একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে
থাকবে না সাথে কোনো ছাতা
শুধু দেখা হয়ে যাবে মাঝ রাস্তায়
ভিজে যাবে চটি, জামা, মাথা
থাকবে না রাস্তায় গাড়িঘোড়া
দোকানপাট সব বন্ধ, শুধু তোমার আমার হৃদয়ে ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ…—হাজারবার শোনা এই গান বার বার শুনতে চাই আমরা, কারণ কোথাও না কোথাও আমাদের নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে যায় এইসব গানের বোল। অঞ্জন দত্তের এই গানগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তাইতো আজ তাঁর জনপ্রিয়তা এতটা উর্ধ্বে।
গায়ক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হল ‘2441139’। কিন্তু তিনি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিলেন শুধুমাত্র অভিনেতা হতে, কিন্তু ক্রমে খ্যাতি পেলেন সুরে-গানে। তারপর ধরা পরিচালনা। কেমন ছিল তাঁর সেই যাত্রাটা? অঞ্জন দত্তের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তুলে ধরবো আজকের এই প্রতিবেদনে।
প্রথম জীবনে অঞ্জন দত্ত, early life of Anjan Dutta
অঞ্জন দত্তের জন্ম হয় ১৯৫৩ সালের ১৯ জানুয়ারি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তবে নিজের ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময় তিনি দার্জিলিঙয়ে কাটিয়েছেন। মূলত পড়াশুনার জন্যই তাঁর দার্জিলিংয়ে যাওয়া। বেশ কিছু বছর সেখানে কাটিয়ে তৈরি করেছিলেন বহু স্মৃতি, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
অঞ্জন দত্তের শিক্ষাগত যোগ্যতা, Anjan Dutta education
অঞ্জন দত্ত দার্জিলিং এর সেইন্ট পল’স স্কুলে নিজের শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পারিবারিক কারণে তিনি স্কুলজীবনের মধ্য সময়েই কলকাতা চলে আসেন এবং সেখানেই নিজের শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি কলকাতার আশুতোষ কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশুনাও সম্পন্ন করেছিলেন।
কর্মজীবনের প্রাথমিক সময়, Early career
অঞ্জন দত্ত কাজের তথা টাকার অভাবে বেশ কিছুদিন কলকাতা ভিত্তিক “দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান” পত্রিকায় কাজ করেছিলেন, অর্থাৎ কর্মজীবনের প্রাথমিক সময়ে তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন।
অঞ্জন দত্তের অভিনয় জীবন, Anjan Dutta’s acting career
অঞ্জন দত্ত প্রাথমিক সময়ে থিয়েটারের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর নিজস্ব থিয়েটারের দল ছিল যার নাম ‘ ওপেন থিয়েটার ‘, আর এই থিয়েটারের মাধ্যমেই সিনেমাতে কাজ করার সুযোগ পান। তিনি বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। তিনি ১৯৮১ সাল থেকে সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন।
তিনি প্রথম অভিনয় করেন মৃণাল সেনের পরিচালিত ‘চালচিত্র’তে। উক্ত ছবিতে তাঁর অভিনয়ের জন্য তিনি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা নবাগত অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। বেশ কয়েকবছর অভিনয় করার পর ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি সিনেমা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তাঁর অভিনীত সিনেমার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ‘একদিন অচানক’, ‘যুগান্ত’, ‘অন্তরীণ’, ‘নির্বাক’, ‘জানি দেখা হবে’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘দেখা’, ‘মিস্টার এন্ড মিসেস আইয়ার’ ইত্যাদি।
