যুগে যুগে বাঙলার ঘরে ঘরে অসংখ্য মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকজনকেই আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণে রেখেছি। তবে বাঙালি জাতির নেতা এবং পিতা বললে যে মানুষটির নাম প্রথমেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙ্গালী, শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের জাতির জনক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে পরিবারের সদস্যদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। তখন রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ১১ বছরের শেখ রাসেলকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। আজ আমরা এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে শেখ রাসেলের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তুলে ধরবো।
শেখ রাসেলের জন্ম ও শৈশবকালীন স্মৃতি, Birth and childhood memories of Sheikh Russell
শেখ রাসেলের জন্ম হয় ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখে। শিশু শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে। মায়ের কোল আলো করে বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ রাসেল বাংলার মাটিতে জন্ম নেন। বড় বোন শেখ হাসিনার শোবার ঘরে রাসেলের জন্ম হয়।
সেদিন আনন্দের জোয়ারে মেতে উঠেছিল রাসেলের পরিবার। তবে দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মতোই রাসেলের ছেলেবেলাও বর্ণময়। জন্মের পর বাবার সান্নিধ্য পাওয়ার খুব বেশি সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। তৎকালীন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে, রাসেলের বয়স তখন মাত্র এক বছর, কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নেওয়া হয় এবং পাকিস্তান সরকার তাঁকে কারাগারে বন্দী করে রাখে।
বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে ঢাকার জেলে রাখা হয়েছিল, কিন্তু পরে পাকিস্থানের জেলে স্থানান্তরিত করে দেওয়া হয়। একবার বড় বোনের সাথে রাসেল বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে দেখতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র দু বছর। রাসেল সেখানে গিয়ে বোনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন – “তোমার বাবা কে আমি কি বাবা বলে ডাকতে পারি?”, কারণ বাবা তখন তাঁর কাছে একেবারেই অপরিচিত একজন মানুষের মতো ছিলেন।
রাসেলের নামকরণ, Russell’s nomenclature
শেখ রাসেলের নামকরণের নেপথ্যে রয়েছে এক মজার ইতিহাস। একথা আমরা সকলেই জানি যে, বঙ্গবন্ধু বরাবরই বিশ্ব শান্তি এবং সহাবস্থানের পক্ষে ছিলেন। তিনি ছিলেন দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের বিশেষ ভক্ত। বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন একজন নোবেল বিজয়ী দার্শনিক তথা বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী। অন্যদিকে তিনি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের নেতা ছিলেন। উক্ত মহান ব্যক্তির বিভিন্ন কর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলো বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবার। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই বঙ্গবন্ধু নিজের কনিষ্ঠ সন্তানের নাম শেখ রাসেল রেখেছিলেন।
শিশু রাসেলের শিক্ষাজীবন, Education of child Russell
সামান্য কয়েক বছরের জীবন দশার বেশিরভাগ সময়টাই শিশু রাসেল নিজের মা এবং বোনদের সাথে কাটিয়েছিলেন। তবে শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজে থেকে। ১১ বছর বয়সে যখন শিশু রাসেলকে হত্যা করা হয়েছিল, তখন তিনি সেই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।
আত্মভোলা শিশু রাসেল, Self indulgent baby Russell
শেখ রাসেলের জীবনীমূলক কাহিনীগুলো থেকে তাঁর ছেলেবেলার দিনগুলো সম্পর্কে যা কিছু জানা যায়, সেক্ষেত্রে অধিকাংশ লেখাই শিশু বয়সের নিষ্পাপ আত্মভোলা কর্মকাণ্ডে পূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে টমি নামে এক কুকুর ছিল, যার সাথে সবসময় খেলে বেড়াতো শিশু রাসেল। খেলার সময় একদিন কুকুরটি জোরে ডেকে ওঠে, তখন ছোট রাসেলের মনে হয়েছিল যেন টমি তাকে বকছে। শিশু রাসেল বড় বোন রেহানার কাছে এসে তখন অঝোরে কাঁদতে থাকেন।
অন্যদিকে রাসেলের নাকি মাছ ধরার খুব শখ ছিল। কিন্তু মাছ ধরে তিনি সেই মাছকে আবার সেই পুকুরেই ছেড়ে দিতেন অবুঝ রাসেল। এছাড়া রাসেলের স্বভাব ছিল অত্যন্ত দুরন্ত প্রকৃতির, আর এই দুরন্তপনার সঙ্গী হিসেবে ছিল একটি বাইসাইকেল। রাষ্ট্রীয় প্রটোকল হিসেবে তাঁর স্কুলে সাইকেল নিয়ে যাওয়া বারণ ছিল, কিন্তু তাও তিনি নিজের বাইসাইকেলে করেই রোজ স্কুলে যেতেন।
জীবনীতে উল্লেখ করা রাসেলের শৈশব আখ্যান যেন আমাদেরকে নিজেদের শৈশবের গল্প মনে করিয়ে দেয়। পড়াশোনা, খেলাধুলা, দুরন্তপনা ইত্যাদি সবকিছু নিয়েই রাসেল আমাদের সকলের কাছে শৈশবের এক আদর্শ হয়ে ওঠে। কারগারের রোজনামচায় ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “জেল গেটে যখন আমি ওকে কোলে নিলাম সে আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে গিয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকছে কেনো, ‘ব্যাপার কি?’ তখন ওর মা বলল,“বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে বলে মা-কেই ‘আব্বা’ বলে ডাকতে বলা হয়েছে ওকে। রাসেল তখন আবার ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল দেখে যেই আমি জবাব দেই তখন সে নিজের মায়ের গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়।”
শেখ রাসেলের জীবনে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট ছিল এক অভিশপ্ত রাত। তাঁর হত্যা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। অন্যদিকে সেই রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশি বিদেশি বাংলাদেশ বিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রের সাথে লিপ্ত একদল সেনা কর্মকর্তা, সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনকে ট্যাংক দিয়ে ঘিরে ফেলে। সেই রাতে এক এক করে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সকলকে হত্যা করা হয়।
সেই রাতের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করে সেই হত্যাকারীরা। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত কর্মচারীরা শিশু রাসেলকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় সে কাঁদতে থাকে নিজের মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য।
এদিকে সেনা কর্মীরা তাঁর মা কে হত্যা করেছিল। একসময় সেই কর্মচারীরাও সেনাদের হাতে ধরা পড়ে যায়, সকলকে হত্যা করে ঘাতক সেনা কর্মীরা রাসেলকে সাথে করে ভেতরের ঘরে নিয়ে যায় এবং গিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে তাঁকে হত্যা করে। এভাবে নির্মমভাবে অবুঝ শিশু শেখ রাসেলকে হত্যা করা হয়। ১১ বছরের ছোট ছেলেটির অপরাধ এটাই ছিল যে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তান ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর মতো মানবিকতার ছাপ ছিল রাসেলের মধ্যে, Russell had the impression of humanity like Bangabandhu
শেখ রাসেলের মধ্যে শৈশব কাল থেকেই বাবা বঙ্গবন্ধুর মতোই মানবিকতা দেখা গিয়েছিল। মানুষের জন্য ভালোবাসা সহ পশু পাখিদের জন্যও তাঁর মনে ছিলো অগাধ ভালোবাসা। শিশু রাসেল সবার সাথেই অল্প বেশি সময় কাটাতেন, মনের সুখে তাদের সাথে অবুঝের ন্যায় গল্প করতেন তিনি। সবার সাথে মিশতেন তিনি, তাছাড়া বাড়িতে কাজের লোক সহ সবাইকে খুব সম্মান শ্রদ্ধা করতেন রাসেল।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক জ্বলন্ত প্রতীক শেখ রাসেল, Sheikh Russell is a burning symbol in the history of the Bengali nation
শেখ রাসেলকে স্মরণ করতে গিয়ে মনে পড়ে যায় সেই সমস্ত নৃশংস ক্ষমতালোভী মানুষের কথাও, যারা শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে ১১ বছরের একটি ছোট্ট অবুঝ শিশুকে জীবন ভিক্ষা দেয় নি।
আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক জ্বলন্ত প্রতীক হল বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ রাসেল। তাঁর স্মৃতিকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশে গঠন করা হয়েছে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র এবং শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ। এছাড়াও শেখ রাসেলের নাম অনুসারে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুকে তৈরি করা হয়েছে একটি স্কেটিং স্টেডিয়াম। এসবের মধ্য দিয়েই শেখ রাসেল চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন বাঙালি জাতির হৃদয়ের গভীরে।
উপসংহার, Conclusion
এক কথায় বলতে গেলে বাঙালি জাতির কাছে এক যুগোত্তীর্ণ মানব শেখ রাসেল। যিনি অবুঝ অবস্থায় থেকেই দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়ে গেছেন। বাঙালি জাতি রূপকথার মতো নিজের ছেলেবেলাকে যেন তাঁর মধ্যে খুঁজে পায়। অন্যদিকে তাঁর মৃত্যুর নির্মম কাহিনী বার বার আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় দেশের করুন ইতিহাসের কথা। সকলের মনের এখন একই আশা, শেখ রাসেলের স্মৃতি বুকে নিয়ে বাঙালি জাতি যেন তাঁকে বঙ্গবন্ধুর মত স্নেহের আসনে বসিয়ে সভ্যতার পথে আরো অগ্রসর হয়।
Frequently Asked Questions
১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখে।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট।
শেখ মুজিবুর রহমান।