কবীর সুমন একজন ভারতীয় বাঙালি গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, বেতার সাংবাদিক, গদ্যকার ও সাবেক সংসদ সদস্য। তাঁর পূর্বনাম ছিল সুমন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ২০০০ সালে তিনি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং পুরনো নাম পরিত্যাগ করেন। সুমন চট্টোপাধ্যায় মূলত একজন বিশিষ্ট আধুনিক ও রবীন্দ্রসংগীত গায়ক হিসেবেই পরিচিত।
তবে তিনি বাংলা গানে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। তাঁর সঙ্গীত রচনা, সুরারোপ, সংগীতায়োজন ও কণ্ঠদানের পাশাপাশি গদ্যরচনা ও অভিনয় ক্ষেত্রেও তিনি স্বকীয় প্রতিভার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
জন্ম ও পরিবার পরিচয়, Birth and Family
কবির সুমনের জন্ম হয় ১৯৪৯ সালের ১৬ ই মার্চ। তিনি উড়িষ্যার কটক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সুরিদ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম উমা চট্টোপাধ্যায়।
শিক্ষাগত যোগ্যতা, Educational qualification
কবির সুমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৯ সালে। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসি ভাষায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি জার্মানির মিউনিখ স্থিত লুদ্ভিক ম্যাক্সিমিললিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্মান ভাষায় ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
কর্মজীবনের প্রাথমিক সময়, early phase of career
কর্মজীবনের প্রথমদিকে কবির সুমন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে এবং ভারতের ইউনাইটেড ব্যাংকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কাজ করেছিলেন। ১৯৭০-৭১ সাল অবধি সুমন রেডিও শিল্পী হিসেবে, কলকাতা অল ইন্ডিয়া রেডিও তে ইংরেজি আলোচনা বিভাগে কাজ করেন। তারপর ১৯৭১ -৭৫ সাল অবধি ব্যাংক কর্মচারী হিসেবে কলকাতার ইউনাইটেড ব্যাংক এ চাকরি করেন।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি দেশ ছেড়ে ইউরোপে গিয়েছিলেন, এবং ভয়েস অফ জার্মানিতে(বাংলা বিভাগে) ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত একজন রেডিও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই সময় তিনি ফ্রান্সে বব ডিলান এর গান শুনেছিলেন, যা তাঁর সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর তিনি ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন, সেখানে সুমন ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা ভাষা বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
রাজনৈতিক কার্যকলাপ, political activities
সঙ্গীতে কবির সুমনের অবদানসমূহের কথা আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন, তবে এর পাশাপাশি তিনি রাজনীতির সাথেও যুক্ত। তিনি ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় মৌলবাদের বিরুদ্ধে গান রচনা করেছিলেন। তাঁকে জনগণের রাজনৈতিক এবং মৌলিক অধিকারের পক্ষে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকায় দেখা যায়।
নন্দীগ্রাম গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিজমি রক্ষার ইস্যুতে সক্রিয়ভাবে যোগদান করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। ২০০৬ থেকে, সুমন তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে নন্দীগ্রামের জমির লড়াইতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং এ বিষয়ে তাঁর গানের দুটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয় যাদের নাম ছিল নন্দীগ্রাম এবং প্রতিরোধ।
