একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কণ্ঠশিল্পী ও সংগীতকার হলেন নচিকেতা চক্রবর্তী। আধুনিক বাংলা গানের ধারার এক অগ্রগণ্য শিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয় তাঁকে।
নচিকেতার গানের মধ্য দিয়ে যেন বাস্তবতা খুব সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে, সেজন্যই শ্রোতা মহলে তিনি প্রভূত জনপ্রিয়। বলাই বাহুল্য তিনি একক অ্যালবামের মধ্য দিয়েই যথেষ্ট জনপ্রিয়তার অধিকারী হয়ে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু বাংলা সিনেমায় তাঁর গান প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে লেখক হিসেবেও তাঁর বেশ সুনাম রয়েছে।
নচিকেতা চক্রবর্তী জন্ম ও শৈশবকাল, Nachiketa Chakraborty birth and childhood
সঙ্গীত শিল্পী নচিকেতার জন্ম হয় ১৯৬৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশালের ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া উপজেলার চেচরীরামপুর গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন সখা রঞ্জন চক্রবর্তী। পড়াশোনা করেছেন উত্তর কলকাতা স্থিত মণীন্দ্র কলেজে। তবে পড়াশুনার পাশাপাশি গানের সাথেও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন অনেক কম বয়স থেকেই।
গানের জগতে নচিকেতার আত্মপ্রকাশ, Nachiketa’s debut in the world of music
নচিকেতা চক্রবর্তী ছোটবেলা থেকেই গান লেখা শুরু করেন, পাশাপাশি নিজের মতো করে গান চর্চাও করতেন তিনি। উত্তর কলকাতার মণীন্দ্র কলেজে পড়া গানপাগল ছেলে নচিকেতা চক্রবর্তী। তাঁর জনপ্রিয়তা শুরু হয় ‘এই বেশ ভালো আছি’ গানের অ্যালবামের সাথে। ১৯৯৩ সালে এই অ্যালবামের মাধ্যমে তিনি জীবনমুখী বাংলা গানের অতি পরিচিত এক সুরসৈনিক হয়ে ওঠেন। সেই থেকে একনামেই তাঁকে চেনে সবাই, পদবীটার আর যেন দরকার পড়ে নি তেমন।
এরপর শুধু সাফল্যের ইতিহাস। পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কখনও। এখনও পর্যন্ত তিনি তিনশত-এরও বেশি গান রচনা করেছেন এবং সেই গানগুলোতে সুর দিয়েছেন। চলিত ভাষার ব্যবহারের কারণেই হয়তো তিনি নব্বইয়ের দশকে বাংলা সঙ্গীতের নিশ্চল অবস্থায়ও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হন।
নচিকেতার একক অ্যালবামের তালিকা, List of solo albums by Nachiketa
- এই বেশ ভালো আছি (১৯৯৩)
- কে যায়? (১৯৯৪)
- কী হবে? (১৯৯৫)
- চল যাবো তোকে নিয়ে (১৯৯৬)
- কুয়াশা যখন (১৯৯৭)
- আমি পারি (১৯৯৮)
- দলছুট (১৯৯৯)
- দায়ভার (২০০০)
- একলা চলতে হয় (২০০২)
- এই আগুনে হাত রাখো (২০০৪)
- আমার কথা আমার গান (২০০৫)
- তীর্যক(২০০৭)
- এবার নীলাঞ্জন (২০০৮)
- হাওয়া বদল (২০১০)
- সব কথা বলতে নেই (২০১২)
- দৃষ্টিকোণ (২০১৪)
- আয় ডেকে যায় (২০১৫)
তবে উপরে উল্লেখিত অ্যালবামগুলো ছাড়াও, ২০১৭ সালের ২৩ জুন নচিকেতার ‘বেঁচে থাকার মানে’ নামে একটি নতুন একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়, যেখানে তাঁর নিজের লেখা কোনো গান নেই।
স্পষ্টতই পূর্বের অ্যালবামগুলোতে গানগুলো তিনি নিজেই লিখেছিলেন। কিন্তু এবারে বাংলাদেশের গীতিকবি জুলফিকার রাসেলের লেখা গান নচিকেতার কণ্ঠে-সুরে মিলিত হয়ে তৈরি হয় এই অ্যালবামটি। এতগুলো অ্যালবাম নিজে লেখার গান নিয়ে হওয়ার পর কেউ হয়তো ভাবেন নি যে এই সুপ্রতিষ্ঠিত গায়ক অন্যের লেখা গানে অ্যালবাম প্রকাশ করবেন। তবে হঠাৎ করে অন্যের কথায় গান গাইবার কারণ হিসেবে নচিকেতা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেন,
“দেখুন আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি- ঢাকায় খুব বেশি গান লেখার মানুষ নেই। আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। যে দু’একজন আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম জুলফিকার রাসেল। তার আসলে গানটা লেখা হয় কিংবা আমি যা চাই তা তার লেখায় সেটা খুঁজে পাই। সেজন্যই গেল ক’বছর ধরে আমরা নিয়মিত গান করে আসছি নিজেদের খেয়ালে। আমাদের সেই যৌথ ভাণ্ডার থেকে এবার সাতটি গান দিলাম। দুই বাংলার ভালো লাগবে- আশা তো করতেই পারি।”
লেখক হিসেবে নচিকেতার কাজ, Nachiketa Chakraborty as a writer
জ্যাক লন্ডন এর লেখা পড়ে নচিকেতা লেখা-লেখির ক্ষেত্রে প্রথম অনুপ্রাণিত হন। এছাড়া মহাভারতের কৃষ্ণের চরিত্র তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। অন্যদিকে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁকে গল্প লেখার জন্য অনুপ্রাণিত করেন।
- কবিতা :আমাকে দে
- গল্প :শর্টকাট, পণ্ডশ্রম, অদ্বৈত, স্বোপার্জিত,ছায়াগজৎ,আগুনপাখির আকাশ, ঘুম, সাপলুডো, অভিযোজন, যমের অরুচি, অস্তচলের দুর্গ
- রম্যরচনা : আমার দেখা সবচেয়ে বড় গণেশ পলিটব্যুরো, ‘এজ্ঞে, দু-গালে চড় মারার পর…’, সুভাষদা জিতে গেলেন, অমল রুদ্র, I LUV কখগ > 1111, চাপে ছোট মাপে বড়
- উপন্যাস : ক্যাকটাস, জন্মদিনের রাত
নচিকেতার কর্মজীবনের অন্যান্য দিক, Other aspects of Nachiketa’s career
শুধু বাংলা গান নয় বরং বেশ কিছু হিন্দি গান তথা অন্যান্য ভাষায়ও বেশ কয়েকটি গান গেয়েছেন সুপরিচিত গায়ক নচিকেতা। অন্যদিকে একক অ্যালবাম ছাড়াও বেশ কয়েকটি যৌথ অ্যালবাম এবং সিনেমার গানও গেয়েছেন তিনি। সেই সুবাদে বেশ খ্যাতিও অর্জন করেছেন। যেমনঃ “হঠাৎ বৃষ্টি” (১৯৯৮) ছবিতে সংগীত পরিচালক এর পাশাপাশি সংগীত শিল্পী হিসেবেও কাজ করেন তিনি। উক্ত ছবির প্রায় প্রতিটি গানই প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
এমনকি এই ছবির গানগুলোর জনপ্রিয়তা আজও আছে। এছাড়াও কিছু ছবিতে তিনি অভিনেতা হিসেবেও কাজ করেন। যেমনঃ কাটাকুটি, খেলাঘর, এই বেশ ভালো আছি, কে যায় ও কুয়াশা যখন ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বাংলা সারেগামাপা শো তে বিচারকের দায়িত্ব পালন করছিলেন ২০২০ সালে।
বাংলা সিনেমায় নচিকেতার গান, Nachiketa songs in Bengali movies
- প্রজাপতি (১৯৮০)
- ধুলো আর ধোঁয়া মাখা
- প্রজাপতি হতে চায় যদি মন
- সেদিন চৈত্রমাস (১৯৯৭)
- ওই যে পথে উড়ছে ধূলো
- আমি তো ছিলাম
- দূরে তেপান্তর
- এবং তুমি আর আমি (১৯৯৭)
- তিন তালে নেচে ওঠে মন
- আমার মনের এই শুণ্য খাতাতে
- পাখিদের কুহুতান
- মনে মনে যারে আমি চাইরে
- হে কার ইশারায়
- আনমনে যারে আমি চাই রে
- হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৮)
- ছোট ছোট স্বপ্নের দিন
- একদিন স্বপ্নের দিন
- সোনালী প্রান্তরে
- ঘুম আসে না
- চুপি চুপি (২০০১)
- দিন যায় দিন চলে যায়
- খেলাঘর (১৯৯৮)
- মাটির ভাঁড়েতে চা
- স্বপ্নের শহর
- কখনো কখনো কি মনে করে হায়
- বুকের ভেতর সাতটা সাগর
- আজ বদলে বদলে গেছে
- এই যে আঁকাবাঁকা পথে
- বৃষ্টির জল হয়ে
- চৌধুরী পরিবার (১৯৯৮)
- আমি হিরু
- মন বলে যায়
- অনুপমা (১৯৯৯)
- মোনালিসা নয়
- চাকা (২০০০)
- দুলছে মাটি
- হাতের মুঠোয়
- চোর ও ভগবান (২০০৩)
- চোর চোর
- তু মেরি জান
- একে এক দুই হয়
- স্বপ্নের শহর (২০০১)
- আজ বদলে গেছে দেন
- আমাদের জন্য
- দিন যায় দিন চলে যায়
- ফেরিওয়ালা
- মাথা দেবনা
উক্ত গানগুলো ছাড়াও আরো বেশ কিছু সিনেমায় গান গেয়েছেন নচিকেতা।
সেগুলি হল : তুমি কখনো শুনেছ কি?, রাস্তা (২০০৩), মেজদিদি (২০০৩), সমুদ্রসাক্ষী (২০০৪), পাহাড়ে পথ হাঁটলে, আবার আসব ফিরে (২০০৪), জীবনের মশালে আগুন জ্বেলে দাও, কালো চিতা (২০০৪), কিসনে কাল দেখা মেরি জান, রং নাম্বার (২০০৪), তুমি যদি চাও একবার, The BONG CONNECTION (২০০৬), পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, দশ দিন পরে (২০০৭), কিছু রঙ, ভালো আর মন্দতে, চলো, Let’s Go (২০০৮), অ্যামেজিং গ্রেস, খেলা (২০০৮), পালাচ্ছে দিন রাত্রি, ১০:১০ (২০০৮), বনলতা, শাঁখা সিঁদূরের দিব্বি (২০০৮), হাসিখুশি ক্লাব (২০০৯), MADLY বাঙালি (২০০৯), কে আছ কোথায়, সঙ্গীত পরিচালক, হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৮), সমুদ্র সাক্ষী (২০০৪), হোম – দ্য ইউনিটি (অপ্রকাশিত) (২০০৯), গো ফর গোল (২০০৯), কাটাকুটি( ২০১২)।
অভিনেতা হিসেবে নচিকেতার কাজ, Nachiketa’s career as an actor
শুধু গান বা লেখা-লেখি নয়, বরং অভিনেতা হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। বেশকিছু গানের ভিডিওতে তাঁকে অভিনয় করতেও দেখা যায়। সেই গানগুলো হল ; ভালো আছি (১৯৯৩), কে যায় (১৯৯৪), কুয়াশা যখন (১৯৯৭), খেলা (২০০৮), কাটাকুটি (২০১২)।
নচিকেতার প্রাপ্ত পুরস্কার সমূহ, Awards and recognition
নচিকেতা সঙ্গীতকার তথা সুরকার হিসেবে বেশ কিছু পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: বঙ্গভূষণ, সঙ্গীতভূষণ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বহু সরকারি-বেসরকারি সম্মান লাভ করেছিলেন।
উপসংহার, Conclusion
নচিকেতার গান পছন্দ করেন না এমন মানুষ হয়তো কমই আছেন। তাঁর বহু গান এমনও আছে যেগুলোর কথার সাথে শ্রোতারা নিজের জীবনের বাস্তবিক অবস্থার মিল খুঁজে পান। তাই হয়তো তাঁর অনুরাগীর সংখ্যাও অনেক। আশা করা যায় যে নচিকেতার এই গানের ধারা অব্যাহত থাকবে বছরের পর বছর।
Frequently Asked Questions:
১৯৬৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর।
‘এই বেশ ভালো আছি’
‘বেঁচে থাকার মানে’