বাংলা চলচ্চিত্র জগতে বিগত দুই দশক ধরে এক নম্বর অভিনেত্রীদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। তিনি শুধুমাত্র বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতেই নয় বরং একাধিক বাংলাদেশী এবং হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। সেই সুবাদে তাঁর জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র ভারতেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশেও। তিনি দর্শকদেরকে একাধিক সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন। ঋতুপর্ণার অভিনয় প্রতিভা হাজার হাজার মানুষের মন জয় করেছে।
জন্ম ও পরিবার পরিচিতি, Rituparna Sengupta birth and family
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের জন্ম হয় ১৯৭১ সালে ৭ই নভেম্বর। তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম প্রবীর সেনগুপ্ত এবং মায়ের নাম নন্দিতা সেনগুপ্ত।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের শিক্ষাগত যোগ্যতা, Rituparna Sengupta education
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত শৈশবকাল থেকেই একজন মেধাবী ছাত্রীর পাশাপাশি অভিনয়, নৃত্য, অঙ্কন এবং হাতের কাজেও পটু। ঋতুপর্ণা মাউন্ট কারমেল স্কুল থেকে শিক্ষা অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ ভর্তি হন, সেখান থেকে তিনি ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।
স্নাতক শেষে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগে ভর্তি হন, যেখানে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়াও ঋতুপর্ণা খুব কম বয়সেই চিত্রাংশু নামে একটি শিল্পবিদ্যালয় থেকে নৃত্য, হাতের কাজ এবং অঙ্কন শেখেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর তিনি বিভিন্ন ধারাবাহিক ও সিনেমায় অভিনয়ের জন্য অডিশন দিতে শুরু করেন, সেই থেকেই অভিনেত্রী হওয়ার দিকে তাঁর জীবনের পথ চলা শুরু হয়।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের অভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতার গল্প, Rituparna Sengupta acting career
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বাংলা ধারাবাহিকের মাধ্যমে অভিনয় জীবন শুরু করেন। একসময়ের জনপ্রিয় বাংলা ধারাবাহিক “সাদা পায়রা” এর মধ্য দিয়ে টিভির পর্দায় তাঁর আবির্ভাব ঘটে। তাছাড়া অভিনেতা কুশল চক্রবর্তীর বোন অনিন্দিতা পাল ছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর সহপাঠী যার সুবাদেই ১৯৮৯ সালে তিনি ‘শ্বেত কপোত’ বাংলা ধারাবাহিকে কাজ করার সুযোগ পান।
এই ধারাবাহিকগুলোতে তাঁর অভিনয় সবার নজরে আসে। এরপরে তিনি ‘সীমানা ছাড়িয়ে’ ও ‘হরতনের গোলাম’ নামক ধারাবাহিকে কাজ করেছিলেন। ১৯৯১ সালে ঋতুপর্ণার বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ ঘটে। তিনি, বিজয় ভাস্করের ওড়িয়া চিত্র “কোতিয়া মনিষ গতিয়ে জাগা” ছবির মাধ্যমে বড় পর্দায় কাজ করতে শুরু করেন। ক্রমে ১৯৯২ সালে তিনি নিজের প্রথম বাংলা সিনেমা ‘শ্বেতপাথরের থালা’ -র জন্য প্রস্তাব পান এবং ছবিটি ভালো সাফল্য অর্জন করে।
প্রথম ছবিতেই তিনি তাঁর অভিনয়ের জন্য প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন। এরপর থেকেই তাঁর ক্যারিয়ার জীবন উন্নতির দিকে পা বাড়িয়ে দেয়। বলতে গেলে প্রথম ছবির পর থেকে তাঁকে ক্যারিয়ার জীবনে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর থেকে একাধিক ছবিতে অভিনয়ের জন্য ডাক পেয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেন বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, তাপস পাল, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, অভিষেক চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ স্বনামধন্য অভিনেতাদের সাথে কাজ করেছেন।
এছাড়া তিনি মুম্বাইয়েও হিন্দি ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান, যেখানে তিনি হেমা মালিনীর সাথে ‘মোহিনী’ নামে একটি টেলিফিল্ম করেছিলেন। উক্ত ছবি ছাড়াই আরো কিছু হিন্দি ছবিতে তাঁকে অভিনয় করতে দেখা যায়। ঋতুপর্ণার কর্মজীবনে তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘শ্যামা’, ‘মায়ার খেলা’ প্রভৃতি নৃত্যনাট্যও প্রভূত খ্যাতিলাভ করেছে।
অন্যদিকে তিনি বাংলাদেশী ছবিতেও কাজ করেন। বাংলাদেশের ছবিতেও তিনি নিজের দুর্দান্ত অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন তাই বাংলাদেশেও ঋতুপর্ণার ভক্তের সংখ্যাও প্রচুর। তাই তাঁকে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির এক নম্বর অভিনেত্রী বললেও খুব ভুল হবে না। তাঁর অধিকাংশ সিনেমা অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
এখনো পর্যন্ত তিনি বহু বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং তার অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে। ২০১৬ সালে তিনি ‘প্রাক্তন’ চলচ্চিত্রে কাজ করেন, যেখানে দীর্ঘ সময়ের বিরতির পর আবার প্রসেনজিৎ ও ঋতুপর্ণাকে জুটি বাঁধতে দেখা যায়। তাঁর অভিনীত ‘ দত্তা ‘ মুক্তি পায় ২০২৩ সালে। এভাবেই তিনি বছর বছর ধীরে অভিনয় জগতে নিজেকে সক্রিয় রাখছেন এবং তাঁর জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন।
অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত জীবন, Rituparna Sengupta personal life
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ১৯৯৯ সালে নিজের শৈশব প্রেমিক সঞ্জয় চক্রবর্তীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দম্পতি তাদের বৈবাহিক জীবনে বেশ সুখী; তাদের দুই সন্তান, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে, ছেলের নাম অঙ্কন এবং কন্যার নাম নীয়া।
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের পুরস্কার প্রাপ্তি, Awards and recognition of Rituparna Sengupta
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত নিজের অভিনয় জীবনে বহুবার ভিন্ন সব পুরস্কারে ভূষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৯৫ সালে প্রাপ্ত ভারত নির্মাণ পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে প্রাপ্ত কলাকার পুরস্কার এবং কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবার্ষিকী পুরস্কার, এছাড়াও তিনি ১৯৯৮ সালে দহন ছবির জন্য ৪২তম ভারতীয় জাতীয় চলচ্চত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
২০০০ সালে তিনি ‘দহন’ ছবির জন্য উজালা আনন্দলোক শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার লাভ করেন, একই সালে তিনি ‘আত্মীয়স্বজন’ ছবির জন্য উজালা আনন্দলোক শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার লাভ করেন, পরবর্তীতে ২০০৬ সালে ঋতুপর্ণা তাঁর অভিনীত ‘দ্বিতীয় বসন্ত’ ছবির জন্য বিএফজেএ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার লাভ করেছেন।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের অভিনীত চলচ্চিত্র সমূহ, List of films acted by Rituparna Sengupta
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বাংলা এবং হিন্দি উভয় ভাষার সিনেমার ক্ষেত্রেই কাজ করেছেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্র তালিকায় উল্লেখযোগ্য হল : শ্বেত পাথরের থালা, মোহিনী, দহন, পারমিতার একদিন, উৎসব, কালি টোপি লাল রুমাল, সবসে বড়কর কৌন, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, আলো, কালো চিতা, নিশিযাপন, ম্যায় মেরি পত্নী অর ওহ্, তপস্যা ,অনুরনন, অন্ধকারের শব্দ, গৌরী, চাঁদের বাড়ি, ম্যায় ওসামা, আয়নাতে, চতুরঙ্গ, ফেরা, লাভ খিচড়ি, এস আর কে, ফক্স, ডু নট ডিস্টার্ব, ফুটপাথ, মহানগর কলকাতা, রহমত আলি, আরোহন, বেদিনী, দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি, নেকলেস, আগুন পাখি, চারুলতা, আলাপ, মুক্তধারা, মিসেস সেন অলীক সুখ, তিন কন্যা, বেলা শেষে, রাজকাহিনী, প্রাক্তন, টান, দৃষ্টিকোন, সিঁদুরের অধিকার, শেষ চিঠি, চক্রব্যুহ, দ্বিতীয় বসন্ত ইত্যাদি।
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য জেনে নিন, Special information about Rituparna Sengupta
- প্রিয় অভিনেতাঃ শাহরুখ খান, মিঠুন চক্রবর্তী
- প্রিয় অভিনেত্রীঃ বিপাশা বসু
- প্রিয় রঙঃ লাল, নীল
- প্রিয় খাবারঃ মাছ, মিষ্টি দই, রসগোল্লা
- শখঃ নাচ, ব্যাডমিন্টন খেলা
- উচ্চতাঃ ৫.৫ ফুট
- ওজনঃ ৬৫ কেজি
- চুলের রঙঃ কালো
- চোখের রঙঃ ডার্ক ব্রাউন
- ঋতুপর্ণা লেখক হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাত , তিনি আনন্দলোক ও বাংলাদেশের হৃদয় পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কলামও লিখেছেন।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের জনহিতৈষী কাজ, Philanthropic work of Rituparna Sengupta
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত শুধু যে একজন প্রতিভাবান অভিনেত্রী তাই নয়, তিনি বরাবরই একজন জনহিতৈষী সেলিব্রেটিও। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে ঋতুপর্ণাকে বিভিন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছে। যদিও করোনাকালে তিনি পরিবারের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে থেকেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মানুষের জন্য কাজ করতে কখনো পিছ-পা হননি। তিনি বিভিন্ন অনলাইন শো এর মাধ্যমেও মানুষের মন ভালো রাখার চেষ্টা করে গেছেন।
উপসংহার, Conclusion
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত টলিউডের একজন অসাধারণ অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই সুবাদে তিনি এপার বাংলার পাশাপাশি ওপার বাংলায়ও যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। নিজের সৌন্দর্য এবং অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি চলচ্চিত্র জগতে অসামান্য অবদান রেখেছেন এবং জীবনে বিভিন্ন সময় প্রচুর পুরষ্কার অর্জন করেছেন যা তাকে দেশজুড়ে কিংবদন্তি অভিনেত্রী করে তুলেছে। আশা করা যায় তাঁকে ভবিষ্যতেও আরো ভালো কিছু ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যাবে।
Frequently Asked Questions
১৯৭১ সালে ৭ই নভেম্বর।
সঞ্জয় চক্রবর্তী।
দত্তা