সুমন নিয়মিত টিএমসি এর অনুষ্ঠান এবং কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি ২০০৯ সালে কলকাতা বই মেলায় টিএমসি এর একটি স্টল উদ্বোধনের সময় উপস্থিত ছিলেন। ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর থেকে তাঁকে মনোনীত করেছিল এবং নির্বাচনে তিনি জয়ী হন।
এছাড়াও সুমন লালগড়ের উপজাতিদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন তাঁর কণ্ঠে এবং আন্দোলনের সমর্থনে তিনি একটি অ্যালবাম রচনা করেন, যার নাম “ছাত্রধরের গান”। তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতা তথা দল কর্মীদের সাথে তাঁর বহুবার বিবাদ হয়। বর্তমানে তিনি নিজের বাক্তিগত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করেন।
সঙ্গীত শিক্ষা, music training and education
বাংলা গানের বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে কবির সুমন শৈশব থেকে প্রশিক্ষিত ছিলেন।
- ১. ১৯৬২-৭৫ সাল অবধি তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত (খেয়াল) এ তালিম নেন।
- ২. ১৯৮৬-৮৯ সালে তিনি পশ্চিমা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ নেন এবং জার্মানিতে গিটার শিখেছিলেন।
সঙ্গীত ক্যারিয়ার, Music career
কবির সুমনের গানগুলো বাংলা গানের উন্নতিসাধনে একটি প্রধান প্রভাব ফেলে, পাশাপাশি সমকালীন বাংলা গানের আন্দোলনকে বৃদ্ধি করেছে। সুমনের সঙ্গীতের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং রবীন্দ্র সংগীতের উপর ছিল। তবে তিনি জার্মানে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার সময় পশ্চিমী লোক রূপ চয়ন করেন।
বিদেশ থেকে কলকাতাতে ফিরে তিনি প্রথমে একটি ব্যান্ড ‘নাগরিক’ এর সঙ্গে যোগ দেন, এবং দুইটি অ্যালবাম “অন্য কথা অন্য গান” শিরোনামে মুক্তি দিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম “তোমাকে চাই” মুক্তি পায় এবং বেশ সফল হয়েছিল। সঙ্গীত ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে কবির সুমন রবীন্দ্র সংগীতের কিছু গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেন।
১৯৯৩-২০০৮ সাল অবধি তাঁর গাওয়া ১৫ টির বেশি আধুনিক বাংলা গানের অ্যালবামের ক্যাসেট ও সিডি রিলিজ হয়। ১৯৯৩-২০১৪ সালের সময়কালে সুমন বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনার মধ্যে – মহা সংগ্রাম, সেদিন চৈত্রমাস, কথা, পথ্য, সূর্যকন্যা এবং কৃষ্ণচূড়া, রঞ্জনা আমি আর আসবো না, জাতিস্মর প্রমুখ ছবি অন্যতম।
উত্তরাধিকার, Legacy
কবির সুমনের গান সামাজিক প্রথাগুলোকে প্রতিফলিত করে, পাশাপাশি রাজনৈতিক আচার-আচরণকেও। তিনি হালকা শাস্ত্রীয়, চলচ্চিত্র সঙ্গীত এবং লোকগীতি সহ একাধিক ঘরানার সঙ্গীতে নিবিষ্ট ছিলেন। বব ডিলান, পিট সিগার, পল সাইমন, জন লেনন এবং অন্যান্য পশ্চিমী সঙ্গীতশিল্পীদের দ্বারা তিনি যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।
বব ডিলানের “Blowin in the wind” গানটির বাংলা প্রতিলিপি “উত্তরও তো জানা” হিসেবে ১৯৯৩ সালে তাঁর অ্যালবাম “ইচ্ছে হল” তে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৯৭ সালে “Farewell, Angelina” গানটির প্রতিলিপি “বিদায় পরিচিতা” হিসেবে “জাতিস্মর” অ্যালবামে অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়াও তিনি পল সাইমনের “Sounds of Silence” এর প্রতিলিপি হিসেবে “স্তব্ধতার গান” তৈরি করেন। প্রথম দিকে তাঁর অ্যালবামগুলিতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার কম ছিল, প্রধানত ইলেকট্রনিক কীবোর্ড, গিটার এবং মাউথ অরগান ব্যবহার করতেন তিনি।
মালটিট্রাক রেকর্ডিং এ তিনি নিজেই সব বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। বাংলা ভাষার উপর তাঁর অসাধারণ দখল আর গানের কথায় ভাষার ব্যবহার এবং অনবদ্য রচনাশৈলী ভবিষ্যত প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পীদের প্রভাবিত করতে থাকবে। তাঁর গানের কথাগুলোর উচ্চারণের জন্য অনেকেই তাঁকে ‘উচ্চারণপ্রেমী’ বলেও সম্বোধন করেন।
কবির সুমনের গ্রন্থতালিকা, books written by Kabir Suman
- ডিসকভারিং দি আদার অ্যামেরিকা: র্যাডিকাল ভয়েসেস ফ্রম দি নাইনটিন এইটিজ ইন কনভার্সেশন উইথ কবীর সুমন (২০১২)
- সুমনামি
- মন-মেজাজ
- আলখাল্লা
- হয়ে ওঠা গান
- কোন পথে গেল গান
- সুমনের গান, সুমনের ভাষ্য
- সুমনের গান
- মুক্ত নিকারাগুয়া
- দূরের জানলা
- নিশানের নাম তাপসী মালিক
সাংবাদিকতা পেশার কাজ, Working as journalist
দেশ, আনন্দ বাজার পত্রিকা, আজকাল, ফ্রন্টিয়ার, আজবিকাশ, সঙ্গীত নাটক একাডেমি পত্রিকা ইত্যাদিতে কাজ করেছেন কবির সুমন। তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ, বৈশিষ্ট্য ও কলাম ইত্যাদি প্রকাশ করা হয় উক্ত পত্রিকাগুলোতে।
টিভি সাংবাদিকতা এবং লাইভ শো উপস্থাপনা, TV journalist and live show host
- ২০০৩-০৪ সাল অবধি তারা নিউজ চ্যানেলে ‘লাইভ দশটায়’ নামক শো উপস্থাপনার কাজ করতেন।
- ২০০৫-০৭ সাল অবধি তারা নিউজ চ্যানেলে প্রচারিত ‘মতামত’ নামক শো এর উপস্থাপক ছিলেন তিনি।
অভিনয়, Acting
- ২০০২ সালে সারেন দত্ত নির্দেশিত টেলিফিল্ম ‘চার অধ্যায়’- এ দেখা গিয়েছিল কবির সুমনকে।
- ২০০৫ – ২০০৬ অবধি তিনি ‘ছায়ামানুষ’ নামক টিভি সিরিয়ালে কাজ করেন যা ইটিভি চ্যানেলে সম্প্রচার হয়।
- ২০০৫ সালে অঞ্জন দত্ত নির্দেশিত ‘বাবর বড়দিন’ নামক টেলিফিল্ম- এ অভিনয় করেন তিনি।
- ২০০৫ সালে কৌশিক সেন নির্দেশিত সামুদ্রের মৌন( থিয়েটার) এ অভিনয় করেন তিনি।
- ২০০৬ সালে সুমন মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ফিচার ফিল্ম ‘হার্বার্ট’ এ অভিনয় করেন তিনি।
- ২০০৭ সালে ‘কথা’ নামক ফিচার ফিল্ম এ অভিনয় করেন কবির সুমন।
- ২০০৮ সালে সুমন মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘চতুরাঙ্গ’ নামক ফিচার ফিল্ম এ অভিনয় করে দেখা যায় তাঁকে।,
- ২০১৪ সালে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘জাতিস্মর’ নামক ফিচার ফিল্ম এ দেখা যায় তাঁকে।
দাম্পত্য সঙ্গী, Spouse
কবির সুমন বিশিষ্ট বাংলাদেশী গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন এর সাথে বিবাহ করেছিলেন।
পুরস্কার প্রাপ্তি, Awards received
- বিএফজেএ পুরস্কার (১৯৯৭) – শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে (‘ভাই’ চলচ্চিত্রের জন্য)
- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (ভারত) (২০১৪) – শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে (জাতিস্মর চলচ্চিত্রের জন্য)
- মিরচি মিউজিক অ্যাওয়ার্ড বাংলা (২০১৪) – শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে (জাতিস্মর চলচ্চিত্রের এ তুমি কেমন তুমি গানের জন্য)
- মিরচি মিউজিক অ্যাওয়ার্ড বাংলা (২০১৪) – শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে (জাতিস্মর চলচ্চিত্রের খোদার কসম জান গানের জন্য)
- সংগীত মহাসম্মান (২০১৫) – পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক ভূষিত
শেষ কথা, Conclusion
কবির সুমনকে বাংলা গানের একটি নতুন গোত্র তৈরি করার কৃতিত্ব দেন শ্রোতারা, তাঁর গানের কথাগুলো সাধারণ জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। তাঁকে একজন নাগরিক কবিয়াল হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। কিছু জনগণ তাঁর গানকে জীবনমুখী হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন, যদিও তিনি নিজে সহজ আধুনিক বাংলা গান হিসেবেই তাঁর কাজগুলোকে বিবেচনা করতে বলেন।
Frequently Asked Questions
১৯৪৯ সালের ১৬ ই মার্চ।
তোমাকে চাই, ১৯৯২ সালে প্রকাশিত।
২০০০ সালে তিনি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন।
সুমন চট্টোপাধ্যায়।