শেরে বাংলা নামে খ্যাত আবুল কাশেম ফজলুল হক একজন বাঙালি আইনজীবী, লেখক এবং সংসদ সদস্য ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের সময়ে তিনি বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। মূলত রাজনৈতিক মহলে তিনি শের-এ বাংলা এবং সাধারণ মানুষের নিকট ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন।
নিজের জীবদ্দশায় তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠান করেছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ১৯৩৫ সালে কলকাতার মেয়র, ১৯৩৭-১৯৪৩ সাল অবধি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, ১৯৪৩ সালে পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ১৯৫৬-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইত্যাদি পদগুলো। তৎকালীন সময়ের যুক্তফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এর পরিচয়, Introduction of Sheree Bangla AK Fazlul Haque
এ. কে. ফজলুল হকের জন্ম হয় ১৮৭৩ সালে ২৬ অক্টোবর। তাঁর পিতার নাম কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং মাতা সাইদুন্নেসা খাতুন, ফজলুল হক তাদের একমাত্র পুত্র ছিলেন।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাড়ি কোথায়, Where is AK Fazlul Haque’s house in Shere Bangla?
বরিশাল জেলার রাজাপুর থানাধীন সাতুরিয়া গ্রামে নিজের মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এ কে ফজলুল হক। তাঁর আদি পৈতৃক ভিটা ছিল পটুয়াখালী জেলার অন্তর্গত বাউফল উপজেলায়। আঠারো শতকে ফজলুল হকের পূর্বপুরুষ ভারতের ভাগলপুর থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়।
এ. কে. ফজলুল হকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, A. K. Educational Qualification of Fazlul Haque
নিজ বাড়িতেই এ. কে. ফজলুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পরে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন গ্রাম্য পাঠশালায়। অন্যদিকে বাড়িতে নিজের গৃহ শিক্ষকদের নিকটে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৮৮১ সালে বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। ১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করেন হক এবং ১৮৮৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন, সেই পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে সকল মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন তিনি। তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তির জন্য ফজলুল হক শিক্ষকদের খুবই স্নেহভাজন ছিলেন।
প্রবেশিকা পাশ করার পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় চলে যান তিনি। সেখানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়াশুনা করেন। ১৮৯১ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
নিজের মেধার ভিত্তিতে তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এফ.এ. পাশ করে তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অনার্সসহ একই কলেজে বি.এস সি ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে বি.এ. পাশ করার পর এম.এ. ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। ফুজলুল হক পড়াশুনা ছাড়াও খেলাধুলার প্রতিও খুবই আগ্রহী ছিলেন।
তিনি ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। তিনি মোহামেডান ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এর সাথে জড়িত ছিলেন। এছাড়া তিনি দাবা, সাঁতার সহ আরো বিভিন্ন খেলা পছন্দ করতেন, এবং নিজে একজন সুদক্ষ খেলোয়াড় ছিলেন।
বৈবাহিক সম্পর্ক, married life
এম.এ. পাশ করার পর এ. কে. ফজলুল হক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর বিয়ে হয়েছিল তৎকালীন সময়ের নবাব আবদুল লতিফের পৌত্রী খুরশিদ তালাত বেগমের সাথে। পরবর্তী সময়ে তাদের দাম্পত্য জীবনে বেগম খুরশিদ দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত খুরশিদ তালাত বেগমের অকালে প্রয়াণ ঘটে।
তখন হক দ্বিতীয় বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং হুগলী জেলার অধিবাসী এবং কলকাতা অবস্থানকারী ইবনে আহমদের কন্যা জিনাতুন্নেসা বেগমেকে বিয়ে করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন পিছু ছাড়েনি। দ্বিতীয় স্ত্রী জিনাতুন্নেসাও নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন। পরবর্তী সময়ে, ১৯৪৩ সালে এ. কে. ফজলুল হক মীরাটের খাদিজা নামক এক মহিলার সাথে বিবাহ করেন। তাদের সংসারে এক সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল, যার নাম এ. কে. ফাইজুল হক, তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পাট প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু ২০০৭ তাঁর ইন্তেকাল ঘটে।
