সম্রাট অশোকের কথা আমরা কম বেশি পাঠ্য বইতে পড়েছি। তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার তথা রাজত্বের বিভিন্ন কাহিনী আমাদের মধ্যেই অনেকেই পড়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সম্রাট সর্বভারতীয় সম্রাট হিসেবেও পরিচিত। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা সম্রাট অশোকের জীবনের কিছু কাহিনী তুলে ধরবো।
সম্রাট অশোকের জন্ম, Birth of Samrat Ashoka
অশোকাবদান গ্রন্থানুসারে, সম্রাট অশোক ছিলেন দ্বিতীয় মৌর্য্য সম্রাট বিন্দুসার ও ব্রাহ্মণ বংশের নারী সুভদ্রাঙ্গীর পুত্র ছিলেন। অন্যদিকে দিব্যাবদান গ্রন্থে অশোকের মাতাকে জনপদকল্যাণী বলে উল্লেখ করা আছে।
অশোকের সিংহাসনলাভ, Ashoka’s accession to the throne
সম্রাট অশোকের মধ্যে রাজত্ব কায়েম রাখার মত বহু গুণ ছিল। পিতা বিন্দুসারের রাজত্বকালে উজ্জয়িনী নগরীর শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্বলাভ করেন অশোক।
২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিন্দুসারের মৃত্যু হয়। তখন উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সিংহাসন লাভ নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জীবদ্দশায় বিন্দুসার তাঁর পুত্র সুসীমকে উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসনের অধিকারী করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুসীমের উগ্র ও অহঙ্কারী চরিত্রের কারণে রাজ্যের মানুষ তথা বিন্দুসারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিবেচনা করে অশোককে সমর্থন করেন।
অন্যদিকে রাধাগুপ্ত নামক এক মন্ত্রী অশোকের সিংহাসনলাভ করার পক্ষে প্রধান সহায়ক হয়ে ওঠেন, এই মন্ত্রীই পরবর্তীকালে অশোকের রাজত্বে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এমনও কিছু ঘটনা জানা যায় যে, অশোক শঠতা করে সুসীমকে হত্যা করার জন্য একটি জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়েছিলেন।
দীপবংশ ও মহাবংশ গ্রন্থানুসারে, বীতাশোক নামক ভাইকে ছেড়ে অশোক তাঁর নিরানব্বইজন ভাইকে হত্যা করেছিলেন, কিন্ত এই ঘটনাটির এখনো পর্যন্ত কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পিতার মৃত্যুর তিন বছর পর ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশোক মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ অবধি রাজত্ব করেন তিনি। অন্যদিকে রাজত্বকালে তিনি বেশ কিছু উপাধি লাভ করেছিলেন, সেগুলো হল : দেবনামপ্রিয়, প্রিয়দর্শী ইত্যাদি।
সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্য বিস্তার, Expansion of Ashoka Empire
সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের বিস্তার বিশালভাবে হয়েছিল। সিংহাসনে আরোহণ করার পর অশোক পরবর্তী আট বছর সাম্রাজ্য বিস্তার করার দিকে মনোনিবেশ করেন। উত্তরের হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ করায়ত্ত করেন তিনি। রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে তিনি আক্রমণ করেন কলিঙ্গ। সেই যুদ্ধ হয়েছিল ভয়ঙ্কর। এই ভয়াবহ যুদ্ধে নিহত হন লক্ষাধিক মানুষ এবং দেড় লক্ষের বেশি মানুষ নির্বাসিত হন।
যুদ্ধপ্রিয় অশোকের ধর্ম পৃষ্ঠপোষকতা, The religious patronage of Ashoka
বৌদ্ধ গ্রন্থে পাওয়া যায় যে, সম্রাট অশোক প্রথম জীবনে একজন বদমেজাজী ও ক্রূর প্রকৃতির শাসক ছিলেন। এ বিষয়ও কথিত আছে যে, তিনি নাকি তাঁর রাজত্বকালে বন্দীদের ওপর শারীরিক অত্যাচার করতেন এবং এই অত্যাচারের জন্য তিনি আলাদাভাবে একটি কক্ষ নির্মাণ করিয়েছিলেন।
তাঁর এই ক্রূর স্বভাবের জন্য তাঁকে চণ্ড অশোক নামেও অভিহিত করা হত। তবে বৌদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখিত উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে পরবর্তীতে বিবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। অধ্যাপক চার্লস ড্রেকেমেয়ার বৌদ্ধ প্রবাদগুলিকে অতিশয়োক্তি বলে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি বলেন, বৌদ্ধ ধর্মকে সুমহান ধর্ম হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্যে এই সব কাহিনীর জন্ম দেওয়া হয়েছিল, এই কাহিনীর মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে যে কোপণ স্বভাবের অশোক বৌদ্ধ ধর্মে প্রভাবিত হয়ে একজন ধার্মিক তথা নমনীয় মনের ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
সম্রাট অশোক ছিলেন যুদ্ধপ্রিয়। কিন্তু অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপিতে বর্ণিত আছে যে কলিঙ্গের ভয়াবহ যুদ্ধে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ও তাদের আত্মীয়দের অপরিসীম কষ্ট দেখে অশোক দুঃখ ও অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছিলেন, আর এই যুদ্ধের কুফল দেখে তিনি একজন শান্তিকামী ও প্রজাদরদী সম্রাটে পরিণত হন।
ক্রমে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে হয়ে উঠেন। সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতার প্রভাবে শুধুমাত্র মৌর্য্য সাম্রাজ্যই নয়, বরং এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল। অশোক পুত্র মহিন্দ ও কন্যা সংঘমিত্রা মিলে সিংহলেও বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন।
অশোকের ধার্মিকতার দৃষ্টান্ত প্রস্তরে উৎকীর্ণ লিপিতে পাওয়া যায়; যেখানে বর্ণিত ছিল “অতীতে, শতবর্ষ ধরে চলে আসছে জীবহত্যা ও জীবের অনিষ্ট সাধন, আত্মীয়দের সঙ্গে অনুচিত ব্যবহার, ব্রাহ্মণ ও তপস্বীদের সাথে অনুচিত ব্যবহার কিন্তু এখন থেকে দেবনামপ্রিয়, রাজা প্রিয়দর্শীর ধর্মানুশীলনের কারণে ঢোলের শব্দ ধর্মের শব্দে স্থানান্তরিত হবে।”
অশোকের হিংস্রতার দৃষ্টান্ত, An example of Ashoka’s violence
অশোকাবদান গ্রন্থানুসারে, অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তার পরেও তিনি হিংসা ত্যাগ করেননি। তিনি নির্মমভাবে বহু মানুষের হত্যা করেছিলেন। কথিত আছে যে তিনি পুণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলে বসবাসকারী সকল আজীবিক সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করার নির্দেশ দেন, ফলে সেখানকার প্রায় ১৮,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
এছাড়াও বেশ কিছু জৈন ধর্মাবলম্বীদের তিনি হত্যা করেন বলেও বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, এইসব ঘটনাগুলির সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তিনি পাটলীপুত্রে এক কারাগার নির্মাণ করেন। ভয়াবহতার জন্য একে অশোকের নরক বলা হতো।
