ভারতীয় অভিনেতা, নাট্যকার, কর্মী এবং পরিচালক ছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলেজ জীবনেই নাটকের সূত্রপাত ঘটেছিল ঠিকই, পাশাপাশি সেই সময় তাঁর চিন্তার অনেকটাই দখল করে নিয়েছে রাজনীতিও।
পরিচয় ছিল জ্যোতি বসুর সাথেও। তবে শিল্প জগতের তাঁর অবদানের কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে, তিনি শম্ভু মিত্র এবং উৎপল দত্তের পরবর্তী যুগের আধুনিকতার নতুন ভগীরথ অজিতেশ ৷ অভিনয় শিল্পের প্রায় প্রতিটি মাধ্যমেই কাজ করেছিলেন তিনি। বিশেষত বাংলা চলচ্চিত্রের খলনায়ক চরিত্রগুলির মাধ্যমে তারকা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আজ এই বিশিষ্ট ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম জীবন, early life of Ajitesh Bandopadhyay
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। তাঁর জন্ম হয় বর্তমান পুরুলিয়া (তৎকালীন মানভূম) জেলার জয়পুর ব্লকের রোপো গ্রামে তাঁর মামার বাড়িতে। অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার রাণীগঞ্জ অঞ্চলের অন্তর্গত কেন্দা গ্রামে তাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবার নাম ছিল ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার নাম লক্ষ্মীরাণী৷
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব স্মৃতি, childhood
ছোট্ট অজিতেশের বাবা কোলিয়ারিতে কাজ করতেন, তখন তাদের বাস ছিল আসানসোল শিল্পাঞ্চলের রামনগরে। অজিত একটু বড় হতেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সময়টা ছিল ১৯৪২ সাল। তখন তাঁর বয়স ছিল নয় বছর। জাপানি বোমার ভয়ে পিতা ভুবনমোহন ছেলেকে পুরুলিয়ার ঝালদায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সেখানে থাকাকালীন অজিত তিনটি বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। তিনি প্রেমে পড়ে গেলেন — ফুটবল, রাজনীতি এবং থিয়েটারের। প্রথমটির ঘোর অল্প কিছুদিনের দিনের মধ্যেই কেটে গিয়েছিল, দ্বিতীয়টিকে গান্ধীজির লেখা প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু একসময় কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন তিনি। তারপর বেশ কিছু কাল সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। তবে থিয়েটারের নেশা কখনো ছাড়েনি তাঁকে। এর মগ্নতা তিনি আমৃত্যু কাটাতে পারেননি।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা, education
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রামনগরের কুলটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি অবধি পড়াশুনা করেন। তিনি অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর পিতা ভুবনমোহন বদলি হয়ে গেলেন ঝরিয়ার কাছেই অবস্থিত চাসনালায়। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে অজিতেশ স্নাতক শিক্ষা অর্জন করেন কলকাতার মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজ থেকে। উক্ত কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে ইংরেজি ভাষায় অনার্স সহ পাশ করেছিলেন তিনি। এরপর সেই বছরেই তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দিয়েছিলেন।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মজীবনের প্রাথমিক সময়, Early career
বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরুণ বয়সে উপার্জন বলতে ছিল কিছু টিউশনি। অন্যদিকে গল্প লিখে একটি পত্রিকা থেকে কিছু রোজগার করতেন তিনি। সেই প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যেও অজিতেশের অভিনয়ের খিদে ছিল আকণ্ঠ। তাইতো ক্রমে রচনা করতে শুরু করেছিলেন নাটক। তবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ইংরেজির স্নাতক অজিতেশ পড়াশুনা শেষে বাগুইআটির হিন্দু বিদ্যাপীঠে শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দেন।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাট্য অবদান, Dramatic contribution by Ajitesh Banerjee
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্রজীবন থেকেই নাটক রচনা ও অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। পাশাপাশি তিনি কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য ছিলেন। বাগুইআটির হিন্দু বিদ্যাপীঠের ইংরেজির শিক্ষক, পার্টি কর্মী, তথা গণনাট্য সঙ্ঘ পাতিপুকুর শাখার শিল্পী অজিতেশকে তখন সকলেই এক ডাকে চেনে। যখন তিনি দমদম আঞ্চলিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন, তারপর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর গণনাট্য সঙ্ঘের চারটি শাখাকে মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা তৈরি করার দায়িত্ব পড়ে।
তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হল ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’। এরপর থেকে মূলত থিয়েটারকে আঁকড়ে ধারাবাহিক ভাবে সঙ্ঘের কাজ করেছিলেন তিনি। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ পাঁচ বছরে তিনি ৯টি নাটকের নির্দেশনা তথা অভিনয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি লিখেছিলেন মৌলিক পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘সংঘাত’। এর ২ বছর পর ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দেন তিনি।
উক্ত সংঘে তিনি ১৫টি নাটকে অংশ নিয়েছিলেন। তারপর, ১৯৬০ সালে ২৯ শে জুন ‘নান্দীকার’ নামক নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রায় ৪০টি নাটকের নির্দেশনা করেন, এছাড়া অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। নান্দীকারের সাথে যুক্ত থাকাকালীন সময়ে, অজিতেশের সাথে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত , অসিত বন্দোপাধ্যায় এবং কেয়া চক্রবর্তী, বেশকিছু সফল নাটক মঞ্চস্থ ও পরিবেশন করেছিলেন।
“তিন পয়সার পালা’ নাটকের নির্দেশনার কাজ ও সঙ্গীত পরিচালনার জন্য প্রভূত সুনাম অর্জন করেন তিনি। ‘ভালমানুষের পাল’ এবং ‘শের আফগান’ এর মতো নাটকগুলি শ্রোতাদের আকর্ষণ করার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছিল। এছাড়াও সেতু বন্ধন, সওদাগরের নৌকা প্রমুখ নাটকও তাঁর রচিত। ১৯৭৭-এ কিছু সাংগঠনিক কারণে নিজের তৈরি করা দল নান্দীকার ছেড়ে বেরিয়ে যান অজিতেশ। একই সালে অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ‘ নান্দীমুখ ‘ নামে এক নতুন নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এই গোষ্ঠীর বিখ্যাত নাটক হল ‘পাপপুণ্য’।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত চলচ্চিত্র, Movies acted by Ajitesh bandyopadhyay
১৯৬৫ সালে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় “ছুটি” নামক চলচ্চিত্রে প্রথমবার অভিনয় করেন। অভিনয় জীবনে বাংলা ও হিন্দি উভয় চলচ্চিত্রেই অভিনয় করেন তিনি। সব মিলিয়ে মোট ৬৩টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তপন সিংহ পরিচালিত “হাটে বাজারে” সিনেমায় অভিনয় করে সকলের নজর কেড়েছিলেন তিনি।
উক্ত ছবিতে বিরোধী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি নিজের শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন যে তাঁর অভিনয় তরুণদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর থেকে তাঁর সততা এবং নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়।
রূপালী পর্দায় একজন চরিত্র-অভিনেতা হিসাবে ‘অতিথি’ , ‘কুহেলি এবং গণদেবতা’ , ‘আজ কাল পরশুর গল্প’ , ‘মেঘ ও রৌদ্র’ , ‘থাগিনি’ , ‘নিধিরাম সরদার’ , ‘হিরে মানিক’ – এর মতো ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি, যা তাঁকে দর্শকদের মধ্যে আরো জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ‘কপালকুণ্ডলা’ ও ‘সমঝোতা(হিন্দি)’ তে অভিনয় তাঁকে মঞ্চ ও পর্দার একজন শক্তিশালী অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। অন্যদিকে বেতার-নাটক তথা যাত্রার সাথেও তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু, death of Ajitesh Bandopadhyay
১৯৮৩ সালের ১৩ অক্টোবর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কলকাতায় মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মৃত্যু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিকভাবে হয়েছিল, তাঁর মৃত্যু বাংলার বুক থেকে এক অন্যন্য প্রতিভার দীপকে চিরকালের মতো নিভিয়ে দেয়।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত পুরস্কার ও স্বীকৃতি, awards and recognition
নিজের পরিচালনামূলক উদ্যোগ এবং থিয়েটারে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে, বাংলা অভিনয় জগতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭৬ সালে ৪২ বছর বয়সে সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি উক্ত জাতীয় মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের সর্বকনিষ্ঠ প্রাপকদের মধ্যে একজন। ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে, তাঁকে “বর্তমান সময়ে বেঙ্গল থিয়েটারের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনয়শিল্পী” হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
শেষ কথা, Conclusion
অজিতেশের শিল্পীসত্তার বিস্তার ছিল বটবৃক্ষের মতো, ফলে কোনও একটা শিল্পমাধ্যমে তিনি নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাবেন, এমনটা কিছুতেই সম্ভব হত না। থিয়েটারে, সিনেমায়, যাত্রায়— অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পীসত্তা কোনও একটা পরিধিতে আবদ্ধ নয়।
বাংলা থিয়েটারকে বিশ্বমঞ্চে মিলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যিনি নিয়েছিলেন, তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় যে বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, অসময়ে চলে গিয়ে সেই বাংলা নাটককেই তিনি রিক্ত করে গেলেন দুর্ভাগা দর্শকের সামনে।
Frequently Asked Questions
১৯৩৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।
১৯৮৩ সালের ১৩ অক্টোবর।
সংঘাত।