কর্মজীবন, Career
১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করার পর এ. কে. ফজলুল হক স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করেন । সেখানে তিনি দু’বছর শিখানবিশ হিসেবে কাজ করেন, তারপর তিনি সরাসরি আইন ব্যবসার কাজ শুরু করেন ১৯০০ সালে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯০১ সালে তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটলে তিনি বরিশালে ফিরে আসেন এবং বরিশাল আদালতে যোগ দেন।
সেখানে কর্মরত থাকাকালীন হক ১৯০৩ – ১৯০৪ সালে বরিশাল বার এসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। সেসময়ই বরিশাল রাজচন্দ্র কলেজের হককে অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করার জন্য অধ্যক্ষ ডক্টর হরেন্দ্রনাথ মুখার্জির অনুরোধ করেন, হক সেই কলেজে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন।
এরপর ১৯০৬ সালে ফজলুল হক আইন ব্যবসা ছেড়ে সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। পূর্ব-বাংলার তৎকালীন গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাঁকে সম্মানের সাথে নিয়োগ করেন। সেখানে ঢাকা ও ময়মনসিংহে কিছুদিন কাজ করার পর তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছিল জামালপুর মহকুমার এস.ডি.ও হিসেবে।
সেখানে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। কিন্তু ফজলুল হকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেই দাঙ্গা বন্ধ হয়। ১৯০৮ সালে তিনি এস.ডি.ও –এর পদ ত্যাগ করে সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন, কিন্তু কালক্রমে সরকারের সাথে বনিবনা না হওয়ার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই তাঁকে চাকুরি ছেড়ে দিতে হয়। ১৯১১ সালে এ. কে. ফজলুল হক আবার কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন।
সাহিত্য সম্পাদনা, Literary editing
বরিশালে থাকাকালীন এ. কে. ফজলুল হকের সান্নিধ্য ঘটে শিল্প সাহিত্যের সাথে। তিনি নিজের সম্পাদনায় কিশোর-কিশোরীদের উদ্দেশ্যে বালক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর তিনি যুগ্ম সম্পাদনায় আরেকটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা ‘ভারত সুহৃদ’ নামে প্রকাশ করেন।
সে সময়কালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় নবযুগ পত্রিকা, যার সম্পাদক পদে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ফজলুল হক প্রখ্যাত বামপন্থি রাজনীতিবিদ মুজফ্ফর আহ্মদের প্রস্তাবে নবযুগের প্রকাশনাতে সাহায্য করেছিলেন। তখন নজরুলের বিদ্রোহী লেখাগুলোর কারণে নবযুগ প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হতে লাগল।
কলকাতার টিউনন নামক এক ইংরেজ বিচারপতি নিজের কাছে ডেকে নিয়ে ফজলুল হককে ব্রিটিশ সরকার বিরুদ্ধে লেখার জন্য হুঁশিয়ার করেন, কিন্তু ফজলুল হক নির্ভয়ে টিউননের কাছ থেকে ফিরে নজরুলকে বলেন, “আরো গরম লিখে যাও, ইংরেজ সাহেবদের টনক নাড়িয়ে দাও”।
ব্রিটিশ সরকার নজরুল লেখা চালিয়ে যাওয়ায় নবযুগ পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করে কাগজটি বন্ধ করে দেয়। হকের চেষ্টায় পরবর্তী সময়ে আবার নবযুগ চালু হলেও, তিক্ত হয়ে নজরুল নবযুগের কাজ ছেড়ে দেন। পত্রিকার কাজ ছাড়াও এ.কে. ফজলুল হক ‘বেঙ্গল টুডে’ নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন।
ব্রিটিশ আমলে এ. কে. ফজলুল হকের রাজনৈতিক কার্যকলাপ, K. Political activities of Fazlul Haque during British rule
বরিশাল পৌরসভা নির্বাচন:
বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান অশ্বিনীকুমার দত্ত কমিশনার পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য ফজলুল হককে আহবান জানান। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে হক পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্ব্ব্বিতা করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে কমিশনার হিসেবে নির্বাচিত হন। এভাবেই রাজনীতিতে এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বের সূত্রপাত ঘটে।
বঙ্গীয় আইন পরিষদ:
