রোজী আফসারী জীবনী, Biography of actress Rosy Afsari in Bengali 

রোজী আফসারী জীবনী

বাংলা চলচ্চিত্র অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন রোজী আফসারী। মহীয়সী নারী চরিত্র হোক বা বাদশাহ মহলের নির্বাসিত বেগম কিংবা পরম শ্রদ্ধেয় বড় বোনের চরিত্রে অভিনয়, সব ক্ষেত্রেই দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন এই কিংবদন্তি অভিনেত্রী।

কখনো নায়িকা, কখনো বড় বৌদি, মা কিংবা বিধবা চরিত্রে প্রাণবন্ত অভিনয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রের একসময়কার অন্যতম দাপুটে অভিনেত্রী ছিলেন রোজী আফসারী। মুগ্ধ করেছেন বাংলাদেশের সিনেপ্রেমীদেরকে। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়-শৈলীতে সবার মন জয় করেছিলেন তিনি।

রোজী আফসারীর আসল নাম, Real name of Rosy Afsari

স্বর্ণালি যুগের মায়াবী এই অভিনেত্রীর প্রকৃত নাম শামীমা আক্তার রোজী, কিন্তু এক সময় রোজী সামাদ নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে নিজের নামের শেষে স্বামী মালেক আফসারীর নামের পদবী ব্যবহার করে তাঁর নাম হয়ে ওঠে রোজী আফসারী। 

রোজী আফসারীর আসল নাম

জন্ম ও পারিবারিক সম্পর্ক, birth and family

শামীমা আক্তার রোজীর জন্ম হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ এপ্রিল। তিনি লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের শমসেরাবাদ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। অভিনেত্রীর বাবা কবি ওয়ালিউল্লাহ, পেশায় একজন ঠিকাদার ছিলেন।

অন্যদিকে মা হাসনাহেনা আকতারী বেগম একজন সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন রোজী। মধ্যম বোন শিরিন আখতার বেবী জড়িত ছিলেন সংস্কৃতি অঙ্গনের সঙ্গে। ভাই হাসান শহীদ বাবুও চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এক সময়।

রোজী আফসারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, Rosy Afsari educational qualification 

রোজী আফসারী কাকরাইলের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার- এ পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন ভিকারুন্নেছা নূন স্কুলে। স্কুলে পড়ার সময়ই চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে তাঁর। তাই পড়াশুনা আর চালু রাখতে পারেন নি তিনি।

রোজী আফসারীর অভিনয় জীবন, Rosy Afsari’s acting career 

রোজী আফসারীর অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৬২ সালে এবং ২০০৫ সালে তাঁর অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘পরম প্রিয়’ মুক্তি পায়। এরপর থেকে অসুস্থতার কারণে তিনি আর কোনো ছবিতে কাজ করতে পারেন নি।

১৯৬২ সালে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি যুগের অভিনেত্রী রোজী আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত ‘জোয়ার এলো’ ছবিতে অভিনয় করার মাধ্যমে সিনেমা জগতে প্রবেশ করেন। তবে তিনি এই ছবির মধ্য দিয়ে তেমন জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেন নি। তবে নারায়ণ ঘোষ পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে অভিনয় করে তিনি প্রভূত প্রশংসা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর থেকে একের পর এক সুপারহিট ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান তিনি।     

রোজী আফসারীর অভিনয় জীবন

অভিনয় জীবনের শুরুর দিকে একটি ছবিতে জাদরেল ঘরণীর চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন রোজী। এরপর বেশ কিছু ছবিতে কোমল, মোহনীয় রূপে মুগ্ধ করেছেন বহু মানুষকে। তবে অভিনয়ের দিক থেকে সংগ্রামী নারীর প্রতিভু চরিত্রে রোজী যেন এক বিস্ময়। উক্ত চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে তিনি এতোটাই ডুবে যেতেন যে তাঁর চোখ, মুখে যেন আগুন দেখা যেত, আর এর সার্থক প্রতিফলন দেখা যায় লাঠিয়াল, আমার সংসার, ওমর আকবর, তিতাস একটি নদীর নাম – ইত্যাদি চলচ্চিত্র সমূহে।    

রোজী তাঁর অভিনয় জীবনে প্রায় ৪ দশক ধরে ৩৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বাংলা ছবি ছাড়া পাকিস্তানের বেশ কিছু উর্দু ছবিতেও কাজ করেন তিনি, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য হল : ‘জাগো হুয়া সাবেরা’, ‘পুনম কি রাত’ ইত্যাদি।

প্রায় ২৫টি উর্দু ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। রোজী অভিনীত সেরা বাংলা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সূর্য গ্রহণ’, ‘সূর্য সংগ্রাম’, ‘জীবন থেকে নেয়া’। এছাড়া অন্যান্য কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে ‘ওরা ১১ জন’, ‘এতটুকু আশা’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘প্রতিকার’ ইত্যাদি। আশির দশকে বেশ কিছু ছবিতে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন রোজী আফসারী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল  ‘জোয়ার ভাটা’, ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘ছোট মা’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘মহেশখালীর বাকে’, ‘জুলি’।

সিনেমার ক্ষেত্রে বেশ নামী পরিচালকদের সাথে কাজ করেছেন তিনি। তবে অভিনেত্রী রোজী নারায়ণ ঘোষ মিতা ও এজে মিন্টুর পরিচালনায় সর্বাধিক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীতে স্বামী মালেক আফসারীর সাথেও প্রচুর ছবিতে কাজ করেন তিনি। বিভিন্ন ছবিতে জুটি হিসাবে রোজী আফসারী সাথে অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, খলিল ও শওকত আকবর এবং বুলবুল আহমেদকে দেখা গেছে বেশি, এই জুটিগুলো দর্শকরাও খুব পছন্দ করেছেন। 

বৈবাহিক জীবন, Married Life

১৯৮১ সালে দেশবরেণ্য চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্রকার এম এ সামাদ এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন রোজী, সেই থেকে তিনি রোজী সামাদ হিসেবে পরিচিত হন। তাদের একটি মেয়ে আছে, যার নাম কবিতা সামাদ। কিন্তু এই বিয়ের সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। এরপর রোজী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন।

বৈবাহিক জীবন

চার দশকের বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে নিজের দ্যুতি ছড়িয়ে রাখা এ অভিনেত্রী ১৯৮৫ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা মালেক আফসারীকে বিয়ে করেন। স্বামী মালেক ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়াশুনা শেষ করে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেছিলেন। মালেক আফসারী বয়সে অভিনেত্রীর থেকে ২০ বছরের ছোট ছিলেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে এক সন্তান হয়, যায় নাম রবি আফসারী। 

রোজী ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত ছবি, films produced under the banner of Rosy Films

দ্বিতীয় বার বিয়ে করার পর অভিনয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে রোজী আফসারী নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন, যার নাম ছিল ‘রোজী ফিল্মস’; উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে অসংখ্য ছবি প্রযোজনা করেছেন তিনি। রোজী ফিল্মসের ব্যানারে ‘ধনী-গরীব’, ‘ক্ষতিপূরণ’,’ ক্ষমা’, ‘ঘৃণা’, ‘এই ঘর এই সংসার’ প্রভৃতি সিনেমা নির্মিত হয়। ১৯৮৬ সালে প্রথমবার নারী চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রোজী আফসারী। সে বছর রোজীর পরিচালনায় চলচ্চিত্র ‘আশা নিরাশা’ মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটির কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন রোজীর স্বামী মালেক আফসারী।

রোজী ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত ছবি

নৃত্য পরিচালক হিসেবে কাজ ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, Work and travel experience as a dance director

চার দশকের অভিনয় ক্যারিয়ারে অভিনয় করার পাশাপাশি বেশ কিছু ছবিতে নৃত্য পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন রোজী। এছাড়াও রোজী আফসারী অভিনয় সূত্রে লন্ডন, সুইডেন, মিসর, সিরিয়া, কানাডা, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছেন।  

চার দশকের অভিনয় ক্যারিয়ারে অভিনয় করার পাশাপাশি বেশ কিছু ছবিতে নৃত্য পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন রোজী

পুরস্কার প্রাপ্তি, awards and recognition

কর্মজীবনে বহু পুরস্কার লাভ করেছিলেন রোজী। ‘লাঠিয়াল’ ছবিতে অভিনয় করে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে ১৯৭৫ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

কর্মজীবনে বহু পুরস্কার লাভ করেছিলেন রোজী

এছাড়াও তিনি ১৯৭২-৭৫ সাল অবধি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। অন্যদিকে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে তিনি জিয়া স্বর্ণপদক, স্বদেশ সাংস্কৃতিক স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি পুরস্কার, এফডিসির রজত জয়ন্তী পুরস্কার, বাচসাস, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার, কালচারাল রিপোর্টাস অ্যাওয়ার্ড, অনির্বাণ সংসদ স্বাধীনতা পদক, মহিলা চিত্রপরিচালক হিসেবে সিডাব পুরস্কার এবং পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নিগার’সহ দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০টি পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন রোজী আফসারী।

রোজী আফসারীর জীবনাবসান, Rosy Afsari’s death

কিংবদন্তির মৃত্যু নেই। অভিনেত্রী আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু সকলের হৃদয়ে তিনি এখনো একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন রোজী আফসারী।

অসুস্থতায় তাঁর কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। চার বছর ধরে তিনি এই নষ্ট কিডনি দুটো নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। ২০০৭ সালের ৯ মার্চ মাত্র ৫৭ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। 

শেষ কথা, Conclusion 

বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসের ‘সুবর্ণ যুগ’ খ্যাত সময়ের দাপুটে ও প্রভাবশালী নায়িকা ছিলেন রোজী। সকলের প্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন রোজী আফসারী। তিনি আজ সশরীরে আমাদের মাঝে না থাকলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাকাশে এক অনন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েই অগণিত মানুষের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। 

Frequently Asked Questions

রোজীর জন্ম কবে হয় ?

১৯৪৯ সালের ২৩ এপ্রিল। 

রোজী আফসারীর স্বামী কে ?

মালেক আফসারী।

রোজী আফসারীর প্রথম ছবি কোনটি ?

১৯৬২ সালে আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত ‘জোয়ার এলো’ ছবি।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts