খুশবন্ত সিং এর জীবনী-Biography of Khushwant Singh in Bengali

খুশবন্ত সিং এর জীবনী

ভারতের বিখ্যাত রম্যলেখক ছিলেন খুশবন্ত সিং। অন্যদিকে তিনি ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিকদের মধ্যেও একজন। তিনি তৎকালীন সময়ে খ্যাতনামা সংবাদপত্র যোজনা’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ভারতের সংবাদপত্র ‘দ্য ন্যাশনাল হেরাল্ড’ ও ‘দ্য হিন্দুস্তান টাইমস’ও সম্পাদনা করেছেন। অন্যদিকে খুশবন্ত সিং ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল অবধি ভারতের লোকসভার সদস্যও ছিলেন।

খুশবন্ত সিং এর জীবনী

খুশবন্ত সিংয়ের  জন্ম ও পরিবার পরিচয়, Birth and family identity of Khushwant Singh 

খুশবন্ত সিং অবিভক্ত পাঞ্জাবের খুশাব জেলার হাদালিতে (যা বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত) একটি শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর উক্ত অঞ্চলটি পাকিস্তানের অধীনে চলে যায়। তিনি ছিলেন স্যার শোভা সিংয়ের ছোট ছেলে, যিনি পরে ভগত সিং এবং বীরান বাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তাঁর চাচা সর্দার উজ্জল সিং তৎকালীন সময়ে পাঞ্জাব এবং তামিলনাড়ুর গভর্নর ছিলেন।

শিক্ষা জীবন, Education 

 পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণকারী খুশবন্ত সিং মডার্ন স্কুল, নিউ দিল্লি, সেন্ট স্টিফেন কলেজে শিক্ষা লাভ করেন এবং পরবর্তীতে লাহোর সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯২০ সালে দিল্লীর মডার্ন স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৩০ সাল অবধি সেখানে অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩২ সাল অবধি দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট অফ আর্টস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।  এরপর ১৯৩২ সালে তিনি লাহোরের সরকারি কলেজে ভর্তি হন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। এরপর তিনি লন্ডনের কিংস কলেজ অধ্যয়ন করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। 

শিক্ষা জীবন, Education 

কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক, Career experiences 

আইন বিভাগে ডিগ্রি লাভের পর খুশবন্ত সিং ১৯৩৯ সালে লাহোরে মঞ্জুর কাদির এবং ইজাজ হোসেন বাটালভির চেম্বারে একজন অনুশীলনকারী আইনজীবী হিসাবে তার পেশাগত জীবন শুরু করেন। লাহোর কোর্টে তিনি আখতার আলি কুরেশি, অ্যাডভোকেট এবং রাজা মুহাম্মদ আরিফ, অ্যাডভোকেট সহ তার সেরা বন্ধু এবং ভক্তদের সাথে কাজ করেছিলেন। আইনজীবী হিসাবে আট বছর লাহোর হাইকোর্টে কাজ করার পর, তিনি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র পরিষেবায় যোগ দেন। তিনি কানাডার টরন্টোতে ভারত সরকারের তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং লন্ডন ও অটোয়াতে ভারতীয় হাইকমিশনের প্রেস অ্যাটাশে এবং পাবলিক অফিসার হিসেবে চার বছর কাজ করেন।

১৯৫১ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সাংবাদিক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং তারপর ১৯৫৬ সালে প্যারিসে ইউনেস্কোর কমিউনিকেশনস এর গণবিভাগের কাজে নিয়োজিত হয়ে যান। পরবর্তী সময়ে তিনি দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা ও সম্পাদনা করেন। উক্ত পত্রিকায় নয় বছর কাজ করার পর, ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

কিন্তু খুশবন্ত  সিং এর প্রস্থানের পর, সাপ্তাহিক পত্রিকাটির পাঠক সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে যায়। কর্মজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তাঁকে সাহিত্যিক হিসেবে কাজ শুরু করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। একজন লেখক হিসেবে, তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, হাস্যরস, কটাক্ষ এবং কবিতার প্রতি অবিচল ভালোবাসার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকার পাশাপাশি দুটি সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত সুপারিশে তিনি হিন্দুস্তান টাইমসের সম্পাদক হিসেবেও নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক

খুশবন্ত সিং এর লেখা গ্রন্থ, Books written by Khushwant Singh

খুশবন্ত সিং এর লেখার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল পাকিস্তান তথা ভারতের বিভিন্ন অংশেও। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ট্রেন টু পাকিস্তান, আই শ্যাল নট হিয়ার দ্য নাইটিঙ্গেল প্রভৃতি। খুশবন্ত সিং ৯৫ বছর বয়সে ‘দ্য সানসেট ক্লাব’ উপন্যাস লিখেছিলেন। এছাড়াও লিখেছিলেন একটি ননফিকশন দুইখণ্ডের রচনা, ‘অ্যা হিস্টরি অব দ্য শিখস’। এছাড়াও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে লেখা, অনুবাদ, উর্দু কবিতা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে সুখ্যাত এই লেখকের লেখার পরিমাণ প্রচুর। পরবর্তীতে ২০০২ সালে পেঙ্গুইন প্রকাশনা থেকে তাঁর আত্মজীবনী ‘ট্রুথ, লাভ অ্যান্ড এ লিটল ম্যালিস’ প্রকাশ করা হয়।

খুশবন্ত সিং এর প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা, Awards and Recognition

* কর্মজীবনের বিভিন্ন অংশে অবদান রাখার দরুন খুশবন্ত সিং কে জাতীয় স্তরের পুরস্কার তথা সম্মাননায় সম্মানিত করা হয়েছিল। তার প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :

*১৯৭৪ সালে খুশবন্ত সিং ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক অর্থাৎ পদ্মভূষণ উপাধি অর্জন করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্লু স্টার অপারেশনের যে অভিযান সংগঠিত হয় তার প্রতিবাদ স্বরূপ ১৯৮৪ সালে তিনি সেই পদ্মভূষণ ফিরিয়ে দেন। 

*২০০৭ সালে তিনি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক অর্থাৎ পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হন।

*ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমি কর্তৃক সাহিত্য আকাদেমি ফেলোশিপ।

*পাঞ্জাব সরকার প্রদত্ত ‘পাঞ্জাব রত্ন পুরস্কার, সুলভ্ ইন্টারন্যাশনালের ‘অনেস্ট ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ সম্মান।

*উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব কর্তৃক অল ইন্ডিয়া মাইনোরিটিজ ফোরাম অ্যানুয়াল ফেলোশিপ পুরস্কার।

*টাটা লিটারেচার লাইভের তরফ থেকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার।

*সেরা ফিকশনের জন্য ‘দ্য গ্রোভ প্রেস আওয়ার্ড।

খুশবন্ত সিং এর প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা

ব্যক্তিগত জীবন, Personal life

খুশবন্ত সিং বিয়ে করেছিলেন শৈশবের বন্ধু কানওয়াল মালিককে। তাদের বিয়ে হয়েছিল দিল্লিতে।  মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও তাদের বিবাহের অনুষ্ঠানে অংশ নেন।  পরবর্তী সময়ে এই দম্পতির একজন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয় যাদের নাম রাখা হয় রাহুল সিং (ছেলে) এবং মালা(মেয়ে)। খুশবন্ত সিং এর স্ত্রী ২০০১ সালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।  

