শঙ্খ ঘোষের কর্মজীবন, জীবনী, ছবি | Bengali author Shankha Ghosh career, family, Biography & More in bangla

শঙ্খ ঘোষের জীবন

বাঙালি সংস্কৃতির ডালি থেকে কাব্য কিংবা সাহিত্য চর্চা বাদ পড়বে এমনটা ভাবাই যায়না। তেমনি ভুলে যায় না সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখা সৃজনশীল শিল্পীসত্তারও, যাদের সমাদর আমরা সর্বদাই করে এসেছি। বাঙালিদের সাহিত্যিক জগত অসংখ্য উল্লেখযোগ্য প্রতিভা দ্বারা যুগে যুগে অলংকৃত হয়েছে।

ওইসব প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হলেন আধুনিক যুগের বাঙালি কবি তথা সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষ। সুখ্যাত বাঙালি কবি শঙ্খ ঘোষ কাব্য ও সাহিত্য চর্চা করার পাশাপাশি প্রবন্ধ রচনা এবং রবীন্দ্র গবেষণার সাথেও বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্যের বিচার করতে গেলে শঙ্খ ঘোষের সমকালীন তাঁর সমতুল্য আরেকটি প্রতিভা বাংলার বুকে বিরল। 

জন্ম ও বংশ পরিচয়, Birth and family identity 

বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি শঙ্খ ঘোষের জন্ম হয় অধুনা বাংলাদেশের চাঁদপুরে। তিনি ১৯৩২ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতৃদত্ত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। শঙ্খ নামটি ছিল তাঁর ডাকনাম। তবে সাহিত্যিক হিসেবে এবং কবি জীবনে তিনি এই নামেই খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর পিতার নাম মনীন্দ্রকুমার ঘোষ, যিনি পেশায় ছিলেন একজন অধ্যাপক। সেই সময় তিনি বাংলা ভাষার একজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।

মনীন্দ্র কুমার ঘোষ রচিত ‘বাংলা বানান’ নামক গ্রন্থটি সেই সময়কালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। শঙ্খ ঘোষের মাতার নাম অমলা ঘোষ। বংশানুক্রমিকভাবে তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারীপাড়া গ্রামে। পিতা চাকরিসূত্রে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের পাবনাতে কর্মরত থাকায় জীবনের প্রাথমিক পর্যায়গুলি কবি সেখানেই কাটান। শঙ্খ ঘোষ ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ায় বেশ সুনাম অর্জন করেন।

বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি শঙ্খ ঘোষের জন্ম হয় অধুনা বাংলাদেশের চাঁদপুরে
Pin it

শৈশবকালীন সময়েই কবির পরিচয় ঘটে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থের সঙ্গে। বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে তথা নিজের চারপাশে বিভিন্ন বিষয় উপভোগ করার মাধ্যমে তিনি বাংলার প্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতির প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন।

শঙ্খ ঘোষের শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন দিক, Shankar Ghosh education 

শঙ্খ ঘোষ পাবনা জেলার পাকশির চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে পড়াশুনা করেন। সেখান থেকে তিনি ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা লাভ করার উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতার বুকে পাড়ি জমান।

তিনি প্রথমে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৫১ সালে উক্ত কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে সসম্মানে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। এরপরে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বিশেষত এই সময়ে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখাপত্র প্রকাশিত করার কাজ শুরু করে দেন। 

সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষের কর্মজীবন, Career of writer Shankha Ghosh

পিতার মত শঙ্খ ঘোষও কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। কর্মজীবনের শুরুর দিকে তিনি একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার কাজ করেছেন।

সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতে তিনি দীর্ঘসময় ধরে বাংলা ভাষার অধ্যাপনা করেন। ১৯৬০ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইটার্স ওয়ার্কশপেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।

সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষের কর্মজীবন
Pin it

একসময় তিনি সিমলায় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ এডভান্স স্টাডিজ এবং আরো বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষকতা করেছিলেন। দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষকতার কাজ করার পর অবশেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে শঙ্খ ঘোষ অবসর গ্রহণ করেন।

সাহিতজীবন ও সাধনা, Literary life and pursuits

শঙ্খ ঘোষের জীবনে বিভিন্ন বিভিন্ন দিকের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হল তাঁর কাব্য ও সাহিত্য চর্চা, আর শঙ্খ ঘোষের সাহিত্য জীবনের কথা বলতে গেলে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার কথা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়, কারণ মূলত এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই তাঁর সাহিত্যজীবন বিকাশ লাভ করে। বেশিরভাগ বাঙালি তাঁকে মূলত কবি হিসেবে চেনে, কিন্তু তিনি বিপুল সংখ্যায় গদ্যও রচনা করেছিলেন।

অন্যদিকে তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবেও খ্যাত। এককথায় বাংলা কবিতার জগতে তাঁর অবদান অপরিসীম। শঙ্খ ঘোষের প্রথম কাব্যগ্রন্থ হল‘দিনগুলি রাতগুলি’। এছাড়া তাঁর রচিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 

  • ‘এখন সময় নয়’, 
  • ‘নিহিত পাতাল ছায়া’, 
  • ‘আদিম লতাগুল্মময়’, 
  • ‘মূর্খ বড়ো, 
  • ‘সামাজিক নয়’, 
  • ‘বাবরের প্রার্থনা’, 
  • ‘তুমি তো তেমন গৌরী নও’,
  •  ‘ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, 
  • ‘জলই পাষাণ হয়ে আছে’,
  •  ‘সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি’

 উক্ত কাব্যগ্রন্থ গুলির মধ্যে ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’, ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ গুলি বাঙালি কবিতা প্রেমীদের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। তবে শুধু কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ নয়, বরং গদ্য রচনার ক্ষেত্রেও শঙ্খ ঘোষের অবদান সাহিত্য ইতিহাসে বর্তমান।

বাবরের প্রার্থনা',
Pin it

একদিকে তাঁর কলমে দৃপ্ত শব্দে উঠে এসেছে কঠোর সামাজিক তথা রাজনৈতিক বাস্তব, তাছাড়াও প্রকাশ পেয়েছে সমাজের নিচু তলার মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা; শঙ্খ ঘোষ একজন প্রাবন্ধিক হিসেবেও নিজের প্রতিভার যথেষ্ট বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। তাঁর লেখা ‘উর্বশীর হাসি’, ‘শব্দ আর সত্য’, প্রমুখ প্রবন্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

অন্যদিকে তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ নামক একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। 

শঙ্খ ঘোষের রাজনৈতিক দর্শন, Political philosophy of Shankha Ghosh 

শঙ্খ ঘোষ রাজনৈতিক মতাদর্শগত দিক থেকে কখনোই কোনো সুবিধাবাদী দলভুক্ত ছিলেন না। তাঁর মতাদর্শে কখনই কোনো আদর্শগত কঠোরতা কিংবা তাত্ত্বিকতার আড়ম্বর কারও চোখে পড়েনি। তিনি সারা জীবন ধরে যখন যে ব্যাপার ঠিক বলে মনে করেছেন, সেটাই সমর্থন করেছেন, তাও মুক্তকণ্ঠে। তাঁর সাহিত্য চর্চা থেকে শুরু করে জীবন যাপনের মধ্যে প্রত্যেক বারই প্রকাশ পেয়েছে সচেতন রাজনৈতিক সত্তা।

শঙ্খ ঘোষের রাজনৈতিক দর্শন
Pin it

প্রসঙ্গত শঙ্খ ঘোষের রচিত ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’ শীর্ষকের রাজনৈতিক কাব্যগ্রন্থটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। উক্ত কাব্যগ্রন্থকে কবি বিস্ফোরক সব রাজনৈতিক কবিতা দ্বারা অলংকৃত করেছিলেন।

তিনি জীবনের অন্তিম পর্বে পৌঁছে যাওয়াও পরও সমকালীন রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালেও তিনি নিজের মত প্রকাশ করার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। 

কবি শঙ্খ ঘোষের পরলোক গমন, Poet Shankha Ghosh’s death

২০২১ সালের ভয়াবহ করোনা মহামারী সকল বাঙালির হৃদয় থেকে শঙ্খ ঘোষের মত একজন প্রবাদপ্রতিম প্রতিভাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। বিশিষ্ট এই সাহিত্যিক ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ২১ এপ্রিল প্রয়াত হন।

কবি শঙ্খ ঘোষের পরলোক গমন
Pin it

উক্ত বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতেই কবির সর্দি কাশির সমস্যা দেখা দেওয়ার কারণে তাঁর করোনা পরীক্ষা করা হয় এবং রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তবে তিনি এই মহামারীর কবলে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে চান নি, তাই নিজ বাড়িতেই তাঁকে নির্জন একাকীত্বে চিকিৎসা প্রদান করার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু এপ্রিল মাসের ২১ তারিখে কবি শঙ্খ ঘোষ করোনার সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধে পরাজিত হন।

শঙ্খ ঘোষের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ, Notable Poems of Shankha Ghosh

শঙ্খ ঘোষের প্রধান কাব্যগ্রন্থ ও উল্লেখযোগ্য বই-এর মধ্যে রয়েছে :

  • আদিম লতা গুল্মময়
  • মুর্খ বড়, সামাজিক নয়
  • কবির অভিপ্রায়
  • মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
  • বাবরের প্রার্থনা
  • এ আমির আবরণ
  • জার্নাল
  • লাইনেই ছিলাম বাবা
  • ধূম লেগেছে হৃৎকমলে
  • গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ

কবির পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি, Awards and Recognition

চিত্তপ্রিয় শঙ্খ ঘোষের সমগ্র জীবনটাই অসামান্য সব কর্ম দ্বারা অলংকৃত। কবি নিজের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লেখার পরিপ্রেক্ষিতে নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরস্কার হল :

  • নরসিংহ দাস পুরস্কার (১৯৭৭, মুর্খ বড় সামাজিক নয়)
  • সাহিত্য অকাদেমি (১৯৭৭, বাবরের প্রার্থনা)
  • রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৮৯, ধূম লেগেছে হৃৎকমলে)
  • সরস্বতী সম্মান (গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ)
  • সাহিত্য অকাদেমি (১৯৯৯)
  • দেশিকোত্তম (১৯৯৯)
  • পদ্মভূষণ (২০১১)
  • হল অফ ফেম লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট সাহিত্যব্রহ্ম পুরস্কার (ওয়ার্ল্ড ফোরাম ফর জার্নালিস্ট অ্যান্ড রাইটার্স)
চিত্তপ্রিয় শঙ্খ ঘোষের সমগ্র জীবনটাই অসামান্য সব কর্ম দ্বারা অলংকৃত
Pin it

উপসংহার, Conclusion 

 মৃত্যু কখনোই কবি শঙ্খ ঘোষের মত প্রতিভার সমাপ্তি ঘটাতে পারবে না। নিজের সমগ্র জীবন দিয়ে তিনি যে অমর সৃষ্টিগুলি রচনা করে গিয়েছেন, সেই গুলি চিরকাল বাঙালি পাঠকদের হৃদয়ে তাঁকে অমর করে রাখবে। তিনি সর্বদাই নিজের লেখায় অতি সরল কথ্য ভাষার ব্যবহার করেছেন, তাঁর অসামান্য কবিতাগুলির সংযোজন তাঁকে পাঠকদের হৃদয়ের আরো নিকটবর্তী করে তুলেছে।

Frequently Asked Questions 

শঙ্খ ঘোষ ১৯১৬ সালে কোন কোন পুরস্কার লাভ করেছিলেন?

রবীন্দ্র পুরস্কার এবং ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।

কবি শঙ্খ ঘোষের জন্ম কোথায় হয়েছিল? 

 বাংলাদেশের চাঁদপুরে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি। 

শঙ্খ ঘোষ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কত সালে অবসর গ্রহণ করেন?

১৯৯২ সালে।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts