চুনী গোস্বামীর জীবনী, Biography of Chuni Goswami in Bengali

চুনী গোস্বামীর জীবনী

ফুটবল জগতের বাঙালি খেলোয়াড়দের মধ্যে চুনী গোস্বামী এক অন্যতম নাম। আজও ফুটবল ময়দানে তাঁর খেলার কৌশলের কথা মনে পড়লে অনেকেরই মন শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে। তিনি ভারতের জাতীয় দলের হয়েও বহুবার ফুটবল খেলেছেন। অন্যদিকে ক্রিকেটার হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন।

একসময় রনজি ট্রফিতে বাংলা ক্রিকেট দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। ফুটবল ময়দানে তাঁকে “ড্রিবলিংয়ের রাজা’ বলে সম্বোধন করা হয়।

চুনী গোস্বামীর প্রারম্ভিক জীবন, Early life of Chuni Goswami

চুনী গোস্বামীর জন্ম হয় ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি। তিনি বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আসল নাম হল সুবিমল গোস্বামী। শৈশবকালেই তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং পরবর্তিতে সেখানেই স্থায়ী হন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভাই মানিক গোস্বামীও ছিলেন একজন ফুটবলার, যিনি একসময় জর্জ টেলিগ্রাফের হয়েও খেলেছিলেন। 

চুনী গোস্বামীর প্রারম্ভিক জীবন

ক্রীড়া জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, Various experiences in sports life

সুখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় সুবিমল গোস্বামী ওরফে চুনি গোস্বামী বিভিন্ন সময়ে খেলায় নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। বহু খেলোয়াড়ের কাছে তিনি এক অনুপ্রেরণা স্বরূপ। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি তিনি মোহনবাগানের জুনিয়র দলের জন্য খেলেন।

খেলার বিভিন্ন নিয়ম এবং খেলা সংক্রান্ত যাবতীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য চুনি গোস্বামী ভারতীয় ফুটবলার বলাইদাস চট্টোপাধ্যায় ও বাঘা সোমকে পেয়েছিলেন কোচ হিসেবে। এরপর ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল অবধি মোহনবাগানের মূল দলের জন্য খেলেন তিনি।  সুবিমল গোস্বামী মূলত স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন।

১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি মোহনবাগানের অধিনায়ক হিসেবে খেলেছিলেন। সেই সময়কালে তিনি মোহনবাগান ডুরান্ড কাপ সহ আরো বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় প্রশংসনীয় ভাবে ভালো ফল করেছিলেন। ফুটবল জীবনে চুনি গোস্বামীর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল ১৯৬২ সালে ভারতের অধিনায়ক হিসাবে জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে খেলার স্বর্ণ পদক জয় করা।

উক্ত ফাইনাল ম্যাচে ভারতীয় দল দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। এই স্বর্ণ জয় ছাড়াও তিনি তেল আভিভে দলের অধিনায়ক হিসাবে এশিয়া কাপের রৌপ্য পদক জয়ী হয়েছিলেন। তিনি যখন খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন তখন ফুটবল খেলা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ফুটবল থেকে অবসর নেন চুনি গোস্বামী।

ক্রীড়া জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা

চুনী গোস্বামীর ক্রিকেট খেলায় মনোনিবেশ, Concentration on playing cricket

দীর্ঘ সময় ধরে ফুটবল খেলার সাথে যুক্ত থাকার পর অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন চুনি গোস্বামী। তবে অবসর নিয়েও ঘরে বসে থাকেন নি তিনি, বরং তিনি তখন ক্রিকেট খেলায় মনোনিবেশ করেন। ক্রিকেটে রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার অধিনায়কত্ব করেন তিনি। এমনকি তিনি বাংলা দলের হয়ে দুইবার রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে খেলেছিলেন।

তিনি একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন, এছাড়াও তিনি ডানহাতে মিডিয়াম পেস বল করতে পারতেন। একজন ক্রিকেটার হিসেবে ৪৬টি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিলেন, যেখানে একটি সেঞ্চুরি সহ ১৫৯২ রান করেছিলেন তিনি। চুনি গোস্বামী শুধু ফুটবল বা ক্রিকেট খেলায় যে দক্ষ ছিলেন তা নয়, বরং তিনি “অলরাউন্ডার ” ছিলেন, কারণ তিনি হকি খেলাতেও বেশ দক্ষ ছিলেন। অন্যদিকে সাউথ ক্লাবে নিয়মিত টেনিস খেলতেন তিনি। তাছাড়াও তিনি দুর্দান্ত ক্যারাম খেলতে পারতেন।

চুনি গোস্বামীর উল্লেখযোগ্য খেলা, Notable performance by Chuni Goswami

১৯৫৮ সালের এশিয়ান গেমসOpens in a new tab. : হংকংয়ের বিপরীতে কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি শ্যুটআউট এ গোল করেন চুনি গোস্বামী।

১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমস : দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে সেমি ফাইনাল ম্যাচে জোড়া গোল করে জয় লাভ করেন।

জুনিয়র ফুটবল: মাত্র ৯ বছর বয়সে মোহনবাগান জুনিয়র দলে খেলতে শুরু করেন চুনি গোস্বামী। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত মোহনবাগানের জুনিয়র দলের স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেছিলেন।

সিনিয়র ক্লাব ফুটবল : ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত মোহনবাগানের সিনিয়র দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৬০-১৯৬৪, পাঁচ বছর মোহনবাগানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন চুনী।

চুনি গোস্বামীর উল্লেখযোগ্য খেলা

চুনি গোস্বামীর আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের বিবরণ, International career

চুনি গোস্বামী প্রাথমিকভাবে বাংলার খেলোয়াড় হিসেবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলেছিলেন বটে, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল অবধি ভারতীয় দলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন চুনি গোস্বামী। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তিনি নিজের খেলার কৌশল প্রদর্শন করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। চিনা অলিম্পিক দলের বিরুদ্ধে ফুটবলের জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। দেশের জার্সিতে তিনি ৫০টি ম্যাচ খেলেন। জাতীয় স্তরের খেলোয়াড় হিসেবে তিনি অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস, এশিয়া কাপ ও মারডেকা কাপে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। চুনী গোস্বামী দুইটি এশিয়া কাপ ও মারডেকা কাপে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। 

কোচিং এর কেরিয়ারের অভিজ্ঞতা, Coaching and Career experiences

বহু বছর ধরে খেলায় অভিজ্ঞতা থাকার দরুন কোচ হিসেবেও চুনি গোস্বামী যথেষ্ট প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল অবধি টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময় ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।

কোচিং এর কেরিয়ারের অভিজ্ঞতা

পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি, Awards and Recognition

চুনি গোস্বামী নিজের কর্মজীবনের বিভিন্ন অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু পুরস্কার তথা সম্মাননা অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে চুনী গোস্বামী অর্জুন পুরস্কার লাভ করেন, পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার পান। ২০০৫ সালে তিনি মোহনবাগান রত্ন পুরস্কার অর্জন করেন। তাছাড়াও তিনি ১৯৬২ সালে এশিয়ার সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে পুরস্কার জয় করেন। তাছাড়াও তিনি বাংলার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে জীবনকৃতি সম্মানে ভূষিত হন।

পরবর্তী সময়ে, ২০০৫ সালের দিকে তিনি কলকাতার শেরিফে নিযুক্ত হন। চুনি গোস্বামীকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ১৫ই এপ্রিল কলকাতার মোহনবাগান ক্লাবের সদর দফতরে প্রাক্তন ভারতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কারের দ্বারা আইকনিক “চুনি গোস্বামী গেট” উন্মোচন করা হয়েছিল। সুনীল গাভাস্কার উক্ত অনুষ্ঠানে বলেন যে, তিনি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করেন যে তিনি চুনি গোস্বামীর নামে এই গেট উন্মোচন করার সুযোগ পেয়েছেন। গাভাস্কার ক্রিকেটে চুনি গোস্বামীর বিপরীত দলের হয়ে খেলেছিলেন রঞ্জি ট্রফির ক্ষেত্রে, তখন থেকেই তিনি এই বাঙালি খেলোয়াড়ের খেলার দক্ষতার প্রতি মুগ্ধ ছিলেন। 

পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি

বৈবাহিক সম্পর্ক, Marital status

চুনি গোস্বামী বাসন্তী নামের একজন স্ত্রীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই দম্পতির সংসারে এক পুত্রের জন্ম হয়। তারা এই পুত্রের নাম রেখেছিলেন সুদীপ্ত।

জীবনাবসান, Death

সুবিখ্যাত খেলোয়াড় চুনি গোস্বামীর প্রাণ বিয়োগ ঘটে ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮২ বছর। বেশ কয়েকমাস ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। মৃত্যু ১ দিন আগে যোধপুরে নিজের বাড়িতেই পর পর দুইবার তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এরূপ অসুস্থতা নিয়ে সেদিনই শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাক্তন ফুটবলার চুনি গোস্বামীকে। মূলত সুগার, প্রোস্টেট ও স্নায়ু সমস্যা নিয়ে বেশ কয়েকমাস যাবৎ চিকিৎসারত ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত হৃদরোগাক্রান্ত হয়ে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে এক অন্যতম নক্ষত্রকে হারিয়েছিল ভারতীয় ক্রীড়া জগৎ।

জীবনাবসান

উপসংহার, Conclusion

চুনী গোস্বামী নিঃসন্দেহে বাংলার ইতিহাসের এক বিরল প্রতিভা। ঐতিহাসিক ভাবে তিনি সত্তরের দশকে বাংলার ক্রিকেট অধিনায়ক রূপে তৎকালীন সময়ের অপরাজেয় বোম্বাই দলকে তাদের নিজের ঘরের মাঠেই প্রায় হারিয়ে দিয়েছিলেন। অল্প কথায় বলতে গেলে রূপ, গুণ, বুদ্ধিমত্তা সব কিছুই যেন প্রকৃতি ঢেলে দিয়েছিল মানুষটার মধ্যে। খেলার ময়দানে তিনি যথেষ্ট সফল খেলোয়াড় তথা অধিনায়ক। তাঁর পরবর্তী খেলোয়াড়দের কাছে তিনি এক অনন্য অনুপ্রেরণা স্বরূপ।

Frequently Asked Questions :

চুনি গোস্বামী কে?

ফুটবল জগতের বাঙালি খেলোয়াড়দের মধ্যে চুনী গোস্বামী এক অন্যতম নাম।

চুনি গোস্বামী কবে জন্মগ্রহণ করেন?

-১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি।

চুনি গোস্বামীর মৃত্যু কবে হয়?

২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল।

চুনি গোস্বামী গেট কবে উন্মোচন করা হয় ?

-২০২৩ সালের ১৫ই এপ্রিল

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts