“মনোবীক্ষণের জনক” সিগমুন্ড ফ্রয়েড ছিলেন একজন অস্ট্রিয় মানসিক রোগ চিকিৎসক তথা মনস্তাত্ত্বিক। তিনি নিজের চিকিৎসক জীবনে “মনোসমীক্ষণ” নামক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবনার জন্য পরিচিত। বিভিন্ন সময়ে তাঁর নানা কার্যকলাপ জনমানসে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। মানব সত্তার ‘অবচেতন’, ‘ফ্রয়েডিয় স্খলন’, ‘আত্মরক্ষণ প্রক্রিয়া’ এবং ‘স্বপ্নের প্রতিকী ব্যাখ্যা’ প্রভৃতি ধারণা ফ্রয়েডের চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে জনপ্রিয়তা পায়। অন্যদিকে তাঁর বিভিন্ন তত্ত্ব সাহিত্য, চলচ্চিত্র, মার্ক্সবাদী আর নারীবাদী তত্ত্ব ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
জন্ম ও বংশ পরিচয়, Birth and family identity
সিগমুন্ড ফ্রয়েড ১৮৫৬ সালের ৬ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ফ্রয়েডের বাবা, জ্যাকব ফ্রয়েড ছিলেন একজন ইহুদি উল ব্যবসায়ী, মায়ের নাম আমালি নাথানসন। ফ্রয়েডের পিতা দুই বার বিয়ে করেছিলেন, তাই তাঁর দুটি বড় সৎ-ভাইও ছিল। ১৮৫৯ সালে পরিবারের অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে ফ্রয়েডকে লাইপজিগে চলে যেতে হয়, তার এক বছর পর তিনি ভিয়েনায় স্থানান্তরিত হন। ফ্রয়েড ভিয়েনায় জীবনের ৭৮ বছর বাস করেছিলেন।
শিক্ষা জীবন থেকে কর্মজীবন প্রবেশের সুযোগ, Access to careers from education
সিগমুন্ড ফ্রয়েড ১৮৭৩ সালে স্পার্ল জিমনেসিয়াম থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একজন নেতৃস্থানীয় ফিজিওলজিস্ট আর্নস্ট ভন ব্রুক এর সাথে কাজ করেছিলেন। ১৮৮২ সালে তিনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ থিওডর মেনার্ট এবং অধ্যাপক হারম্যান নথনেগেলের সাথে প্রশিক্ষণের জন্য ক্লিনিকাল সহকারী হিসাবে ভিয়েনার জেনারেল হাসপাতালের সাথে যুক্ত হন।
১৮৮৫ সালে ফ্রয়েড নিউরোপ্যাথোলজির প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন, তখন তিনি মস্তিষ্কের মেডুলা নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার উপসংহারে পৌঁছে গেছিলেন। ১৮৮৫ সালের শেষের দিকে ফ্রয়েড ভিয়েনা ছেড়ে প্যারিসে চলে যান নিউরোপ্যাথলজিতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। প্যারিসের এক ক্লিনিকে তিনি জিন মার্টিন চারকোট এর নির্দেশনায় কাজ করেছিলেন।
বৈবাহিক জীবন, Married life
প্যারিসের নিউরোপ্যাথলজির পড়াশুনা শেষে ১৮৮৬ সালে ভিয়েনাতে ফিরে আসার বেশ কয়েক মাস পর সিগমুন্ড ফ্রয়েড মার্থা বার্নেসকে বিয়ে করেন, যে ছিল একটি বিশিষ্ট ইহুদি পরিবারের কন্যা। পরবর্তী সময়ে তাদের ছয়টি সন্তানের জন্ম হয়।
চিকিৎসক হিসেবে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের অবদান, Contribution of Sigmund Freud as a doctor
