শেখ রেহানা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদস্য। পাশাপাশি তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র বোন। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা শেখ রেহানার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবো।
রেহানার জন্ম ও পরিবার, Rehana’s Birth and Family :
মা ফজিলাতুন্নেছার কোল আলো করে ১৯৫৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শেখ রেহেনা গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
শেখ রেহানার শিক্ষাগত যোগ্যতা, Educational qualification of Sheikh Rehana :
মেট্রিক পরীক্ষার মেধাতালিকায় সকল নারীর মধ্যে অষ্টম স্থান অধিকার করেন তিনি। পরবর্তীতে তাঁর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি।
শেখ রেহানার দাম্পত্য সঙ্গী, Spouse of Sheikh Rehana :
শেখ রেহানার দাম্পত্য সঙ্গী হলেন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ শফিক আহমেদ সিদ্দিক। স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ও ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। শেখ রেহানা এক স্মৃতিচারণে বলেন, “যখন অনুভব করছিলাম আমার মাথার ওপরে একটি ছায়া দরকার, ঠিক তখনই বিয়ের আলাপ আসে।
শফিক সিদ্দিক তখন পড়াশোনার জন্য লন্ডনে। এ প্রস্তাব অবশ্য আব্বা বেঁচে থাকতেই নিয়ে এসেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান চাচা। কিন্তু আব্বা বলেছেন, পড়ালেখা শেষ হোক, এরপর দেখা যাবে। একই প্রস্তাব যখন আবার এলো তখন বোন শেখ হাসিনা আমার মতামতের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন বিষয়টি। কিন্তু নিজের মাথার ওপরে একটি ছায়ার আশায় বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দেই।”
তাদের দাম্পত্য সংসারে তিনজন সন্তান রয়েছেন, এক ছেলে এবং দুই মেয়ে; যাদের নাম হল টিউলিপ সিদ্দিক , রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি (ছেলে) এবং আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তি। তন্মধ্যে, টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনের ক্যামডেন কাউন্সিলের লেবার পার্টির পক্ষ নিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত এবং আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি।
রাজনৈতিক কার্যকলাপ, Political activity :
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক পরিবার অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি কখনো সক্রিয় রাজনীতির সামনের সারিতে আসেননি। এই বঙ্গকন্যা নীরবে নিভৃতে দেশের জন্য বড় বোন শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে সাহায্য ও সহযোগিতা করে গেছেন। জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে কাজ করে যাচ্ছেন এই মহীয়সী। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তিনি। আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রথম ডাকটি দিয়েছিলেন ছোট আপা শেখ রেহানা। তাছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন সুপরামর্শক।
১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। সেই দিন থেকেই শেখ হাসিনার প্রতিটি কাজে নীরবে পাশে থেকে ভ‚মিকা রেখে চলছেন। দুর্যোগ আর দুর্দিনে পর্দার অন্তরালে থেকে আওয়ামী লীগ দলের ঐক্য ধরে রাখতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন শেখ রেহানা।
কিন্তু সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির কোথাও সাধারণত শেখ রেহেনাকে দৃশ্যমান দেখা যায় না। তবে মানব কল্যাণে তিনি নেপথ্যে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। লাখো-কোটি ভক্তসমর্থক ও নেতা-কর্মীর ভালোবাসায় তিনি সিক্ত। সক্রিয়ভাবে বড় বোনের হাতকে মজবুত রাখতে নিরলস পরিশ্রম করছেন তিনি।
সংগ্রামমুখী জীবন, Struggle-oriented life :
বিভিন্ন সময়ে নানামুখী সংকট মোকাবিলা করেও জীবনে অগ্রসর হতে হয়েছে শেখ রেহেনাকে। ফেলে আসে সময়ের স্মৃতিচারণে তিনি বলেছিলেন, “লন্ডনে আসার পর চাকরির জন্য যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, তখন কত পরিচিতজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। চাকরি নিলাম একটি লাইব্রেরি ও পাবলিশার্স কোম্পানিতে। এরপর তো অনেক পথ পাড়ি দিলাম। আমাদের বাসায় রাত-দিন আসা-যাওয়া করত এমন ব্যক্তিও রাস্তায় দেখা হলে তারাও চোখ ফিরিয়ে নিতেন। অবশ্য কেউ কেউ সাহায্যও করেছেন। এর মধ্যে একজন শিপিং করপোরেশনের বড় অফিসার এ জেড আহমেদ আমাকে খুবই সাহায্য করেছেন। আব্বার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রুহুল কুদ্দুস ও মঈনুল ইসলামও আমার খোঁজখবর নিয়েছেন নিয়মিত। আমার বিয়ের উকিল ছিলেন মঈনুল ইসলাম। ড. শহীদুল্লাহর নাতি মনসুরুল হক, তাকে আমরা হীরা মামা বলে ডাকি- তিনিও আমার জন্য অনেক করেছেন।”
শেখ রেহানাকে সরকারী বাড়ী বরাদ্দ, Allotment of government house to Sheikh Rehana :
২০০১ সালে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে ঢাকার ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়ীটি তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক সরকারীভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি তা নগদ মূল্যে ক্রয় করেন। পরবর্তী সময়ে, খালেদা জিয়া’র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৫ সালে তাঁর বাড়ীর অধিকার কেড়ে নেয়। এরপর সেই স্থানকে ধানমন্ডি থানা হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করা হয়, এর ফলে তিনি বাড়ীর অধিকার ফিরে পেতে ২০০৬ সালের ২৪ জানুয়ারি আইনি লড়াই শুরু করেন।
গৃহবন্দী শেখ হাসিনা, Sheikh Hasina under Hostage :
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদের জরুরী অবস্থা চলাকালে অর্থাৎ ২০০৭-২০০৮ সালে শেখ হাসিনা গৃহবন্দী হন। শেখ রেহানা ঐ সময় নিজের সহোদরা বড় বোন শেখ হাসিনা’র পক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হাল ধরেন। ২০০৮ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তারপর শেখ হাসিনা অধিষ্ঠিত হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। ক্রমে শেখ রেহানা বাংলাদেশ ত্যাগ করে বোনকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে সহযোগিতা করতে থাকেন।
শেখ রেহানা মুজিবের কত তম সন্তান? Shekh Rehana Mujiburer kototomo santan?
রেহানা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং গৃহিণী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৪র্থ সন্তান।
1975 সালের 15 আগস্ট শেখ রেহানা কোথায় ছিলেন? Where was Sheikh Rehana on August 15, 1975?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকায় ঘাতকদের গুলিতে সপরিবার নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে থাকায় বেঁচে যান তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
শেখ রেহানা নিজের বড় বোন শেখ হাসিনাকে সাথে নিয়ে জার্মানি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর তিনি যুক্তরাজ্যে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ প্রার্থনা করেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। অদ্যাবধি সেখানেই অবস্থান করছেন শেখ রেহানা। তবে মাঝে মাঝে বাংলাদেশে কিছুদিনের জন্য অবস্থান করেন। হত্যাকাণ্ডের কয়েক বছর পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “১৫ আগস্ট আমি মরে গেলেই ভালো হতো। বাবা নেই, মা নেই, ভাই নেই। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। আমি কী নিয়ে বাঁচব? কী আছে আমার? রাসেল কী অপরাধ করেছিল? ও তো রাজনীতি করত না। আমার মা তো রাজনীতি করত না। কেন ওরা তাদের হত্যা করল?”
অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের সময় হাসিনা ও রেহানা, দুই বোন বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায় ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাষ্ট্রদূত তাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি তাদেরকে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য গাড়ি দিতেও অস্বীকৃতি জানান। পরে দু’বোন জার্মানি হয়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলে যান। তাদের নির্বাসিত জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কাটে সেখানে।
শেষ কথা, Conclusion :
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা- সকলের কাছে ‘ছোটআপা’ নামে পরিচিত। অত্যন্ত সহজ, সরল, বিনয়ী, সাদাসিধে জীবনের অধিকারী তিনি। একজন সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন শেখ রেহানার। ব্যক্তিজীবনে আদিখ্যেতা কিংবা অহংবোধ নেই। মায়ের গুন আর বাবার আদর্শ ধারণ ও লালনকারী কন্যা তিনি।
ত্যাগের মহিমায় অনন্য তিনি। পোশাকে, চলনে কিংবা আচরণে যে কোন মানুষকেই মুগ্ধ করে। সরলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত আগলে রাখছেন প্রিয় বড়আপাকে। নেপথ্যে থেকে বড় বোন শেখ হাসিনাকে সাহস জুগিয়ে, পরামর্শ দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করছেন তিনি।আশা করি আজকের এই আলোচনার মাধ্যমে আপনারা শেখ রেহানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।
Frequently Asked Questions
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদস্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
হাসিনা ও রেহানা, দুই বোন বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায় ছিলেন