মাইকেল ব্লুমবার্গ মার্কিন সাম্রাজ্যের এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে একজন মার্কিন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী তথা লেখক। তিনি ব্লুমবার্গ এল.পি. এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। অন্যদিকে ২০০২ সাল থেকে ২০১৩ সব অবধি নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। এছাড়াও ২০২০ সালের প্রাথমিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী ছিলেন মাইকেল ব্লুমবার্গ। অন্যদিকে ২০২২ সাল থেকে তিনি ডিফেন্স ইনোভেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
জন্ম ও শৈশবকাল, Birth and Childhood
মাইকেল ব্লুমবার্গ ১৯৪২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। সেন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তাঁর জন্ম হয়। পিতার নাম উইলিয়াম হেনরি ব্লুমবার্গ, যিনি ছিলেন এক দুগ্ধ উৎপাদনকারী কোম্পানির হিসাবরক্ষক এবং মায়ের নাম শার্লট ব্লুমবার্গ। মাইকেলের দুই বছর বয়স হওয়া অবধি তাদের পরিবারটি অলস্টনে বসবাস করছিল, পরবর্তীতে ব্রুকলাইন, ম্যাসাচুসেটস-এ দুই বছর বাস করেন, অবশেষে মেডফোর্ড, ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন শহরতলিতে নিজের বসতি স্থাপন করেছিলেন, যেখানে মাইকেল কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার সময় অবধি বসবাস করেন।
শিক্ষাজীবন, Education
মাইকেল ব্লুমবার্গ ম্যাসাচুসেটস এর মেডফোর্ডে বেড়ে ওঠেন। ১৯৬০ সালে মেডফোর্ড হাই স্কুল থেকে স্নাতক হন। পরবর্তীতে তিনি জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন, ১৯৬৪ সালে বৈদ্যুতিক প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে, মাস্টার অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ) ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন, Career
মাইকেল ব্লুমবার্গ সিকিউরিটিজ ব্রোকারেজ সালেমোন ব্রাদার্স থেকে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। এটি ছিল একটি বৃহৎ ওয়াল স্ট্রিট বিনিয়োগ ব্যাঙ্ক , যেখানে তিনি ইক্যুইটি ট্রেডিং এবং কিছু সময় পর সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের নেতৃত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে, ১৯৮১ সালে নিজস্ব সংস্থা গঠন করেন। সংস্থার নাম রাখেন ব্লুমবার্গ এলপি, এটি হল একটি আর্থিক পরিষেবা, সফটওয়্যার এবং গণমাধ্যম সংস্থা।
সংস্থাটি গঠন করার পরবর্তী বিশ বছর তিনি এর চেয়ারম্যান তথা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০২ সাল অবধি জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এরপর ব্লুমবার্গ ২০০৫ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টানা তিনবারের জন্য নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচিত হন। একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী হিসাবে সংক্ষিপ্ত কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পর, ব্লুমবার্গ ২০১৪ সালে পুনরায় এলপিতে সিইও পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ব্যবসায়িক জীবন, Business life
১৯৮১ সালে ফিব্রো কর্পোরেশন সলোমন ব্রাদার্সকে কিনে নেয় এবং ফিব্রো কর্পোরেশনের আওতায় কোম্পানির নতুন ব্যবস্থাপনায় মাইকেলকে বরখাস্ত করা হয়, তবে ফার্মে তাঁর ইক্যুইটির জন্য তাঁকে $10 মিলিয়ন প্রদান করেছিল। উক্ত অর্থ দিয়ে মাইকেল সলোমন ব্রাদার্সের জন্য অভ্যন্তরীণ কম্পিউটারাইজড আর্থিক ব্যবস্থা ডিজাইন করেছিলেন। পরবর্তীতে কোম্পানিটি কাস্টমাইজড কম্পিউটার টার্মিনাল বিক্রি করে যা ওয়াল স্ট্রিট ফার্মের কাছে রিয়েল-টাইম মার্কেট ডেটা, আর্থিক হিসাব এবং অন্যান্য বিশ্লেষণ সরবরাহ করেছিল।
১৯৮৬ সালে, উক্ত কোম্পানির নাম দেওয়া হয় ব্লুমবার্গ এলপি। ২০১৮ সালে ব্লুমবার্গ এলপির প্রায় $10 বিলিয়ন আয় হয়েছিল। ২০১৯ সাল অবধি বিশ্বব্যাপী কোম্পানিটির 325,000 এরও বেশি টার্মিনাল গ্রাহক ছিল।
রাজনৈতিক জীবন, Political life
নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র হিসেবে রাজনৈতিক জীবন গড়ে তোলার জন্য তিনি সিইও-এর পদ ছেড়ে দেন। মেয়র হিসেবে চূড়ান্ত মেয়াদ শেষ হলে ২০১৪ সালে তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি ব্লুমবার্গ এলপি-তে সিইও পদে ফিরে আসবেন। পরবর্তীতে তিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য লড়াই করেন।
২০০১ সাল অবধি মাইকেল ডেমোক্র্যাট ছিলেন, কিন্তু মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তিনি রিপাবলিকান পার্টিতে চলে যান। ২০০৭ সালে তিনি পুনরায় স্বতন্ত্র হয়ে যান এবং ২০১৮ সালে ডেমোক্র্যাট দলের সাথে যুক্ত হন। মাইকেল ব্লুমবার্গ নিউইয়র্কের মেয়র পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন, জনস্বাস্থ্য ও কল্যাণে সরকারি উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন; তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাও এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাছাড়াও রেস্তোরাঁগুলোতে কৃত্রিম ট্রান্স ফ্যাট ব্যবহার বাদ দেওয়া এবং মেনথল ফ্লেভার সহ অন্যান্য স্বাদযুক্ত তামাক এবং ই-সিগারেট পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টিও এই সরকারি উদ্যোগের সাথে যুক্ত ছিল। অন্যদিকে তিনি চিনিযুক্ত সোডা নিষিদ্ধ করার জন্য একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টাও শুরু করেছিল।
এসব ছাড়াও ব্লুমবার্গ বন্দুক-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সমকামী বিবাহ, গর্ভপাতের অধিকার এবং অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্বের পথকেও সমর্থন করেন। অন্যদিকে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপত্তি কমানোর প্রচেষ্টা করেন। এছাড়াও তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদকালে ট্যাক্স কমানোর পক্ষে মত দেন। তার নিজস্ব ট্যাক্স পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বছরে 5 মিলিয়ন ডলারের বেশি আয়ের উপর 5 শতাংশ সারট্যাক্স প্রয়োগ করা।
তিনি সম্পদ করেরও বিরোধিতা করেছিলন। তাঁর মতে এটি অসাংবিধানিক। তিনি কঠোর আর্থিক প্রবিধানের প্রস্তাব করেছিলেন, যার আওতায় ছিল বড় ব্যাঙ্কগুলির কঠোর তদারকি, আর্থিক লেনদেন এবং শক্তিশালী ভোক্তা সুরক্ষা প্রদান করার বিষয়গুলো। মাইকেল এস্টেট ট্যাক্স সংগ্রহ এবং কর পরিহারের স্কিম বন্ধ করার জন্য এস্টেট ট্যাক্স থ্রেশহোল্ড হ্রাস সমর্থন করেছিলেন।
বৈবাহিক সম্পর্ক, Marital status
মাইকেল ব্লুমবার্গ ১৯৭৫ সালে, যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারের একজন ব্রিটিশ নাগরিক সুসান এলিজাবেথ বারবারা ব্রাউনের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে এই দম্পতির সংসারে দুই কন্যা জন্ম নেয়, তাদের নাম রাখা হয়েছিল এমা এবং জর্জিনা। পরবর্তী সময়ে মাইকেল ও ব্রাউনের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়, ১৯৯৩ সালে তারা আলাদা হন। মাইকেল ব্লুমবার্গ ২০০০ সাল থেকে, প্রাক্তন নিউ ইয়র্ক স্টেট ব্যাংকিং সুপারিনটেনডেন্ট ডায়ানা টেলরের সাথে বাস করেছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি, Awards and Recognition
মাইকেল ব্লুমবার্গের প্রাপ্ত পুরস্কার সমূহ :
মাইকেল ব্লুমবার্গ ২০০৩ সালে গ্লোবাল ক্যাপিটাল মার্কেটে বিশিষ্ট নেতৃত্বের জন্য ইয়েল স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট পুরস্কার পেয়েছেন।
২০০৪ সালে এহুদ বারাক দ্বারা উপস্থাপিত আমেরিকান একাডেমি অফ অ্যাচিভমেন্টের গোল্ডেন প্লেট পুরস্কার পান।
২০০৮ সালে বার্নার্ড কলেজের বার্নার্ড মেডেল অফ ডিস্টিনশন।
২০০৯ সালে স্বাস্থ্যকর সম্প্রদায়ের জন্য রবার্ট উড জনসন ফাউন্ডেশন লিডারশিপের পক্ষ থেকে ‘হেলদি কমিউনিটি লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পান।
মাইকেল ২০১৩ সালে ইহুদি মূল্যবোধের জন্য বার্ষিক জেনেসিস পুরস্কারের বিজয়ী ছিলেন।
উল্লেখ্য পুরস্কারগুলো ছাড়াও বহু সম্মাননার অধিকারী হয়েছিলেন মাইকেল ব্লুমবার্গ। ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে টাইমস100- তে তিনি বিশ্বের ৩৯তম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে মনোনীত হন। ২০১০ সালে, ভ্যানিটি ফেয়ার তাদের “ভ্যানিটি ফেয়ার 100” এর প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকায় মাইকেলকে সপ্তম স্থানে অধিষ্ঠিত করেছিল।
পরবর্তীতে ২০১৪ সালে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, মাইকেল ব্লুমবার্গকে একজন অসাধারণ উদ্যোক্তা এবং জনহিতকর প্রচেষ্টা রাখার দরুন তথা যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাজ্য-মার্কিন বিশেষ সম্পর্ককে বিভিন্ন উপায়ে উপকৃত করার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্ডারের অনারারি নাইট কমান্ডার নিযুক্ত করেছিলেন।
বই লেখা এবং অন্যান্য কাজ সমূহ, Writing books and various activities
মাইকেল ব্লুমবার্গ এবং ম্যাথিউ উইঙ্কলার একসাথে এক আত্মজীবনী লিখেন, যার নাম রাখা হয় “ব্লুমবার্গ বাই ব্লুমবার্গ”, এটি উইলি প্রকাশনার দ্বারা ১৯৯৭ সালে প্রকাশ করা হয়েছিল।
ব্লুমবার্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে, অর্থাৎ ২০১৯ সালে উক্ত জীবনীর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালে মাইকেল ব্লুমবার্গ এর আরো একটি বই প্রকাশিত হয়, যার সহ-লেখক ছিলেন সিয়েরা ক্লাবের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কার্ল পোপ। বইটির নাম ‘ক্লাইমেট অফ হোপ : হাউ সিটিস, বিজনেস এবং সিটিজেনস ক্যান সেভ দ্য প্ল্যানেট”, বইটি সেন্ট মার্টিন প্রেস দ্বারা প্রকাশিত হয়। এসব ছাড়াও মাইকেলের আরো বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন শিক্ষামূলক তথা সচেতনতা প্রসারের বিষয়েও লিখেছিলেন।
মাইকেল ব্লুমবার্গ এর সম্পদ, Property of Michael Bloomberg
ফোর্বস ম্যাগাজিনে ২০০৯ সালের মার্চ মাসে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী মাইকেল ব্লুমবার্গের সম্পদের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার, উক্ত সালে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। তিনি দুই বছরের ব্যবধানে বিশ্বের বিলিয়নারি ফোর্বসের তালিকায় ১৪২ তম থেকে ১৭ তম স্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস অবধি তিনি বিশ্বের নবম ধনী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য ছিলেন।
উপসংহার, Conclusion
মাইকেল ব্লুমবার্গ বহু অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি বহু জনহিতৈষী কর্মের মাধ্যমে নিজের দেশ তথা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছেন। ব্যবসায়ী বলা হোক কিংবা রাজনীতিবিদ, দুই ক্ষেত্রেই তিনি নিজের ছাপ রেখেছেন এবং সর্বদাই জনস্বার্থে কাজ করার চেষ্টা করেছেন, তাই তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা স্বরূপ।
Frequently Asked Questions :
মাইকেল ব্লুমবার্গ মার্কিন সাম্রাজ্যের এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে একজন মার্কিন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী তথা লেখক
১৯৪২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
ব্লুমবার্গ এল.পি।