ইসলাম ধর্মের সুবক্তা হিসেবে বহু স্কলারের সাথেই কোনো না কোনোভাবে আমরা পরিচিত হয়েছি। তাদের মধ্যে অনেকের ভিডিও তথা ওয়াজে হয়তো আপনাদের মধ্যে অনেকেই গিয়ে থাকবেন। উক্ত বক্তাদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম হল গোলাম সরওয়ার সাঈদী।
উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ছিলেন মাওলানা গোলাম সরোয়ার সাঈদী। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর ইউটিউবে তিনি আলোচনা করতেন, যা জনগণের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে অনেকেই এই বিশিষ্ট ব্যক্তির পরিচয় সঠিকভাবে জানতেন না। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা পীরজাদা গোলাম সরওয়ার সাঈদী এর জীবন নিয়ে আলোচনা করবো।
সাঈদীর জন্ম ও পরিবার পরিচয়, Birth and family identity of Saide :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত আড়াইবাড়ী দরবার শরীফের প্রয়াত পীর সাহেব আল্লামা হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ গোলাম হাক্কানীর (রহ.)-এর সন্তান হলেন গোলাম সরওয়ার সাঈদী। সেই সুবাদে তাঁকে একজন পীরজাদা বলা যায়।
একই সূত্রে আড়াইবাড়ী দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা হযরত মাওলানা আবু সাঈদ আসগর আহমাদ আল-কাদেরী (র.) -এর পৌত্র তিনি। গোলাম সরোয়ার সাঈদীর প্রপিতামহ ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার নারুই গ্রামের হযরত মাওলানা মুকসুদ আলী (র.)। তিনি দেশবরেণ্য আলেম ছিলেন।
গোলাম সরোয়ার সাঈদীর দাদা মাওলানা আবু সাঈদ আসগর আহমাদ ১৯৩৭ সালে কসবা উপজেলার পৌর সদরের আড়াইবাড়ী আলিয়া মাদরাসা ও একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন।
মাওলানা শাহ মুহাম্মদ গোলাম হাক্কানীর নয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্র হলেন মাওলানা মো. গোলাম সারোয়ার সাঈদী। গোলাম হাক্কানীর পাঁচ ছেলে ও চার কন্যার মধ্যে সাঈদীই জনগণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। অন্য ছেলেমেয়েরা চাকরি ও ব্যবসায় জড়িত ছিল।
সাঈদীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মজীবন, Educational Qualification and Career of Saide :
মোহাম্মদ সাইদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় আড়াইবাড়ি আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ শুরু করেন।
সাঈদীর দাদা মাওলানা আবু সাঈদ আসগর আহমাদ দ্বারা ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটিকে সাঈদী ২০০৪ সালে মাদ্রাসাকে কামিল মানে উন্নীত করেন। পাশাপাশি গড়ে তোলেন আড়াইবাড়ী ইসলামিয়া ছায়েদীয়া এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, আড়াইবাড়ী হাক্কানীয়া হাফেজী মাদ্রাসা, আড়াইবাড়ী সাইয়েদা সুরাইয়া নূরানী মাদরাসা, ইসলামী বুক ক্লাব।
উক্ত মাদ্রাসাটি এলাকায় শিক্ষা বিস্তার, অনৈসলামিক কার্যকলাপ রোধসহ বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে থাকে। অন্যদিকে মাওলানা মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার সাঈদী দায়িত্ব নিয়ে মাদ্রাসার পাঠাগারকে মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ে সমৃদ্ধ করেন। মাওলানা গোলাম সারোয়ার সাঈদী উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার হিসেবে জনগণের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে তা বিলিয়ে দেন।
তাঁর কিছু ইউটিউব ভিডিও এর শিরোনাম হল :
- হে যুবক মৃত্যু কাউকে বলে আসেনা-Golam sarwar saide – গোলাম সারোয়ার সাঈদী
- যাদের বয়স ১৬ থেকে ৩০ ভিডিওটি অবশ্যই দেখুন বদলে যাবে জীবন। Golam sarwar saide
- যেভাবে নিজের মৃত্যুর তালিকা দেখালেন গোলাম সারওয়ার সাঈদী! Golam sarwar
- ওয়াজটি একবার শুনুন । মনে হয়না জীবনে আর গুনাহ করবেন। Golam sarwar saide
- মৃত্যুর আগে শেষ মাহফিল সবার জন্য যে শেষ কথাটি বলে গিয়েছেন। Golam Sarwar
- বিশ্বনবী কেন ও কিভাবে শ্রেষ্ঠ হলেন? গোলাম সরোয়ার সাঈদী Golam Sarwar Saide
- তিন ধরনের মেয়েরা জান্নাত পাবে না।গোলাম সারোয়ার সাঈদী..Golam sarwar saide
অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা নিতে এবং ধর্মের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে গোলাম সারোয়ার সাঈদীর ওয়াজের ভিডিওগুলো দেখে থাকে। অনেকেই আবার তাঁর ওয়াজে উপস্থিত থাকেন।
গোলাম সরওয়ার সাঈদীর মৃত্যুর ভুয়ো খবর, Fake news of Golam Sarwar saide’s death :
২০২০ সালের ৭ নভেম্বর সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে পোস্ট করার মাধ্যমে সাঈদীর মৃত্যুর খবর ছড়ানো হয়। পরে এই ভুয়া সংবাদটি সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