ধর্মীয় বিশ্বাস তথা ধর্মনীতি, Religious belief of Khushwant Singh

খুশবন্ত সিং ছিলেন একজন স্ব-ঘোষিত অজ্ঞেয়বাদী, ২০১১ সালের তার লেখা অজ্ঞেয়বাদী শিরোনামের একটি বই প্রকাশিত হয় সেখানে কোনও ঈশ্বর সম্পর্কে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তিনি বিশেষভাবে যেকোনো সংগঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন। বলতে গেলে, তিনি স্পষ্টতই নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, “একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও সাধু ব্যক্তি হতে পারে এবং তাকে বিশ্বাস করে একজন ঘৃণ্য ব্যক্তিও খলনায়ক হয়ে উঠতে পারে।

আমার ব্যক্তিগত ধর্মে কোনো ঈশ্বর নেই!” তিনি একবার বলেছিলেন, ” আমি পুনর্জন্মে, স্বর্গ বা নরকে বিশ্বাস করি না। আমি মৃত্যুর চূড়ান্ততাকে মেনে নেই।”  এই বই প্রকাশের পর তিনি লেখার কাজ থেকেও অবসর নেন।  বইটিতে ধর্ম সম্পর্কে ক্রমাগত সমালোচনা ছিল এবং বিশেষ করে ভারতের ধর্ম বিশ্বাসের প্রসার তথা পাদ্রী এবং পুরোহিতদের নিয়েও সমালোচনা ছিল।  উক্ত বই ভারতীয় পাঠকদের মধ্যে অনেক প্রশংসা অর্জন করেছিল। একবার খুশবন্ত সিং বিতর্কিতভাবে দাবিও করেছিলেন যে শিখ ধর্ম “দাড়িওয়ালা হিন্দু ধর্ম” এর একটি রূপ।

খুশবন্ত সিংয়ের জিবনাবসান, Death of Khushwant Singh

 খুশবন্ত সিং ২০১৪ সালের ২০ মার্চ ইহলোক ত্যাগ করেন। বিখ্যাত এই ব্যক্তিত্ব ৯৯ বছর বয়সে দিল্লির নিজস্ব বাসভবনে স্বাভাবিক কারণে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর ভারতের রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সকলেই তাঁকে সম্মান জানান। একই দিন বিকেল ৪টায় দিল্লির লোধি শ্মশানে তাঁকে দাহ করা হয়। নিজের জীবদ্দশায়, খুশবন্ত সিং কবর দেওয়ার প্রতি আগ্রহী ছিলেন, এর কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে কবর দেওয়ার মাধ্যমে আমরা যা কিছুই নিয়েছি তা আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেব। অন্যদিকে খুশবন্ত সিং এর শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাঁর দেহাবশেষের কিছুটা ছাই হাদালিতে নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

খুশবন্ত সিংয়ের জিবনাবসান

উপসংহার, Conclusion 

খুশবন্ত সিং আজীবন ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেছেন। তাঁর কলমে বারবার ফুটে উঠেছে সমাজের- বাস্তবতার নগ্ন চিত্র, যার ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম। তাছাড়াও দেশভাগের সময়কালের তিক্ত অভিজ্ঞতাও নিজের কলমের আঁচড়ে জীবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি। অন্যদিকে তাঁর সমস্ত রচনাতেই সূক্ষ্ম হাস্যরসের ফল্গুধারা মিশে আছে। হাসিচ্ছলে তিনি কশাঘাত করেছেন সমাজের সমস্ত অন্যায়ের পিঠে। তিনি নিজের লেখা তথা দেশের প্রতি অবদান রাখার পরিপ্রেক্ষিতে সকলের কাছেই শ্রদ্ধেয়।

Frequently asked questions

খুশবন্ত সিং কে?

খুশবন্ত সিং একাধারে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক এবং ইতিহাসবিদ, অন্যদিকে ছিলেন ভারতের বিখ্যাত রম্যলেখক।

খুশবন্ত সিং কবে জন্ম গ্রহণ করেন?

১৯১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি।

খুশবন্ত সিং কবে মৃত্যু বরং করেন?

২০১৪ সালের ২০ মার্চ ইহলোক ত্যাগ করেন।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts