাখতে ভুলবেন না।
জন্মাষ্টমীর উপবাস করলে কি হয়? What happens if you keep fast on Janmashtami?
কথিত আছে, কেউ যদি এই জন্মাষ্টমীতে উপবাস পালন করে শ্রীকৃষ্ণের পুজো করেন, তা হলে তাঁকে আর এই জড় জগতে জন্ম, মৃত্যু, ব্যাধি, কষ্ট ভোগ করতে হয় না। এমনকি পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। আবার বিশ্বাস ভক্তিভরে এই দিনে শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করলে দূরে হয় প্রেমের বাধাও।
জন্মাষ্টমীতে কি কি করতে হয়? What to do on Janmashtami?
জন্মাষ্টমীতে হিন্দুরা উপবাস, কীর্তন গান গেয়ে একসঙ্গে প্রার্থনা করে, কৃষ্ণের জন্য বিশেষ খাবার তৈরি করে, রাতের জাগরণ এবং কৃষ্ণ বা বিষ্ণু মন্দিরে গিয়ে জন্মাষ্টমী উদযাপন করে। এদিন মথুরা এবং বৃন্দাবনের মত স্থানগুলি তীর্থযাত্রীদের ভিড় হয়।
জন্মাষ্টমী পালন না করলে কি হয়? What happens if you do not celebrate Janmashtami?
শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যদি কেউ জন্মাষ্টমীর দিন অন্ন বা পঞ্চ শস্য আহার করে তাহলে তাকে যোজন যোজন বছর নরক যন্তনা ভোগ করতে হয়; আর জন্মাষ্টমীর উপবাস, নাম কীর্তন শ্রবন করলে, ভগবানের ইচ্ছায় আমরা বৈকন্ঠে যেতে পারবো।
জন্মাষ্টমীতে বাচ্চা হলে কি ভালো হয়? Is it good to have a baby on Janmashtami?
জন্মাষ্টমীতে জন্মগ্রহণ করা শিশু ব্যাপকভাবে শুভ এবং আশীর্বাদপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
জন্মাষ্টমীতে কি কি খাওয়া যাবে না? What can not be consumed on Janmashtami?
জন্মাষ্টমীতে শুধুমাত্র সাত্ত্বিক (শুদ্ধ) খাবার খান। মাংস, পেঁয়াজ, রসুন এবং অ্যালকোহলের মতো জিনিসগুলি এড়িয়ে চলুন কারণ এগুলি এই পবিত্র দিনে তামসিক এবং অনুপযুক্ত। কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীতে, বাড়িতে প্রসাদ (প্রসাদ) প্রস্তুত করুন।
শেষ কথা, Conclusion :
শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণুর সবচেয়ে অপরূপ অবতার বলে মনে করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন জন্মাষ্টমীতে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনায় জগতের সব সুখ লাভ হয়; মঙ্গল হয় পরিবার, দেশ ও সমাজের। তাই শুধু মথুরা নয়, শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবন থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই তিথিটি ভক্তিভরে পালন করে থাকেন।