শ্রীঅরবিন্দ ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী— দার্শনিক, যোগী, কবি, চিন্তাবিদ এবং জাতীয়তাবাদী নেতা। তিনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে বন্দে মাতরম্ প্রভৃতি সংবাদপত্র সম্পাদনা করে রাজনৈতিক চেতনা ছড়িয়ে দেন এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯১০ সালের পর তিনি রাজনীতি থেকে সরে এসে আধ্যাত্মিক জীবন ও দর্শনের দিকে অগ্রসর হন এবং মানব-সভ্যতার আধ্যাত্মিক বিবর্তন ও প্রগতির এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেন। তাঁর জীবন ও কর্ম একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক সাধনার পথনির্দেশ।
শ্রী অরবিন্দ কে ছিলেন? Who was Aurobindo?
অরবিন্দ ঘোষ (জন্মনাম: অরবিন্দ অ্যাক্রয়েড ঘোষ; ১৫ আগস্ট ১৮৭২ – ৫ ডিসেম্বর ১৯৫০) একজন শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত, পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক মহান বিপ্লবী চিন্তাবিদ। পাশ্চাত্যের শিক্ষা অর্জন করেও তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে গভীরভাবে যুক্ত করেন। তাঁর জীবন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অনন্য প্রেরণা।
শ্রী অরবিন্দ ঘোষের শৈশব, Aurobindo Ghosh’s childhood :
অরবিন্দ ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায়, হুগলি জেলার কোন্নগরের এক কুলীন কায়স্থ পরিবারে। তাঁর বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন রংপুর জেলার জেলা সার্জন এবং মা স্বর্ণলতা দেবী ছিলেন সমাজসংস্কারক রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। ছোটবেলা থেকেই তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হন।
বিলেতে শিক্ষা, Studying in Britain :
১৮৭৯ সালে অরবিন্দকে দুই ভাইসহ পাঠানো হয় ইংল্যান্ডে। ম্যানচেস্টার ও লন্ডনের স্কুলে পড়াশোনা শেষে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি গ্রীক, লাতিন ও ইংরেজি সাহিত্যে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। আইসিএস পরীক্ষায়ও সাফল্য পান, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের চাকরি গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে অশ্বারোহণ পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে চাকরির পথ থেকে সরে আসেন।
বারোদার কর্মজীবন, Baroda’s career :
১৮৯৩ সালে দেশে ফিরে তিনি বারোদা রাজ্য সরকারের অধীনে কাজ শুরু করেন। পরে বারোদা কলেজে ফরাসি ভাষার অধ্যাপক ও উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানেই তিনি প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ The Rishi। পাশাপাশি তিনি সংস্কৃত, বাংলা ও হিন্দি অধ্যয়ন করেন।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, Political activities :
বারোদা থেকেই তিনি গোপনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং বাঘা যতীনের মতো নেতাকে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন। লোকমান্য তিলক ও ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
শ্রী অরবিন্দ কেন বিখ্যাত ছিলেন? Why was Aurobindo famous?
শ্রী অরবিন্দ বিখ্যাত ছিলেন তাঁর বিপ্লবী কার্যকলাপ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান, এবং একজন দার্শনিক, যোগী ও কবি হিসেবে আধ্যাত্মিকতার বিকাশে অবদানের জন্য। তিনি ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে পন্ডিচেরিতে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করে মানব প্রগতি ও ঐশ্বরিক জীবনের দর্শন প্রচার করেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা হিসেবে ঋষি অরবিন্দ, Rishi Aurobindo as a leader of the freedom movement:
- বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী: শ্রী অরবিন্দ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি বন্দে মাতরমের মতো সংবাদপত্র সম্পাদনা করে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করেছিলেন।
- রাজনৈতিক জীবন: তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সমর্থক ছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন।
১৯১০ সালের পর তিনি রাজনীতি থেকে সরে এসে সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিকতার চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তিনি একটি নতুন দর্শন প্রচার করেন যেখানে তিনি মানুষের আধ্যাত্মিক বিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবীতে ঐশ্বরিক জীবনের প্রতিষ্ঠা ও মানবজাতির অগ্রগতির কথা বলেন। এই দর্শনকে “অখণ্ড যোগ” বা “সমন্বিত যোগ” বলা হয়, যা মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে একীভূত করে।
প্রসঙ্গত, শ্রী অরবিন্দ একাধারে একজন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী এবং এক গভীর আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিলেন, যিনি ভারতের স্বাধীনতা ও মানবজাতির আধ্যাত্মিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি একজন মহান কবিও ছিলেন এবং “সাবিত্রী: আ লেজেন্ড অ্যান্ড আ সিম্বল” এর মতো বিখ্যাত রচনা লিখেছিলেন। মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বিকাশের মাধ্যমে আত্মাকে আলোকিত করার উৎস হিসেবে তিনি শিক্ষাকে দেখতেন।
অরবিন্দের মতে শিক্ষা কি? What is education according to Aurobindo?
ঋষি অরবিন্দ মনে করতেন যে, শিক্ষা শুধুমাত্র জ্ঞান প্রদান নয়, বরং এটি একটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশের মাধ্যমে তার অন্তর্নিহিত ঐশ্বরিক সত্তার পূর্ণ জাগরণ প্রক্রিয়া। তিনি “পূর্ণ শিক্ষা” (Integral Education) ধারণার প্রবক্তা ছিলেন, যার লক্ষ্য হলো মানুষকে তার আধ্যাত্মিক চেতনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং স্বর্গীয় জীবনে প্রস্তুত করা। শিক্ষকের কাজ হলো শিশুকে তার নিজের ভেতরের সম্ভাবনার দিকে পরিচালিত করা, তাকে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া নয়।
শিক্ষার মূলনীতি ও লক্ষ্য :
- সমন্বয়ী শিক্ষা: অরবিন্দ এমন এক শিক্ষার কথা বলেছেন যা মানুষের সকল দিককে অন্তর্ভুক্ত করে – শরীর, মন, আত্মা, জ্ঞান, শক্তি, প্রেম, এবং সৌন্দর্য।
- আত্ম-বিকাশ: প্রতিটি মানুষের মধ্যে ঈশ্বরত্বের অংশ থাকে, এবং শিক্ষা সেই অন্তর্নিহিত ঐশ্বরিকতাকে বিকশিত করতে সাহায্য করে।
- আধ্যাত্মিক বিকাশ: শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটানো এবং তাকে ঐশ্বরিক জীবনের দিকে প্রস্তুত করা।
ঋষি অরবিন্দ মনে করতেন, শিক্ষক একজন প্রশিক্ষক নন, বরং একজন সহায়ক, যিনি শিশুকে তার নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে এবং তার পূর্ণতা অর্জনে সাহায্য করেন। শিক্ষকের উচিত নিজের ধারণা চাপিয়ে না দিয়ে, বরং শিশুকে পরামর্শ দেওয়া এবং তার নিজের আবিষ্কার ও শেখার প্রতি উৎসাহিত করা।
অরবিন্দ বিশ্বাস করতেন যে, কিছুই ‘শেখানো’ যায় না, বরং শিক্ষক কেবল শিশুকে তার নিজের ভেতরের জ্ঞানকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করতে পারেন। তিনি স্ব-শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন, যেখানে শিক্ষার্থী নিজের পথে, নিজের আগ্রহ অনুযায়ী শেখে এবং শিক্ষক তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।
শ্রী অরবিন্দের মতে সৃষ্টি কি? What is creation according to Aurobindo?
শ্রী অরবিন্দের মতে, সৃষ্টি হলো একটি ঐশ্বরিক আনন্দ বা সৃষ্টির প্রকাশ, যা পরম সত্তা থেকে নিম্নগামী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে, যাকে তিনি “ইনভল্যুশন” (অবক্রমণ) বা আত্ম-আবির্ভাব বলেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরম সত্তা নিজেরই একটি ক্রমহ্রাসমান রূপে অবতীর্ণ হয়, যা থেকে পরবর্তীতে বিবর্তনের (বিবর্তন) মাধ্যমে আবার চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ পায় এবং এই বিবর্তনই হলো “অখণ্ড যোগ” বা ঈশ্বরের দিকে মানবজাতির অগ্রগতি।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, শ্রী অরবিন্দের মতে, সৃষ্টি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি পরম চেতনার আত্ম-প্রকাশের একটি প্রক্রিয়া, যা অবক্রমণ ও বিবর্তনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ঐশ্বরিক আনন্দ ও দেবত্বের সম্পূর্ণ প্রকাশ।
শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের কাহিনী কি? What is the story of Aurobindo Ashram?
শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের কাহিনী শুরু হয় শ্রী অরবিন্দ যখন ১৯১০ সালে পন্ডিচেরিতে বসতি স্থাপন করেন এবং তাঁর আধ্যাত্মিক অনুশীলনে মনোনিবেশ করেন, যা ১৯২৬ সালে একটি সম্প্রদায় হিসেবে সংগঠিত হয়। এই আশ্রমটি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট অংশগ্রহণকারী এবং দার্শনিক শ্রী অরবিন্দ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যিনি পরে তাঁর আধ্যাত্মিক সহযোগী মিরা আলফাসার কাছে আশ্রমের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন। এটি আধ্যাত্মিকতা, দর্শন ও ঐশ্বরিক জীবন ধারণের একটি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
অরবিন্দ ঘোষের নৈতিকতা কি কি? What are the morals of Aurobindo Ghosh?
