এনি বেসান্তের জীবনী – Biography of Annie Besant in Bengali

এনি বেসান্তের জীবনী

নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী লেখিকা, বাগ্মী, তথা আইরিশ ও ভারতীয় স্বায়ত্ব শাসনের সমর্থক এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এনি বেসান্ত। এনি বেসান্তের জীবনকাহিনিতে তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে উল্লেখ করার মত বিষয় রয়েছে, যার সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন না। আজকের এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

এনি বেসান্তের জীবনী

এনি বেসান্তের জন্ম ও পরিবার পরিচয়, Birth and family identity

১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর এনি বেসান্তের জন্ম হয়। তিনি যুক্তরাজ্যের লণ্ডনের ক্ল্যাপহ্যামে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানকার এক মধ্যবিত্ত আইরিশ পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। ১৮৫২ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে, পিতাকে হারান এনি। সেই সময় তাঁর মা স্থানীয় এক স্কুলে ছেলেদের বোর্ডিং চালাতেন। কিন্তু তাঁর স্বল্প আয় হওয়ার ফলে এনির প্রতিপালন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। সেজন্য তিনি নিজের এক কাছের বন্ধু এলেন ম্যারিয়াতকে এনির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

এরপর মারিয়াতের কাছেই বেড়ে ওঠেন এনি বেসান্ত। পরবর্তীতে তিনি সেখানকার কিছু আইরিশ বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং একসময় রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন তিনি। এক্ষেত্রে বিশেষ করে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এনির ম্যানচেস্টারের বন্ধুরা। এই বন্ধুরা তাঁকে ইংরেজ মৌলবাদ এবং আইরিশ প্রজাতান্ত্রিক ফেনিয়ান ব্রাদারহহুডের ম্যানচেস্টার শহীদদের সংস্পর্শে আসতে সহায়তা করেন, পাশাপাশি শহরের দরিদ্র অবস্থার সাথে তাঁর পরিচয় করান।

এনি বেসান্তের জন্ম ও পরিবার পরিচয়

বৈবাহিক জীবন, Married Life

১৮৬৭ সালে এনি বেসান্ত কুড়ি বছর বয়সে, ওয়াল্টার বেসান্তের ছোট ভাই ২৬ বছর বয়সী পাদরী ফ্রাঙ্ক নামক একজন বিলাতি ধর্মপ্রচারক এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে তিনি ফ্রাঙ্ক লিংকনশায়ারের সিবসেতে যাজক হয়ে যান। স্বামী ফ্রাঙ্কের সাথে সংসারে তিনি দুটি সন্তানের জননী হন। তাদের নাম রাখা হয়ছিল আর্থার এবং মাবেল।

এনি বেসান্তের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, Various life experiences of Annie Besant

এনি বেসান্ত চিরাচরিত ধর্মমতের বিরোধী ছিলেন, যার ফলে স্বামীর সাথে তাঁর প্রায়ই মনোমালিন্য হতো, যা সময়ের সাথে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষ অবধি তাদের বিবাহ আর টেকেনি, ১৮৭৩ সালে এই দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। সেই সময়কালে তিনি ন্যাশনাল সেকুলার সোসাইটির (এনএসএস) একজন বক্তা ছিলেন এবং একজন বিশিষ্ট লেখক হিসেবেও বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। উক্ত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ সহয়ক ছিলেন চার্লস।

১৮৭৭ সালে এনি জন্ম নিয়ন্ত্রণ অভিযানকারী চার্লস নোল্টনের এক বই প্রকাশ করেন, যার কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। কিন্তু এক ক্ষেত্রে দেখতে গেলে এই বিতর্ক তাঁদেরকে বিখ্যাত করে তুলেছিল। পরবর্তীতে সেই সূত্র ধরেই এনি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। রাজনীতিতে এনির প্রসার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তিনি ১৮৮০ সালে ব্র্যাডলফ নর্থাম্পটনের এমপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