তিনি এই কারাগারকে বাইরের দিক থেকে দৃষ্টিনন্দন করে তৈরি করেন, কিন্তু এখানে বন্দীদের উপর অত্যাচার হয় নির্মমভাবে। এছাড়াও কথিত আছে যে অশোককে সিংহাসনলাভে যে সব মন্ত্রীরা সাহায্য করেছিলেন তাঁদের আনুগত্য অক্ষুণ্ন আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। এরজন্য তিনি মন্ত্রীদের সাম্রাজ্যের সকল ফলদ ও সপুষ্পক বৃক্ষ কর্তনের আদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মন্ত্রীরা এমন নির্বোধের মতো কাজটি করতে অস্বীকৃতি জানান, এতে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ৫০০ জন মন্ত্রীর শিরশ্ছেদ করেছিলেন।
প্রতিবেশী রাজাদের চিকিৎসা সেবা, Medical services of neighboring kings
অশোকের সময়কালের শিলালিপিতে প্রতিবেশী রাজাদের নাম ও তাদের সঙ্গে চিকিৎসা সেবাজনিত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, “রাজা দেবনামপ্রিয় প্রিয়দর্শীর রাজত্বে সর্বত্র এবং যারা তার সীমান্তবর্তী যেমন চোল, পাণ্ড্য রাজবংশ পাণ্ড্য, সত্যপুত, কেলালপুত, তাম্রপর্ণী এবং যবনরাজ (গ্রিক রাজা) আন্তিয়োগ (আন্তিওখোস) এবং অন্য রাজারা যারা আন্তিয়োগের প্রতিবেশী, সর্বত্র রাজা দেবনামপ্রিয় প্রিয়দর্শী কর্তৃক দ্বিবিধ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠিত হলো। মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা এবং গবাদি পশুর জন্য চিকিৎসা সেবা।”
এছাড়াও তিনি তার প্রতিবেশী শাসকদের বলেছিলেন যে তাদের প্রজা ও তাদের গবাদি পশু উভয়ের জন্যই অশোকের সাম্রাজ্য থেকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা করা হবে।
বৈবাহিক জীবন, Married life
সম্রাট অশোকের দাম্পত্যসঙ্গী ছিলেন অসন্ধিমিত্রা, দেবী, কারুবকী, পদ্মাবতী, তিষ্যরক্ষা প্রমুখ। তিনি পাঁচ বার বিবাহ করেছিলেন। তাঁর সন্তানাদির নাম হল মহিন্দ, সংঘমিত্রা, তিবল, কুণাল, চারুমতী।
কথিত আছে যে অশোক একবার নিজের উপপত্নীদের নিয়ে বিহার করছিলেন। তখন এক উদ্যানে তারা একটি সুন্দর অশোক বৃক্ষ দেখতে পেয়েছিলেন, অশোক রুক্ষ ত্বকের অধিকারী হওয়ায় উপপত্নীদের কাছে অপ্রিয় ছিলেন। সেদিন অশোক ঘুমিয়ে পড়ার পর অশোকের প্রতি তাদের বিরক্তি প্রকাশ স্বরূপ তারা সকলে মিলে ঐ সুন্দর অশোক বৃক্ষকে নষ্ট করে দিয়েছিলেন। এদিকে সম্রাট একে নিজের অপমান মনে করে ক্রোধে উপপত্নীদের অগ্নিদগ্ধ করে দিয়েছিলেন।
অশোকের স্মৃতিচিহ্ন, Memorial of Ashoka
সম্রাট অশোকের কীর্তি তথা বিভিন্ন প্রতীক, তাঁর রাজত্বের সময়কালে শিল্প, উৎকীর্ণলিপি, মুদ্রা ইত্যাদিতে উদ্ভাসিত। লক্ষ্য করলে বুঝতে পারা যায় যে অশোকের স্মৃতিচিহ্ন তাঁর সমসাময়িক ভারত, পাকিস্তান,আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তাছাড়া ভারতের জাতীয় পতাকার কেন্দ্রে স্থান পেয়েছে অশোকস্তম্ভের নিম্নস্থিত ধর্মচক্র। তাই বলা যায় যে, ভারতের জাতীয় পতাকা মৌর্য সাম্রাজ্যের গৌরবময় ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।
উপসংহার, Conclusion
সম্রাট অশোকের সম্পর্কে বহু দৃষ্টান্ত এবং কাহিনী বিভিন্ন গ্রন্থ তথা শিলালীপি থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু এসব নিয়ে অনেকের মধ্যেই মতভেদ দেখা যায়। বহু কাহিনীর কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নি, তাই বেশ কিছু ইতিহাসবিদ এসব কাহিনীকে মিথ্যে বলে মনে করেন।