অরবিন্দ ঘোষের নৈতিকতা কেবল সামাজিক নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং আত্ম-পরিপূর্ণতা ও আধ্যাত্মিক বিবর্তনের পথে চালিত হতো। তাঁর নৈতিকতার মূল ভিত্তি ছিল অভ্যন্তরীণ সত্যের অনুসন্ধান, শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা, এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও মানবজাতির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা।
অরবিন্দ ঘোষের নৈতিকতার প্রধান দিকগুলি, Main aspects of Aurobindo Ghosh’s ethics :
আধ্যাত্মিকতা ও আত্ম-পরিপূর্ণতা: তিনি মনে করতেন, প্রকৃত নৈতিকতা আসে ভেতর থেকে, বাহ্যিক কোনো নিয়মকানুন থেকে নয়। এর মাধ্যমে মানুষ নিজের আধ্যাত্মিক শক্তি ও সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করতে পারে।
- সামগ্রিক বিকাশ: তিনি শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক – এই চারটি স্তরের বিকাশের ওপর জোর দিতেন। এগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও ভারসাম্য বজায় রাখাই প্রকৃত নৈতিকতার অংশ।
- অভ্যন্তরীণ সত্যের অনুসরণ: অরবিন্দ বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তির ভেতরে থাকা সত্য ও নীতি অনুসরণ করাই নৈতিকতার মূল ভিত্তি।
- পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা: তিনি ব্রিটিশ শাসন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বয়কট ও নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জনের কথা বলেছেন।
- বিশ্ব সম্পর্কে ভারতের ভূমিকা: তিনি মনে করতেন, বিশ্ব সংসারে ভারত একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করার জন্য নির্ধারিত, যা মানবজাতির অগ্রগতি ও আধ্যাত্মিক বিবর্তনে অবদান রাখবে।
- শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক উন্নয়ন: তিনি শিক্ষাকে মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে জাগ্রত করার একটি মাধ্যম হিসেবে দেখতেন, যার মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক, এবং আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটে।
- ঐশ্বরিক পথে জ্ঞান ও কর্ম: তাঁর দর্শন ছিল জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মকে সমন্বিত করে ঐশ্বরিক পথে চালিত করা।
অরবিন্দ ঘোষের নৈতিকতা ছিল এক ধরনের সমন্বিত নৈতিকতা, যা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিক বিকাশ এবং মানবজাতির সেবা করার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
অরবিন্দ ঘোষের গুরু কে ছিলেন? Who was Aurobindo Ghosh’s guru?
অরবিন্দ ঘোষের কোনো নির্দিষ্ট ‘গুরু’ ছিলেন না, তবে তিনি প্রধানত তার নিজের আধ্যাত্মিক সাধনা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন, যা তিনি তার লেখনি ও শিক্ষা -এ প্রকাশ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি শ্রী মা-র (মিরা আলফাসা) সান্নিধ্যে আসেন, যিনি তার সহযোগী এবং সহকর্মী আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে বিবেচিত হন।
- স্ব-শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক সাধনা: অরবিন্দ ঘোষ নিজে থেকেই আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে যোগী, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
- শ্রী মা ও অরবিন্দের সম্পর্ক: অরবিন্দ ঘোষের দীর্ঘ জীবনে শ্রী মা, যিনি ফরাসি আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন, তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সহকর্মীতে পরিণত হন। শ্রী মা-কে অরবিন্দ ঘোষের আধ্যাত্মিক সাধনার সঙ্গী এবং সহযোগী হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু তাকে অরবিন্দ ঘোষের সরাসরি গুরু হিসেবে উল্লেখ করা হয় না।
তিনি তার নিজস্ব আধ্যাত্মিক দর্শন তৈরি করেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও জীবনকে আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে উন্নীত করার চেষ্টা করেন।
অরবিন্দ ঘোষের বিখ্যাত বই কোনটি? Which is the famous book of Aurobindo Ghosh?
অরবিন্দ ঘোষের (শ্রী অরবিন্দ) বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘দ্য লাইফ ডিভাইন’ (The Life Divine), যা যোগের দার্শনিক দিক নিয়ে আলোচনা করে, এবং ‘সিন্থেসিস অফ যোগ’ (Synthesis of Yoga), যেখানে তার নিজস্ব ‘অখণ্ড যোগ’ ব্যবস্থার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে ভারতের ইতিহাস ও আত্মাকে নিয়ে লেখা ‘ইন্ডিয়া’স মেসেজ’ (India’s Message) এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ ও কবিতা সংকলন।
অরবিন্দ ঘোষের রচিত ৩২ টি গ্রন্থের মধ্যে বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা ৬টি। তার উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ:
- Essays on Gita
- Savitri, Mother India
- The Hero and the Nymph Urvasie
- Song of Myrtilla and other Poems
- The age of Kalidasa
- A System of National Education
- The Renaissance in India
- Speeches of Aurobinda
বাংলা গ্রন্থ:
- কারাকাহিনী
- ধর্ম ও জাতীয়তা
- অরবিন্দের পত্র
অরবিন্দ ঘোষের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের ধারণা কী ছিল? What was Aurobindo Ghosh’s idea of passive resistance?