ফজলুল হক ১৯১৩ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৩৯ বছর। হক পুনরায় ঢাকা বিভাগে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ১৯১৫ সালে। এরপর তাঁর অদম্য চেষ্টায় ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারমাইকেল ও টেইলার হোস্টেল স্থাপিত হয়। হকের শিক্ষা বিষয়ে উদ্যোগের প্রশংসা করে তৎকালীন শিক্ষা বিভাগের ডি.পি.আই কর্ণেল সাহেব তাঁকে বাংলার “বেন্থাম” নামে আখ্যায়িত করেন।
নিখিল ভারত মুসলিম লীগ
বাংলার জনগণ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়লে, নবাব সলিমুল্লাহ এই বিষয় নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স- এর আহ্বান জানান। সেই সম্মেলনে একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ নিজে এবং সেই কমিটির যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান নবাব ভিকারুল মুলক ও এ. কে. ফজলুল হক।
উক্ত সম্মেলনে নবাব সলিমুল্লাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন এবং সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলন ১৯১৮ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ফজলুল হক সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে বাঙালিদের মধ্যে একমাত্র তিনিই সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৯ সালে ফজলুল হক নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট পদে উন্নীত হন।
নিখিল ভারত কংগ্রেস
১৯১৪ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস দলে যোগ দিয়ে ফজলুল হক একসাথে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলের নেতা হয়ে যান। কয়েকবছর পর ১৯১৮ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি জেনারেল পদে নির্বাচিত হন।
বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, Education Minister of Bengal
গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর, ১৯২২ সালে ফজলুল হক খুলনা জেলার উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন। এর দুবছর পর ১৯২৪ সালে তিনি খুলনা অঞ্চল থেকে পুনরায় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন, এমন সময়ে তৎকালীন বাংলার গভর্নর লিটন হককে বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে স্বরাজ্য পার্টি ১৯২৪ সালের বাজেটের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করলে সেই সালের ১ আগস্ট হক মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন।
ম্যাকডোনাল্ডের গোলটেবিল বৈঠক, McDonald’s Round Table Meeting
ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্ধারণের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড এক গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গান্ধীজী বৈঠকটি প্রত্যাখান করেন। কিন্তু, সেই বৈঠকে মুসলিম লীগ অংশগ্রহণ করেছিল ।
১৯৩০ – ১৯৩১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে ফজলুল হক বাংলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন এবং স্বতন্ত্র নির্বাচনের পক্ষে বক্তৃতা দেন। ১৯৩১- ১৯৩২ সালের দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসও যোগ দেয়। কিন্তু বৈঠকে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের সমাধান না হওয়ার কারণে ভারতের শাসনতন্ত্রের দায়িত্ব ব্রিটিশের হাতে চলে যায় ।
মেয়র নির্বাচন, Mayoral election
১৯৩৫ সালে ফজলুল হক কলকাতার মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচিত হন। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র ছিলেন তিনি।
বাংলার প্রধানমন্ত্রী, Bengal Prime Minister
শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ১৯৩৭ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পান। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশি জোর দিয়েছিলেন ।
তাঁর শাসনে তিনি দরিদ্র কৃষকের উপরে কর ধার্য না করে ‘বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ’-এর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এরপর তাঁর চেষ্টায় ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস হলে জমিদারদের লাগামহীন অত্যাচার চিরকালের জন্য বন্ধ হয়। পরবর্তীতে তিনি কৃষি আধুনিকীকণের জন্য ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনার দৌলতপুরে কৃষি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।
পাকিস্তান আমলে রাজনীতি, Politics during Pakistan