অঞ্জন দত্ত’র ব্যক্তিগত জীবন, personal life of Anjan Dutta
অঞ্জন দত্তের দাম্পত্য জীবনের সঙ্গী হলে ছন্দা দত্ত। এই দম্পতির সংসারে একটি ছেলে রয়েছে, যার নাম- নীল দত্ত , যিনি বর্তমানে ভারতীয় শিল্পের একজন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
অঞ্জন দত্ত’র গাওয়া গানের এ্যালবাম, Music album of Anjan Dutta
শুধু অভিনয় বা চলচ্চিত্র পরিচালকের কাজই নয়, বরং অঞ্জন দত্ত গানের দুনিয়াতেও নিজের ছাপ রেখেছেন। বব ডিলানের সঙ্গীত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি, সেই প্রভাবের তাড়নায় মুক্তি পায় তাঁর বেশ কিছু গানের অ্যালবাম। অন্যদিকে নিজের পরিচালিত বেশ কিছু ছবিতে গান গেয়েছেন তিনি।
তাঁর গান এর সহজবোধ্যতা সবাই কে আকৃষ্ট করে। বাঙালি মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন দিনযাপন, প্রেম, বিরহ আর স্মৃতিকাতরতা সবকিছুকেই যেন এক কাহিনির মোড়কে গানের পর গানে বলে গেছেন অঞ্জন দত্ত। ‘বেলা বোস’ এবং ‘রঞ্জনা আমি আর আসবোনা’ গানগুলো হল তাঁর গাওয়া অন্যতম জনপ্রিয় গান।
অঞ্জন দত্ত’র গানের তালিকা, Anjan Dutta’s list of songs
- শুনতে কি চাও? – ১৯৯৪
- পুরোনো গিটার -১৯৯৫
- ভালবাসি তোমায় – ১৯৯৬
- কেউ গান গায় – ১৯৯৭
- প্রিয় বন্ধু (বাংলাদেশে “গানে গানে ভালবাসা” শিরোনামে মুক্তিপ্রাপ্ত; অঞ্জন দত্ত, নিমা রহমান ও পরশপাথর) – ১৯৯৮
- চলো বদলাই – ১৯৯৮
- হ্যালো বাংলাদেশ – ১৯৯৯
- কলকাতা-১৬ – ১৯৯৯
- বান্দ্রা ব্লুজ (ইংরেজি এ্যালবাম) – ২০০০
- অসময় – ২০০০
- রং পেন্সিল – ২০০১
- অনেকদিন পর (অঞ্জন দত্ত ও কবির সুমন) – ২০০৪
- ইচ্ছে করেই একসাথে (অঞ্জন দত্ত ও বাপ্পা মজুমদার) – ২০০৫
- দ্য বং কানেকশন (ছায়াছবির গান) – ২০০৭
- আমি আর গদদ (নীল দত্ত ও অঞ্জন দত্ত) – ২০০৭
- আবার পথে দেখা (অঞ্জন দত্ত, বাপ্পা মজুমদার ও এস, আই টুটুল) – ২০০৭
- ঊনষাট -২০১৪
অঞ্জন দত্তের পরিচালক হিসেবে কাজ, Anjan Dutta’s career as a director
অঞ্জন দত্ত বেশ কিছু সিনেমার পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : ‘দ্য বং কানেকশন’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’, ‘চলো…লেট’স গো’, ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’, ‘ম্যাডলি বাঙালি’, ‘শেষ বলে কিছু নেই’, সহ ব্যোমকেশ সিরিজের বেশ কিছু সিনেমা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি পরিচালনা বা গান কোনওটাই করতে চাইনি।
অভিনয় করতে চেয়েছিলাম। যখন বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ আমি আমার কাঙ্খিত জায়গাটায় পৌঁছতে পারছি না, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম পেশা বদলাব। অভিনয় করব না তাহলে পরিচালনাই করব। কিন্তু হঠাৎ করে তো পরিচালনায় যাওয়া যায় না। তার মাঝখানে আমি গান গাইলাম। কিন্তু সেই গানটাই এতটা জনপ্রিয়তা পেয়ে যাবে বুঝিনি।”