 এনি লীসেস্টারের হাম্বারস্টোন গেটে, ১৮৮১ সালের ৬ই মার্চ লীসেস্টার সেকুলার সোসাইটির নতুন সেক্যুলার হলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে বক্তৃতা দেন। সেই সময়কালে আইরিশ জাতীয়তাবাদীরা উদারপন্থী তথা মৌলবাদীদের সাথে মিলে একটি জোট গঠন করেছিলেন।

এনি বেসান্ত তখন ঐ আইরিশ হোম রুল আন্দোলনের নেতাদের সাথে গিয়ে কথাবার্তা বলেন, বিশেষ করে তিনি সেই ব্যক্তির সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন যিনি ভূমিযুদ্ধের মাধ্যমে জমিদারদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রাম করে আইরিশ কৃষককে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যবশত সেই ব্যক্তি অর্থাৎ মাইকেল ডেভিটের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। এনি পরবর্তী কয়েকটি দশক ধরে ডেভিট এবং তাঁর ল্যান্ড লীগের পক্ষে বেশ কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন প্রতিবেদনও লিখেছিলেন। ধীরে ধীরে এনি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় পুষ্ঠ ইউনিয়নের কাজকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন।

এনি বেসান্তের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা

‘রক্তাক্ত রবিবার’ এর ঘটনা, Incident of ‘Bloody Sunday’

  ১৮৮৭ সালে লন্ডনের কিছু বেকার তরুণ-তরুণী একসাথে মিলিত হয়ে ট্রাফালগার স্কয়ারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করে। ১৩ই নভেম্বরে এনি তাদের জনসভায় বক্তব্য রাখেন, এদিকে পুলিশ জমায়েতকে আটকানোর চেষ্টা করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তিতে তাদের আটকানোর জন্য সেনাবহিনীকে ডাকা হয়। সেনা সদস্যরা সেখানে এসে সন্ত্রাসী কায়দায় বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা করে দেয়, ফলে বহু মানুষ আহত হন, কিছু মানুষের মৃত্যুও হয়।

অবশিষ্ট যে বিক্ষোভকারীরা সেখানে রয়ে গিয়েছিল তাদের অধিকাংশকেই গ্রেপ্তার করা হয়। তখন এনি বেসান্ত নিজেই গ্রেফতার হওয়ার জন্য পুলিশের দিকে এগিয়ে যান, কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার না করে বরং তাঁকে নিরাপদে স্থান নিয়ে যায়। এই ঘটনাটি পরবর্তী সময়ে ‘রক্তাক্ত রবিবার’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিল। এনি বেসান্ত সেই ঘটনার জেরে আটক করে রাখা বন্দী এবং কারাগারে কর্মরত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে আইনি সহায়তার আয়োজন করেন এবং তাদের পরিবারের সমর্থন করার জন্য নিয়োজিত হয়েছিলেন।

লন্ডন দেশলাই কারখানা কর্মী ধর্মঘটের সমর্থন, Labour strike London Match factory

১৮৮৮ সালে লন্ডনে দেশলাই কারখানা কর্মী ধর্মঘটের ঘোষণা হয়। উক্ত দেশলাই কারখানায় কর্মীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল তরুণী। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ হওয়ার কারণে কারখানায় কর্মরত অনেকেই ফসফরাস-ঘটিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তখন সেই দেশলাই কর্মী তাদের এক ইউনিয়ন গড়ে তোলার জন্য বারোজ এবং এনি বেসান্তের সহায়তা চেয়েছিল। তাই এনি বেসান্তও এদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।

তৎকালীন সময়ে তিনি ফেবিয়ান সোসাইটি এবং এসডিএফ অর্থাৎ মার্কসবাদী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে একজন স্বনামধন্য বক্তা হিসেবে যথেষ্ট খ্যাত হয়ে ওঠেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি লন্ডন স্কুল বোর্ডে টাওয়ার হ্যামলেট্‌স এর জন্য নির্বাচিত হন। সেই সময়ে ভোটারদের ক্ষেত্রে অল্প সংখ্যক মহিলাই ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ভোট পর্বে শীর্ষস্থান লাভ করেন।