হক সাহেব দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান গঠিত হবার পর থেকে পুনরায় ঢাকা হাইকোর্টে পুনরায় আইন ব্যবসায় যোগদান করেছিলেন। সেখানে তিনি বারের প্রথম সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তারপর পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ১৯৫১ সালে নিযুক্ত হন তিনি এবং এই পদে কর্মরত ছিলেন ১৯৫৩ সাল অবধি। পরবর্তী সময়ে ফজলুল হক ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকেও সমর্থন করেন।
অবসর প্রাপ্তি, Retirement
১৯৫৮ এর ২৭ অক্টোবরে ফজলুল হককে পাকিস্তান কর্তৃক “হেলাল-ই-পাকিস্তান” খেতাব দেওয়া হয়। ১৯৬১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ হককে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। এই সংবর্ধনা সভার পর থেকে তিনি আর কোনও জনসভায় যোগদান করেননি।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী, Death anniversary of Fazlul Haq
১৯৬২ সালে হক শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অসুস্থতার কারণে ২৭ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয় তাঁকে। তিনি সেখানে প্রায় একমাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে এ. কে. ফজলুল হক মৃত্যু বরণ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
একই স্থানে তাঁর কবরের পাশাপাশি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের কবর রয়েছে। তাদের তিনজনের সমাধিস্থলই ঐতিহাসিক তিন নেতার মাজার নামে পরিচিত। সেদিন রেডিও পাকিস্তান তাদের সব অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করে সারাদিন কোরআন পাঠ করে। এছাড়াও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে তাঁর প্রতি সম্মান দেখানো হয়। এরপর ৩০ এপ্রিল সোমবার পাকিস্তানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্কুল কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়।
সম্মাননা, awards and recognition
ফজলুল হকের মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয় তাঁকে সম্মাননা প্রদানের উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের পূর্বনাম ‘জিন্নাহ হল’ পরিবর্তন করে তাঁর নামে করা হয়। কুয়েতেও তাঁর নামে একটি ছাত্র আবাসিক হল রয়েছে। তাঁর নামে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র আবাসিক হল রয়েছে তাঁর নামে।
ফজলুল হকের নামে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৮ সালে এবং এটি তৎকালীন পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রথম কৃষিশিক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ছিল।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক নিজেই এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এছাড়া এই শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি হল ও রয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তাঁর নামে একটি এলাকার নাম রাখা হয় শের-এ-বাংলা নগর, যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ অবস্থিত। ঢাকার মিরপুর স্থিত জাতীয় ক্রিকেট মাঠ শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম বাংলাদেশের হোম অব ক্রিকেট হিসেবে খ্যাত। বরিশালে তাঁর নামে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের নামকরণ করা হয়েছে। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল দক্ষিণবঙ্গের বিশিষ্ট চিকিৎসা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল।
উপসংহার, Conclusion
এ কে ফজলুল হক ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে অত্যন্ত সরল ছিলেন। জীবদ্দশায় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল মানুষ তাঁর উদার ও দানশীল স্বভাবের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করত। পাকিস্তানে এ. কে. ফজলুল হককে দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রনায়কদের একজন হিসাবে স্মরণ করা হয়। অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীর উন্নতি, বিশাল কৃষক জনগণের দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং তাঁর উদার প্রকৃতি তথা আন্তরিক প্রচেষ্টার জন্য আজও বাংলার মানুষ আবুল কাশেম ফজলুল হককে স্মরণ করে।
Frequently asked questions:
আবুল কাশেম ফজলুল হক ছিলেন একজন বাঙালি আইনজীবী, লেখক এবং সংসদ সদস্য।
১৮৭৩ সালে।
১৯৩৭ সালে।
বেঙ্গল টুডে।
১৯৬২ সালে।