সেদিনই বিকেলে ৫টার দিকে মাওলানা সাঈদীর ফেসবুক পেজের এডমিন এই ভুয়ো খবর এর সত্যতা তুলে ধরার জন্য একটি পোস্ট করেন। উক্ত পোস্টটিতে বিষয়টিকে ভুয়া বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘অনেকেই আপনাদের প্রিয় মো. গোলাম সারোয়ার সাঈদী সাহেবের মৃত্যুর গুজব রটাচ্ছেন। দয়া করে সবাই সতর্কতা অবলম্বন করুন। প্রিয় হুজুর আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছেন। আলহামদুলিল্লাহ। সবার কাছে দোয়া চাই।’
মাওলানা সাঈদীর অবস্থা তখন সংকটাপন্ন ছিল। তাঁকে ৫ নভেম্বর রাতে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের (সাবেক অ্যাপোলো হাসপাতাল) আইসিইউতে রাখা হয়েছিল।
মাওলানা মো. গোলাম সরওয়ার সাঈদী’র অকাল প্রয়াণ, Untimely Death of Maulana Md. Golam Sarwar Saide :
আড়াইবাড়ী আলিয়া মাদ্রাসাহীন কসবার অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ গোলাম সরওয়ার সাঈদী ৫২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালে কসবা আড়াইবাড়ী এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
২০২০ সালের ২১ শে নভেম্বর, ভোর ৪টা ২০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। দীর্ঘ ১৬ দিন হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন থেকে অবশেষে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন সুপরিচিত ধর্মীয় বক্তা অধ্যক্ষ গোলাম সারোয়ার সাঈদী।
কসবা আড়াইবাড়ির প্রধান দরবার শরীফে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। গোলাম সারওয়ার সাঈদীর জানাজায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে প্রখ্যাত এই আলেমকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায় যে, মাওলানা গোলাম সারওয়ার সাইদ বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় তাঁকে।
সাঈদী’র মৃত্যুতে মিজানুর রহমান আজহারীর প্রতিক্রিয়া, Mizanur Rahman Azhari’s reaction to Saide’s death :
গোলাম সরওয়ার সাঈদী এর মৃত্যুতে মিজানুর রহমান আজহারী নিজের ফেসবুক ভেরিফাইড পেইজ থেকে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
উক্ত স্ট্যাটাসটিতে তিনি বলেন,
‘প্রিয় নানাভাই অধ্যক্ষ গোলাম সারওয়ার সাঈদি (পীরসাহেব আড়াইবাড়ী দরবার) আল্লাহর জিম্মায়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর দ্বীনের খাদেমকে কবুল করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান বানিয়ে নিন।
আমিন। একই মঞ্চে নানা নাতিকে আর হয়তো কোনদিন একসাথে দেখা যাবে না। বিদায় নানা ভাই। আমরাও আসছি, পরের কোন এক ফ্লাইটে।
ইনশাআল্লাহ দেখা হবে আল্লাহর জান্নাতে। এভাবেই প্রিয়জনদের বিদায়গুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় চিরসত্যকে আর এই বলে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায় — প্রস্তুত তো? ‘
সাঈদীর জানাজায় এসে তাঁর মৃত্যুর শোকবার্তায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন,
“তিনি আমার খুব কাছের মানুষ। গোলাম সারওয়ার সাঈদীর মৃত্যুতে কসবাবাসী একজন ভালো মানুষ হারালো।”
এছাড়াও তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
এছাড়াও ধর্মীয় সংগঠন, রাজনৈতিক দলগুলো তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছিল। তাঁর জানাজায় আইন মন্ত্রী ছাড়াই বক্তব্য রাখেন কসবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদুল কাউছার ভূইয়া জীবন, কসবা পৌরসভার মেয়র এমরান উদ্দিন জুয়েল, মরহুমের তালুই বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ কামাল উদ্দিন জাফুরী। উক্ত অনুষ্ঠানে কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ উল আলম, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লোকমান হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
শেষ কথা, Conclusion :
তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আকর্ষণ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী গোলাম সরোয়ার সাঈদীর। ইউটিউবে তাঁর ভিডিও দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হন। দেশ-বিদেশে ওয়াজ-মাহফিলের বক্তা হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল। পীর সাহেব আড়াইবাড়ী নামে সারাদেশে খ্যাতি ছিল ঢাকা আলিয়া মাদরাসার সাবেক এই শিক্ষার্থীর। আশা করি আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা এই বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছেন ।
Frequently Asked Questions
উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ছিলেন মাওলানা গোলাম সরোয়ার সাঈদী।
আল্লামা হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ গোলাম হাক্কানীর (রহ.)।
২০২০ সালের ২১ শে নভেম্বর।