শহীদ আসাদ- বাঙালির চেতনায়, Biography of Shahid Asad in Bengali

শহীদ আসাদ- বাঙালির চেতনায়

আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ছিলেন বাংলার একজন শহীদ ছাত্রনেতা; আইয়ুব খানের পতনের দাবীতে তিনি মিছিল করার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। সর্বসমক্ষে তিনি শহীদ আসাদ নামেই অধিক পরিচিত। আজ এই প্রতিবেদনে আমরা তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবো।

শহীদ আসাদের পরিবার পরিচয়, Shahid Asad family 

আসাদের জন্ম হয় ১৯৪২ সালের ১০ জুন। তিনি নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামের হাতিরদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। আসাদের পিতার নাম আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ পেশাগত দিক থেকে আবু তাহের বি.এ.বি.টি হাতিরদিয়া সাদত আলী হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা তথা হেডমাষ্টার ছিলেন।

অন্যদিকে আসাদের মায়ের নাম মতি জাহান খাদিজা খাতুন, যিনি পেশায় নারায়নগঞ্জ আই.ই.টি (ইসলামি এডুকেশন ট্রাষ্ট) গার্লস প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। আসাদের জন্ম হওয়ার পর তিনি শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে দেন। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আসাদ ছিলেন চতুর্থ।

শহীদ আসাদের শিক্ষা জীবন, Shahid Asad education 

শহীদ আসাদ শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ও এমসি কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে স্নাতক কোর্সে ভর্তি হয়ে ১৯৬৬ সালে বি.এ এবং ১৯৬৭ সালে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন আসাদ।

উক্ত বৎসরেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সাথে যুক্ত হন আসাদ; এছাড়াও কৃষক সমিতিকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে কৃষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষাণী’র নির্দেশনায় শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা এবং নরসিংদী এলাকায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা’র সিটি ল কলেজে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো এম.এ বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। মৃত্যুকালীন সময়ে অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এম.এ ডিগ্রির শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

শহীদ আসাদের শিক্ষা জীবন

শহীদ আসাদ তৎকালীন ঢাকা হল অর্থাৎ বতর্মানে যে হলটি শহীদুল্লাহ হল নামে পরিচিত, তার একটি শাখা পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান এছাড়াও পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (ইপসু-মেনন গ্রুপ) ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। গরিব ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার বিষয়ে সর্বদাই সজাগ ছিলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত প্রাণ আসাদুজ্জামান।

তিনি শিবপুর নৈশ বিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদেরকে সাথে নিয়ে শিবপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আর্থিক তহবিল গড়ে তোলেন।

শহীদ আসাদ দিবস জানুয়ারি ২০, ১৯৬৯, Shahid Asad Day January 20, 1969

আন্দোলনের পটভূমি

অনেকেই হয়তো ভেবে থাকেন যে আসাদের মৃত্যু এত গুরুত্বপূর্ণ কেন ! তবে জেনে নিন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবীর স্বপক্ষে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্যান্য আসামীদের মুক্তি দাবীর আন্দোলনে আসাদের মৃত্যু পরিবেশকে আরও ঘোলাটে করে তোলে এবং সেই সময়কালের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় রূপান্তরিত হয় এই মৃত্যু। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষাণী’র হরতাল আহ্বানে ব্যবসায়ীরা পূর্ণ সমর্থন জানায়। এই প্রেক্ষাপটে গভর্নর হাউজ ঘেরাও করার ফলে ছাত্র সংগঠনগুলো নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়।

১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখে ছাত্রছাত্রীদের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবীর সাথে ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ একাত্মতা পোষণ করে, যাতে প্রধান ভূমিকা রাখেন শহীদ আসাদ। ওই সালের ১৭ জানুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ছাত্ররা দেশব্যাপী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ডাক দেয়, যার ফলে গভর্নর হিসেবে ১৪৪ ধারা আইন জারী করেন মোনেম খান, যাতে চার জনের বেশি লোক এই বন্ধ (Bandh) সফল করার জন্য একত্রিত হতে না পারে।

শহীদ আসাদ দিবস জানুয়ারি ২০, ১৯৬৯

মিছিলে গুলিবর্ষণ এবং আসাদের মৃত্যু, Shooting at the rally and Asad’s death

১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি তারিখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘পুলিশের গুলীতে ছাত্র নিহত’ শিরোনাম দিয়ে আসাদের মৃত্যুর খবর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে,  দুপুরে মিছিল বের হয়, ছাত্রদেরকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পার্শ্বে চাঁন খাঁ’র পুল এলাকায় মিছিল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন আসাদুজ্জামান। পুলিশ তাদেরকে সেই ব্রীজে বাধা দেয় এবং সেখান থেকে ফিরে চলে যেতে বলে। কিন্তু বিক্ষোভকারী ছাত্ররা সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আন্দোলন করতে থাকে। 

আসাদ ও তার সহযোগীরা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। ঐ অবস্থায় আসাদকে লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে এক পুলিশ অফিসার গুলিবর্ষণ করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তৎক্ষণাৎ আসাদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

মিছিলে গুলিবর্ষণ এবং আসাদের মৃত্যু

আসাদের রক্তমাখা শার্ট, Asad’s bloodstained shirt

আসাদের মৃত্যুতে হাজারো ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে পুনরায় মিছিল বের করে এবং জমায়েত করে শহীদ মিনারের পাদদেশে। কেন্দ্রীয় প্রতিরোধ কমিটি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সারাদেশে ২২, ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি ধর্মঘট আহ্বান করে। এই ধর্মঘটের কারণে আসাদের মৃত্যুতে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সরকার দু’মাসের জন্য ১৪৪-ধারা আইনপ্রয়োগ স্থগিত রেখেছিলেন।

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে শহীদ আসাদ, Shaheed Asad in popular culture

অগণিত ছাত্র-জনতা শোকাতুর ও আবেগে আপ্লুত হয়ে শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল তথা জমায়েত করে, যা দেখে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি শামসুর রাহমান সৃষ্টি করে তাঁর অমর কবিতা “আসাদের শার্ট”। অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্যতম কবি হেলাল হাফিজও এই ঘটনায় ক্রোধে ক্ষোভ প্রকাশ করে কালজয়ী “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” কবিতাটি লিখেছিলেন।

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে শহীদ আসাদ

শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট হস্তান্তর, Handing over the blood stained shirt of Shaheed Asad

২০১০ সালের ২৩ জানুয়ারি, তারিখে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদ, শহীদ রুস্তম ও শহীদ মতিউর স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সেখানে শহীদ আসাদের ভাই অধ্যাপক এইচ এম মনিরুজ্জামান আসাদের রক্তমাখা শার্ট হস্তান্তর করবেন বলে জানান। 

শহীদ আসাদের স্মৃতিতে স্মারক চিহ্নসমূহ, Memoirs of Shahid Asad

বাংলাদেশের বহু জায়গায় জনগণ আইয়ুব খানের নামফলক পরিবর্তন করে নিয়ে শহীদ আসাদের নামে রাখা হয়। বিশেষতঃ জাতীয় সংসদ ভবনের ডান পার্শ্বে অবস্থিত আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে আসাদ গেট রাখা হয়। এছাড়াও, আসাদ এভিনিউ নাম রাখা হয় আইয়ুব এভিন্যিউ’র পরিবর্তে এবং আইয়ুব পার্কের পরিবর্তে নামকরণ করা হয় আসাদ পার্ক।

১৯৭০ সালে আসাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী দিবসে “ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের স্মারক ও অমর আসাদ” শিরোনামে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। হাসপাতালের প্রধান ফটকে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয় যেখানে আসাদ গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।

১৯৭০ সালে  শিবপুর ও ধানুয়া এলাকার স্থানীয় লোকজন শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ নামে একটি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৯১ সালে শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে আসাদের নিজের গ্রাম ধানুয়ায় স্থানীয় অধিবাসীরা।

শহীদ আসাদের দেশমাতৃকার সেবায় মুক্তি এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে মহান আত্মত্যাগ ও অবদানকে প্রতি বছরই জানুয়ারির ২০ তারিখে বাঙ্গালী জাতি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এবং গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে শহীদ আসাদ দিবস পালন করেন। তাছাড়া শহীদুল্লাহ হলে আসাদের নামে একটি স্মৃতি পাঠাগার তৈরী করা হয়েছিল।

আসাদের স্মরণে নির্মিত ‘গণজাগরণ’, Gana Jagran’ built in memory of Assad

শহীদ আসাদের স্মরণে নির্মাণ করা এক ভাস্কর্য হচ্ছে গণজাগরণ। শিল্পী প্রদ্যোত দাস এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৯২ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের গেটের উত্তরদিকে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের বা ডাকসু’র উদ্যোগে আসাদের স্মৃতিকে অমর ও অক্ষয় করে তোলার উদ্দেশ্যে এবং গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে জাগ্রত রাখার জন্য গণজাগরণ নামে আসাদের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া ও আসাদ স্মৃতি পরিষদের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী’র উপস্থিতিতে ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি উক্ত ভাস্কর্য উদ্বোধন করা হয়। তবে নির্মাণ করার কয়েক বছরের মধ্যেই কর্তৃপক্ষীয় অবহেলার কারণে স্থানীয় টোকাই ও দুর্বৃত্তদের দ্বারা ভাস্কর্যটি কাত হয়ে পড়ে। এরপর ভাস্কর্যটি সেখান থেকে একসময় উধাও হয়ে যায়।

আসাদের স্মরণে নির্মিত 'গণজাগরণ'

শেষ কথা, Conclusion 

বাংলায় বহু সাহসী বীর রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে নিজের নয় বরং জনগণের স্বার্থে আত্মবলিদান দিয়েছেন। সেই ব্যক্তিদের মধ্যে শহীদ আসাদের নাম উল্লেখযোগ্য। তাই তিনি আজও বাংলার প্রতিটি ব্যক্তির হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।

Frequently Asked Questions

শহীদ আসাদের জন্ম কবে হয় ?

১৯৪২ সালের ১০ জুন।

শহীদ আসাদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্যের নাম কি ?

গণজাগরণ

শহীদ আসাদের মৃত্যু কবে হয় ?

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts