রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সাধারণত বেগম রোকেয়া নামে অধিক পরিচিত। তিনি একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। বহু বাধা পেরিয়ে তিনি নিজের জীবনে এগিয়ে এসেছিলেন এবং নিজের পাশাপাশি সমাজের নারীজাতিকে এগিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আজ এই মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জীবনের বিভিন্ন তথ্য এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
বেগম রোকেয়া কে ছিলেন ? Who was Begum Rokeya?
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে নারী অধিকারের একজন প্রবক্তা ছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি ক্যারিশম্যাটিক এবং স্থিতিস্থাপক নেতৃত্বের মাধ্যমে, সমাজের দ্বারা স্থাপন করা সমস্ত বাধা যা মহিলাদেরকে নিজের স্বপ্ন অনুসরণ করতে বাধা সৃষ্টি করছিল সেগুলোকে অস্বীকার করেছিলেন। তাই তিনি মুসলমান নারী জাগরণের কবি হিসেবে পরিচিত।
বেগম রোকেয়া বিখ্যাত কেন? Why was Begum Rokeya famous?
বেগম রোকেয়া ছিলেন বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন নির্বাচিত তিনি। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও শ্লেষাত্মক রচনার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার লেখার ধরন ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।
বেগম রোকেয়ার জন্ম, Birth of Begum Rokeya
রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর। তাঁর জন্ম হয় রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অর্ন্তগত পায়রাবন্দ গ্রামে।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর বাবার নাম কি? Rokeya Sakhawat Hossain’s father’s name
বেগম রোকেয়ার পিতা ছিলেন জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের, যিনি একজন শিক্ষিত জমিদার ছিলেন। তিনি নিজে আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি প্রমুখ ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল।
বেগম রোকেয়ার ভাই বোন কত জন? How many brothers and sisters of Begum Rokeya?
বেগম রোকেয়ার মাতা ছিলেন রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন ছিল, যাদের নাম করিমুননেসা ও হুমায়রা, এছাড়াও তাদের তিন ভাই ছিল, যাদের একজন শৈশবে মারা যায়, অন্যদের নাম আবুল আসাদ ইবরাহীম সাবের এবং খলিলুর রহমান আবু জাইগাম সাবের ।
বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, Begum Rokeya education
বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা তথা সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর বড় দু’ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল। তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় বাড়ির মেয়েদের গৃহের অর্গলমুক্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করার মত কোনো সুযোগ ছিল না।
কিন্তু পাঁচ বছর বয়সে নিজের মায়ের সঙ্গে কলকাতায় থাকাকালীন সময় একজন মেম শিক্ষয়িত্রীর থেকে তিনি কিছুদিন লেখাপড়া করার সুযোগ পান। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনদের ভ্রুকুটির কারণে তা বন্ধ করে দিতে হয়। তবে রোকেয়া কখনো দমে যাননি। তিনি বড় ভাই-বোনদের সমর্থন ও সহায়তায় বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি এবং আরবি প্রমুখ ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন।
শিক্ষা কিভাবে রোকেয়ার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছিল ? How did education change Rokeya’s life?
নিজের বড় ভাই ও বড় বোনের সহযোগিতায় বেগম রোকেয়া বাংলা ও ইংরেজি লিখতে ও পড়তে শিখেছিলেন। তিনি ক্রমে একজন লেখিকা হয়ে উঠেন। ১৯০৫ সালে তিনি নিজের ইংরেজি দক্ষতা অনুশীলন করার জন্য ‘সুলতানার স্বপ্ন’ শিরোনামে একটি অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর।
বেগম রোকেয়ার স্বামীর নাম কি ছিল? What was the name of Begum Rokey’s husband?
বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় ১৮৯৮ সালে, তিনি বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে করেন। রোকেয়ার স্বামী পেশায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তি। রোকেয়া তাঁর উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান।
এভাবে ক্রমশ তিনি ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। রোকেয়ার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত মূলত স্বামীর অনুপ্রেরণায় ঘটেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সাখাওয়াৎ হোসেন ১৯০৯ সালের ৩ মে মারা যান। অন্যদিকে তাঁদের দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে অকালেই মারা যায়।
বেগম রোকেয়ার প্রথম রচনা কি? What is Begum Rokeya’s first composition?
সাহিত্যিক হিসেবে বেগম রোকেয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯০২ সালে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘নভপ্রভা’ পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর লেখা “পিপাসা”।
ক্রমে বিভিন্ন সময়ে তাঁর রচনাগুলো নানা পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। ১৯০৫ সালে তাঁর লেখা প্রথম ইংরেজি রচনা “সুলতানাজ ড্রিম বা সুলতানার স্বপ্ন” মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। সবাই তাঁর এই রচনা খুব পছন্দ করে, সেই সুবাদে তিনি নিজেকে সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পান। উক্ত উপন্যাসকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়।
বেগম রোকেয়া কত সালে স্কুল প্রতিষ্ঠিত করেন? In which year did Begum Rokeya establish the school?
বেগম রোকেয়া স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ হয়ে যান, তখন তিনি নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। স্বামীর প্রদত্ত অর্থে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু পারিবারিক বিভিন্ন কারণে তিনি ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন।
কয়েকবছর পর, ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে নবপর্যায়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। সময়ের সাথে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ১৯১৬ সালের মধ্যে উক্ত স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা একশত পেরিয়ে যায়।
সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, Organizational activities
স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেই স্কুলের বিভিন্ন কার্যকলাপ পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বেগম রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রেখেছিলেন।
তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১৬ সালে। ১৯২৬ সালে বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলন কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তিনি সভাপতিত্ব করেন। বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে, ১৯৩০ সালে রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন, যা সেই সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলো এক দুঃসাহসিক কাজ।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্য কর্ম, Literary works of Begum Rokeya
‘ মতিচূর ‘ প্রবন্ধসংগ্রহের প্রথম (১৯০৪) ও দ্বিতীয় খণ্ডে (১৯২২) রোকেয়া নারীবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধবাসিনী (১৯৩১) ইত্যাদি ছিল তাঁর সৃজনশীল রচনা। তাঁর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি বেশিরভাগ সময়ই নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন।
এছাড়াও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে। রোকেয়া নিজের রচনাগুলোর মধ্য দিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, পাশাপাশি ধর্মের নামে নারীদের প্রতি হওয়া অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন। রোকেয়া তাঁর লেখায় অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থরাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন নিজের রচনাগুলোর মাধ্যমে। তিনি সেই যুগের একজন সাহসী সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত।
বেগম রোকেয়ার মৃত্যু, Death of Begum Rokeya
বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। উত্তর কলকাতার সোদপুরে তাঁকে কবর দেওয়া হয়, পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দু দে তাঁর কবরটি আবিষ্কার করেছিলেন।
বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র, Begum Rokeya Memorial Centre
বাংলাদেশ সরকার রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মরণে একটি গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। বাংলাদেশের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে নির্মিত হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। বর্তমানে বাংলা একাডেমি বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এর পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে ।
লেখিকার স্বীকৃতি, Recognition
- বাংলাদেশের ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ২০০৯ সালে ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে রোকেয়ার নামকে স্মরণীয় করে রাখতে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ করেন ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’।
- ১৯৬০-এর দশকে বেগম রোকেয়ার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীনিবাস ‘রোকেয়া হল’ খোলা হয়।
- খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মহীয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য আবাসিক হল “রোকেয়া হল” নামকরণ করা হয়।
- বেগম রোকেয়ার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
শেষ কথা, To conclude
বাঙালি নারীবাদী লেখিকা ও সমাজ সংস্কারক বেগম রোকেয়া নিজের সাহসিকতার মাধ্যমে সকলের মনে এক আলাদা স্থান দখল করে আছেন। তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা পায় বহু মানুষ। তাঁর চেষ্টায় আজ নারীগণ সমাজে এতটা এগিয়ে আসতে পেরেছেন।
Frequently Asked Questions
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর।
সুলতানাজ ড্রিম।
স্বামীর প্রদত্ত অর্থে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর তিনি পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু পারিবারিক বিভিন্ন কারণে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। কয়েকবছর পর, ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি কলকাতায় নবপর্যায়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।