নির্মাতা হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া নিয়ে তিনি আরো বলেন যে, “গান দিয়ে আমি প্রথম জনপ্রিয়তা পেলাম, শ্রোতা পেলাম। সেটাই আমায় পরিচালনায় সাহায্য করল। আমার গানের শ্রোতাই আমার সিনেমার দর্শক।” রুপোলি পর্দার পাশাপাশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্যও ওয়েব সিরিজ তৈরির ক্ষেত্রেও কাজ করছেন অঞ্জন দত্ত।
অঞ্জন দত্ত পরিচালিত ছবির তালিকা, List of movies directed by Anjan Dutta
- বড়দিন – ১৯৯৮
- বো ব্যারাকস ফরএভার – ২০০৪
- কলকাতা – ২০০৫
- চৌরাস্তা ক্রসরোডস অফ লাভ – ২০০৯
- ব্যোমকেশ বক্সী – ২০১০
- আবার ব্যোমকেশ – ২০১২
- দত্ত ভার্সেস দত্ত – ২০১২
- গণেশ টকিস – ২১ জুন, ২০১৩
- ব্যোমকেশ- ২০১৫
- ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা – ২০১৬
- হেমন্ত – ২০১৬
- ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ – ২০১৭
অঞ্জন দত্তের প্রাপ্ত পুরস্কার সমূহ, Anjan Dutta awards and recognition
কর্মজীবনে চলচ্চিত্র জগতে অশেষ অবদান রাখার পরিপ্রেক্ষিতে অঞ্জন দত্ত বেশ কিছু পুরস্কারের অধিকারী হয়েছেন। অভিনেতা এবং নির্মাতা, উভয় ক্ষেত্রেই নিজের কাজের জন্য তিনি সম্মানিত হয়েছেন বিশেষ কিছু পুরস্কার দ্বারা, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :
- 1981 – ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চলচিত্র চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার
- 1981 – ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
- আলিতালিয়া পুরস্কার (1981)
- বস্কো ডি’আমোর (1981) এর জন্য রোডলফো বিগোত্তির সাথে জুটি বেঁধেছেন সেরা অভিনেতা
- 2012 – জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার – রঞ্জনা অমি আর আশবোনার জন্য বিশেষ জুরি পুরস্কার
- 2019 – মনোনীতদের জন্য WBFJA-এ অবশেষে ভালোবাসার সেরা গান।
অঞ্জন দত্তের গানের অনুরাগীর সংখ্যা অসংখ্য থাকলেও, সমালোচকদের সংখ্যাও কম নেই। অনেকেই মনে করেন যে অঞ্জন দত্ত’র বিভিন্ন গানের সুর প্রায় একইরকম হয়, একই সুর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি বিভিন্ন গানে ব্যবহার করেন। আবার অনেকের মতে, তাঁর গানের কথা খুব হাল্কা ধরনের, এছাড়া তার গানের সুরে অনেক ক্ষেত্রেই সিমন এবং গারফাঙ্কল, বব ডিলান প্রমুখ গায়কের গানের সুরের অনুসরণ লক্ষ্য করা যায়।
উপসংহার, Conclusion
অভিনয়, গান থেকে সিনেমার পরিচালনা, সবক্ষেত্রেই এক অন্যতম চর্চিত একটি নাম হল অঞ্জন দত্ত। এপার বাংলা হোক কিংবা ওপার বাংলা, তাঁকে নিয়ে অনুরাগীরদের উৎসাহের কোনো অন্ত নেই। কলেজ জীবনে বেঞ্চ বাজিয়ে তাঁর গানের সুরে ঠোঁট মেলায়নি, এমনটা খুব কমই দেখা যায়। তবে শুধু গানে নয়, বরং অঞ্জন দত্তের সিনেমার ভক্তসংখ্যাও প্রচুর। বাঙালির হৃদয়ে তিনি এক আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন চিরকালের জন্য।
Frequently Asked Questions
১৯৫৩ সালের ১৯ জানুয়ারি।
চালচিত্র।
‘2441139’, ‘বেলা বোস’ এবং ‘রঞ্জনা আমি আর আসবোনা’ গানগুলো হল তাঁর গাওয়া অন্যতম জনপ্রিয় গান।