অরবিন্দ বিশ্বাস করতেন যে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ দুর্বল বা বশীভূত হওয়ার অর্থে নিষ্ক্রিয় হওয়া উচিত নয়, বরং অহিংস প্রতিরোধের একটি রূপ যা নৈতিক শক্তি এবং সাহস প্রদর্শন করে। তিনি অন্যায় কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার উপায় হিসাবে অসহযোগ এবং নাগরিক অবাধ্যতার শক্তির উপর জোর দেন।
ঋষি অরবিন্দ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির নাম কী? What is the name of the institution founded by Rishi Aurobindo?
ঋষি অরবিন্দের স্মৃতিতে নবদ্বীপের একদম শেষপ্রান্তে গঙ্গার তীরে নিদয়া ঘাট সংলগ্ন মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠছে অরবিন্দের ভাবাদর্শে পরিচালিত ‘বঙ্গবাণী’ নামে এক অভিনব আশ্রম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
অরবিন্দের বিখ্যাত উক্তি কি? What is Aurobindo’s famous quote?
ঋষি অরবিন্দ ঘোষের একটি উল্লেখযোগ্য উক্তি হলো: “প্রকৃতির অস্বাভাবিকতা কোন আপত্তি নয়, অপূর্ণতার কোন প্রয়োজনীয় চিহ্ন নয়, তবে অনেক বড় পরিপূর্ণতার প্রচেষ্টা হতে পারে”। এই উক্তিটি তাঁর ‘দ্য লাইফ ডিভাইন’ ও ‘মানব চক্র’ গ্রন্থের অংশ, যা মানব সত্তার আধ্যাত্মিক রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
এছাড়াও তাঁর কিছু উক্তি হল :
It is only by the touch of the Absolute that we can arrive at our own absolute.
The Absolute is beyond personality and beyond impersonality, and yet it is both the Impersonal and the supreme Person and all persons.
বাধা সহজে সম্পূর্ণ যায় না। খুলতে খুলতে, চেতনা বাড়তে বাড়তে শরীর চেতনা পর্যন্ত যখন রূপান্তরিত হয়, তখন বাধা সম্পূর্ণ চলে যায়।
আত্মজ্যোতিতে আলোকিত সৎস্বরূপের প্রকাশকেই ভাব বা বিজ্ঞান বলা যায়। ইহা মনের চিন্তা বা কল্পনা নহে। ইহা কার্যসাধক বা ফলপ্রসূ আত্মসংবিদ।
সত্যের সোজা পথ খোলা অন্তরে যা সমর্পণ করা হয় সেই অবস্থায় সহজ সরলভাবে ওপরে মায়ের কাছে গিয়ে সত্যের সঙ্গে মিলিত হয়, সত্যময় হয়ে যায়।
বাক্য হল শক্তিপূর্ণ-এমনকি সাধারণ লিখিত বাক্যেরও কিছু শক্তি থাকে। বাক্য দিব্যপ্রেরণা থেকে এলে তার শক্তি আরো বেশি হয়।
যদি মনোময় জীবনে পৌছিয়া যে অন্নময় জীবন আমাদের ভিত্তি তাহাকে প্রত্যাখ্যান বা তাচ্ছিল্য করিয়া বসি অথবা আধ্যাত্মিক জীবনের আকর্ষণে যদি প্রাণময় ও মনোময় জীবনকে বিসর্জন দিয়া ফেলি তবে আমাদের মধ্যে ভগবানকে পূর্ণরূপে ফুটাইয়া তোলা হয়।
সৃষ্টি ও স্রষ্টা, এক ছাড়া অন্য কিছু হইতে পারে না, সৃষ্টি স্রষ্টার আত্মসত্তা, চিৎশক্তি এবং আনন্দ স্বরূপেরই একটা ছন্দ, একটা খেলা, একটি ঘূর্তি বা পরিণতি।
উপসংহার
শ্রীঅরবিন্দ ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি রাজনীতির অগ্নিপথ থেকে আধ্যাত্মিকতার শান্তপথে যাত্রা করেছিলেন। জীবনের প্রথম পর্বে তিনি ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সাহসী বিপ্লবী, আর পরবর্তী পর্বে মানবজীবনের আধ্যাত্মিক বিকাশ ও বিশ্বজনীন প্রগতির সাধক। তাঁর দর্শন আজও মানুষের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয়।