লন্ডন দেশলাই কারখানা কর্মী ধর্মঘটের সমর্থন

ব্রহ্মচর্চা, Brahmacharcha

একটা সময়ে এনি বেসান্ত বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে পরিচিত হন এবং  ক্রমশ ব্রহ্মচর্চার দিকে এগিয়ে যান। প্রথমে লন্ডনে বসবাসরত তথা সংগ্রামরত তরুণ আইরিশ লেখক জর্জ বার্নার্ড এবং ফেবিয়ান সোসাইটির সাথে ক্রমে এনি বেসান্তের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে ১৮৯০ সালে হেলেনা ব্লাভাৎস্কির সাথে দেখা হয় তাঁর। হেলেনার সংস্পর্শে এসেই এনির ব্রহ্মজ্ঞানের প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি হয়। একই সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে তাঁর আগ্রহ ক্রমশ কম হতে থাকে। অবশেষে তিনি ব্রহ্মজ্ঞানী সমাজের সদস্য হন এবং অচিরেই বক্তা হিসেবে সমাজে নিজের এক সম্মানজনক জায়গা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্রহ্মচর্চা সম্পর্কিত কাজের অংশ হিসাবেই ভারতে এসেছিলেন।

, Social Activities of Annie Besant

  • ১৮৯৮ সালে এনি ভারতে কেন্দ্রীয় হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিলেন।
  • ১৯০২ সালে তিনি আন্তর্জাতিক অর্ডার অফ কো-ফ্রীম্যাসোনারি প্রথম বিদেশী লজ লা ড্রোয়া হুমাঁ প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়াও পরবর্তী কয়েকটি বছরে ধরে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অংশে লজ স্থাপন করেন।
  • ১৯০৭ সালে তিনি ব্রহ্মজ্ঞানী সমাজের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তখন ব্রহ্মজ্ঞানী সমাজের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর ছিল মাদ্রাজের আদিয়ার।
  • ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এনি বেসান্ত ভারতে গণতন্ত্রের প্রচার করার উদ্দেশ্যে হোম রুল লীগ চালু করতে সহায়তা করেন। সেই সূত্রেই তিনি ভারতের তৎকালীন বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেসের সদস্য পদ লাভ করেছিলেন।
  • ১৯১৭ সালে কংগ্রেসের ৩৩তম অধিবেশন কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তিনি সেই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন।
  • ১৯২০ সালের শেষের দিকে, এনি বেসান্ত দত্তক পুত্র জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তিকে সাথে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন, এই দত্তক পুত্রকে তিনি নতুন মেসায়া এবং বুদ্ধের অবতার বলে দাবি করেতেন। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে কৃষ্ণমূর্তি উক্ত দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।
  • ১৯২৬ সালে এনি বেসান্ত ওরিয়েন্টাল সেমিনারী স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে এনি বেসান্ত ভারতীয় স্বাধীনতা জন্যও প্রচার চালিয়ে যান।
এনি বেসান্তের সামাজিক কার্যকলাপ

জীবনবসান, Death

শ্রদ্ধেয় এনি বেসান্ত ১৯৩৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন। তবে তিনি আমাদের মাঝে না থাকলেও তাঁর নীতি আদর্শ আজও অনেকে অনুসরণ করে থাকেন। 

উপসংহার, Conclusion 

 এনি বেসান্ত ছোট গল্প, শিশুদের জন্য বই, এবং নিবন্ধ লিখতেন। নিজের লেখার মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিভিন্ন সামাজিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তিনি বহু মানুষের সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আমাদের মধ্যে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর অবদান সর্বদাই তাঁকে অমর করে রাখবে।

এনি বেসান্তের জন্ম কবে হয়?

১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর

এনি বেসান্তের মৃত্যু কবে হয়?

১৯৩৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর

এনি বেসান্তের দত্তক পুত্রের নাম কি?

জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তি

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts