আপনারা হয়তো প্রায়ই কাউকে গল্প করতে দেখে থাকবেন যে ক’দিন আগেও তাদের চুলের গোছাটা মুঠো তে ধরলে বেশ মোটাসোটা মনে হতো কিন্তু হঠাৎ করেই মাথা থেকে গোছা গোছা চুল উঠতে শুরু করলো, আর কিছুদিনের মধ্যেই চুলগুলো মুঠো তে ধরে দেখা যাচ্ছে গোছাটা অনেক সরু হয়ে। এমন সব কথা হয়তো আপনি নিজেও কারও সাথে গল্প করে থাকবেন।
চুলের ঘনত্ব ফিরে পেতে কত না পণ্য ব্যবহার করা হয়, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না, বরং অনেকের সমস্যা বেড়ে যায়। এই প্রতিবেদনে আমরা মাথার চুল ঘন করার বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
চুল পড়ার সমস্যা এবং এর কারণসমূহ, Hair loss problem and its causes
বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ মানুষেরই চুল পড়ার সমস্যা, চুল বিবর্ণ হয়ে যাওয়া, রুক্ষসুক্ষ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আবার অনেকের ঝলমলে চুল থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে চুল উঠে গিয়ে ঘনত্ব কম হয়ে যেতে পারে।
চুলের উক্ত সমস্যাগুলোর কারণগুলো হল : পরিবেশের দূষণ, বয়স বাড়তে থাকা, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে, কোনও কারণে মানসিক চাপ, চুলের সঠিক যত্ন না নিলে, অসুস্থতার মধ্যে খাওয়া বিভিন্ন ওষুধের প্রভাবে ইত্যাদি। তাছাড়া চুলের স্টাইলিং করার জন্য যথেচ্ছ পরিমাণ তাপপ্রয়োগ, কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট এর মতো অন্যান্য কারণগুলোও তো আছেই।
মাথার চুল ঘন করার বিভিন্ন উপায়, Different ways to thicken hair
চুল পড়ার কারণ যাই হোক, এক্ষেত্রে দরকার হল সমাধান। ঝরে যাওয়া চুলের জায়গায় নতুন চুল গজানোর মধ্য দিয়ে চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধি করা সম্ভব। মাথার চুল জন্মসূত্রেই পাতলা হোক বা নানা কারণে পাতলা হয়ে গিয়ে থাকুক না কেনো, চেষ্টা করলে তা প্রাকৃতিকভাবে ঘন করে তুলতে পারবেন। এর জন্য করণীয় :
নিয়মিত চুল মাসাজ করা উচিত :
সপ্তাহে অন্তত একদিন শ্যাম্পু করার পূর্বে গরম তেল দিয়ে স্ক্যাল্পে ভালোভাবে মাসাজ করুন। এতে চুলের নিচে থাকা চামড়ার রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় ফলে চুল সুস্থ থাকে। আমন্ড অয়েল, নারকেল তেল, ক্যাস্টর অয়েল, অলিভ অয়েল বা অ্যাভোকাডোর মতো উপকারী প্রাকৃতিক তেল চুলের গোড়ায় লাগলে তা চুলের পুষ্টি জোগায়, চুলের রুক্ষতা কমাতে সাহায্য করে। এভাবে চুল পড়া কম হয় এবং ক্রমে নতুন সুস্থ চুলের বৃদ্ধির সাথে মাথায় চুলের ঘনভাব ফিরে আসে।
প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করুন :
আমাদের হেঁশেলেই এমন কিছু উপাদান লুকিয়ে আছে যা সুস্থ ঝলমলে চুলের রহস্য। হেয়ার মাস্ক চুলে পুষ্টি জোগায় ফলে মাথা থেকে সহজে চুল ঝরে যায় না, তাছাড়া কিছু উপাদান নতুন চুল গজানোর ক্ষেত্রেও কার্যকরী। পেঁয়াজের রস, অ্যালোভেরা জেল, নারকেল তেলের মতো একদম সাধারণ উপাদানগুলোতে এমন বহু ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে যা পাতলা চুল ঘন করার ক্ষেত্রে ম্যাজিকের মতো কাজ করে।
তাই এ সব উপাদান দিয়ে নিজস্ব হেয়ার মাস্ক তৈরি করে নিতে পারেন। ক্যাস্টর অয়েল এর সঙ্গে পেঁয়াজের রস বা অ্যালো ভেরা জেল মেশালে তৈরি হয়ে যাবে দারুণ কার্যকর একটি হেয়ার মাস্ক। চুলে আর স্ক্যাল্পে এই মিশ্রণ লাগিয়ে আধ ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা সময় রেখে ধুয়ে ফেলুন। প্রতি সপ্তাহে যদি একবার এই টোটকা ব্যবহার করেন তবেই চুল ধীরে ধীরে ঘন হতে শুরু করবে।
প্রোটিনে ভরপুর খাবার খেতে হবে :
খাবারে যথেষ্ট পুষ্টি যদি না থাকে তাহলে তার প্রভাব চুলেও পড়বে। ডিম, মাছ, দুধ, দই বা ছানা পরিমিত মাত্রায় নিয়মিত খেতে হবে। অন্যদিকে ব্রোকোলি, পালং, বাঁধাকপির মতো সবুজ শাকসবজিও চুলের কেরাটিন মজবুত করে তোলে, ফলে চুল ঘন হয়। এছাড়াও কমলালেবু, স্ট্রবেরি, পেয়ারার মতো উপকারী ফলও রোজ খান। শরীরের দৈহিক চাহিদা অনুযায়ী প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া খুব জরুরী।
উন্নত মানের চুলের পণ্য ব্যবহার করুন :
অনেক সময় বাজার থেকে সস্তা সাবান শ্যাম্পু ব্যবহার করা হয়, কিন্তু সেগুলো আমাদের চুল ও মাথার ত্বকের অনেক ক্ষতি করে, শুষ্ক করে দেয় চামড়া। তাই ভালো শ্যাম্পু, তেল, কন্ডিশনার ব্যবহার করা উচিত যা আপনার চুল ভালো রাখতে সাহায্য করে। বিশেষত আয়ুর্বেদিক শ্যাম্পু ব্যবহার করা শ্রেয়। বাজার থেকে এইসব পণ্য কেনার সময় সেগুলোর মধ্যে কেমিকেল এর মাত্রা কতটা রয়েছে, আর প্রাকৃতিক উপাদান কি কি ব্যবহৃত সেটা দেখে কেনা উচিত।
নিয়মিত যোগাসন করুন :
পাতলা চুল মজবুত করে তুলতে এবং চুলের সুস্থতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে যোগাসনের ভূমিকা খুব জরুরি। আমরা সকলেই জানি যোগাসন করলে শরীরে রক্ত সংবহন বাড়ে। সেক্ষেত্রে চুলের সুস্থতার জন্য বজ্রাসন, উত্থানাসনের মতো উপকারী আসনগুলি চুল স্বাভাবিকভাবে ঘন আর মজবুত করে তুলতে সহায়তা করবে।
পেঁয়াজের রসের ব্যবহার :
মাথার যেসব জায়গায় চুল বেশি পাতলা, প্রায় চামড়া দেখা যাওয়ার মত অবস্থা, সেখানে পেঁয়াজ কেটে তার রস ঘষলে সেই অংশের রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, ফলে তা নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। আপনার চুলের ফলিকল এর কোনও অংশ যদি ক্ষতিগ্রস্ত থাকে তাহলে এই পদ্ধতির নিয়মিত ব্যবহারে তা সারিয়ে তোলে।
ডিম এর ব্যবহার করুন :
আমরা সকলেই জানি যে ডিম হচ্ছে প্রাকৃতিক প্রোটিন, যা আমাদের চুলকে ঘন করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই সপ্তাহে অন্তত একদিন চুলে ডিম লাগতে পারেন। এরজন্য, একটি ডিমের সাদা অংশ নিয়ে তা খুব ভালো ভাবে ফেটিয়ে নিতে হবে। তারপর চুলে সরাসরি হাত অথবা ব্রাশের ব্যবহার করে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত লাগাতে হবে।
চুলে ডিম লাগানোর পর একটি মোটা দাঁতের চিরুনি দিয়ে সাবধানে চুল আঁচড়ে নিন। তারপর হালকা ঝুটি করে রেখে দিন অথবা শাওয়ার ক্যাপ পরে নিন। ২০-৩০ মিনিট রেখে জল দিয়ে চুল ধুয়ে নিন, অথবা শ্যাম্পু করুন, তবে আলাদা করে সেদিন আর কোনো কন্ডিশনার ব্যবহার করবেন না।
আমলকীর ব্যবহার করতে পারেন :
আমলকী চুল ও ত্বকের জন্য কতটা উপকারী তা হয়তো কারোরই অজানা নয়। পাতলা চুল ঘন করে তুলতে ১ টেবিল চামচ আমলকী গুঁড়া ও ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। তারপর এতে সমপরিমাণ টকদই মিশিয়ে নিলেই সেটা চুলের জন্য আরও উপযোগী হয়ে উঠবে। চুল রুক্ষ বা শুষ্ক হলে এই মিশ্রণে মধুও যোগ করা যেতে পারে।
সবকিছু ভালোভাবে মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে নিয়ে চুলে লাগিয়ে নিন, এরপর ৩০-৪০ মিনিট এইভাবেই রেখে দিন। তারপর চুল শ্যাম্পু দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিন। উক্ত মিশ্রণটিকে এই উপায়ে সপ্তাহে ১-২ বার ব্যবহার করতে পারেন।
মধু চুলে মোলায়েমভাব বজায় রাখবে। আমলকীতে থাকা প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস এবং ভিটামিন সি চুলের স্বাস্থ্য সুন্দর রাখবে এবং চুলের গোড়ায় কোলাজেন-এর মাত্রাও বৃদ্ধি করে তুলবে, ফলে মাথায় চুলের বৃদ্ধি হবে। অন্যদিকে মিশ্রণটিতে ব্যবহৃত লেবুর রস চুলের খুশকি দূর করতে সাহায্য করবে এবং চুলের বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে।
চুলের যত্নে যে সব বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত, Things that should be given special attention in hair care
- ভিজে চুল আঁচড়াবেন না।
- চুলের কোনও বিশেষ সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- অতিরিক্ত হেয়ার টুল ব্যবহার করবেন না।
- অতিরিক্ত হেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করবেন না।
উপসংহার, Conclusion
চুলের যত্ন নেওয়া খুব জরুরী, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবহেলার ফলেই চুলের ক্ষতি হয় এবং মাথা থেকে চুল ঝরে পড়তে থাকে, ফলে ঘনত্বও কম হয়ে যায়। চুলের ঘনত্ব ফিরিয়ে আনতে কেমিকেলযুক্ত পণ্য ব্যবহার না করে বরং প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করুন, অথবা আয়ুর্বেদিক উপায়ে চুলের যত্ন নিন, কারণ আপনার চুল সুস্থ রাখার দায়িত্ব আপনার হাতেই।