১৯০০ সাল থেকে ১৯৩০-এর দশক অর্থাৎ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের চুয়াল্লিশ বছর বয়স থেকে আশি বছর বয়সের সময়টায় তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছিল ফ্রয়েডের তত্ত্ব সংক্রান্ত বইগুলো যে, কে পড়ে বহু মনোবিজ্ঞানীরা চমৎকৃত হয়েছেন, মধ্যবিত্ত সমাজকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল তাঁর বিভিন্ন তত্ত্ব।
তাঁর বিভিন্ন তত্ত্ব অনুযায়ী প্রকাশিত হয় যে মানুষের মনের মধ্যে অজানা অচেনা এক অবচেতন অংশ আছে, যার সিংহভাগ জুড়ে থাকে নানা ধরনের গোলমেলে যৌন ইচ্ছে, ভীতি আর হিংসার প্রবণতা! সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফ্রয়েডের বসতবাড়ি এবং ক্লিনিক অর্থাৎ ভিয়েনার ১৯ নম্বর বের্গেসি— তে রোগীরা পৌঁছে যেতেন। তাঁর চিকিৎসা দেখে সকলেই মুগ্ধ ছিলেন।
ফ্রয়েড নিজেকে বিজ্ঞানীর চেয়ে বেশি একজন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ ভাবতেন, যে কি না একের পর এক বাধা অতিক্রম করতে চায়। নিজের সামাজিক প্রতিপত্তি বিষয়ে তিনি সর্বদাই জাগ্রত ছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ভিয়েনাবাসী তাঁকে এক জন সহানুভূতিশীল, বিত্তবান, তীক্ষ্ণ মেধার মানুষ তথা সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্ব হিসেবে জেনেছেন।
নাৎসিদের উৎপাতে স্বদেশ ত্যাগ, Sigmund Freud Left his homeland due to the Nazis
১৯৩৩ সালে জার্মান রাইখের অপ্রতিরোধ্য নেতা তথা নায়ক অ্যাডল্ফ হিটলারর উত্থানের সঙ্গে দুঃসময় আসার অশনি সঙ্কেত ছিল। হিটলার-সমর্থক নাৎসিদের সন্ত্রাস এড়াতে ভিয়েনা ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শে কখনই কান দেননি ফ্রয়েড। তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন যে এ শহর ছেড়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। একে তো তিনি তখন একজন বৃদ্ধ, তার উপর চোয়ালের ক্যানসারে ভুগছেন এক দশক ধরে। তাই এই অবস্থায় অন্য দেশে ‘রিফিউজি’ হয়ে থাকার মতো কোনও বাসনা ফ্রয়েডের নেই। কিন্তু সব দুঃস্বপ্ন সত্যি হল, পাঁচ বছর যেতে না যেতেই।
১৯৩৮ সালের ১৪ মার্চ হিটলারের ভিয়েনা প্রবেশের দৃশ্যে আহ্লাদে ফেটে পড়েছিল অস্ট্রীয় নাৎসিরা, তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল নারকীয় উল্লাস। এরপরই শুরু হয় ইহুদিদের দোকান লুঠপাট, ভাঙচুর, রাস্তায় অপমান, মারধর ইত্যাদি আচরণ। তবে এসব দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হননি ফ্রয়েড। নাৎসি বাহিনী একদিন তাঁর বাড়িতে হাজির হয় যখন তিনি পড়াশোনায় মগ্ন ছিলেন। মনস্তত্ত্ববিদ ফ্রয়েড প্রথমে টেরই পাননি তাদের উপস্থিতি। বুঝতে পেরে তিনি তাদের সামনে হাজির হয়ে তাদের কাছে স্থির চোখে তাকিয়ে ছিলেন।
ফ্রয়েডের সেই বিখ্যাত চাউনিতেই নাকি চুপসে যায় নাৎসি মস্তানরা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ফ্রয়েডের কনিষ্ঠ সন্তান অ্যানা ফ্রয়েডকে। যদিও অ্যানা নিষ্ঠুর জার্মান পুলিশকে দেখে বিচলিত হননি। অনেক রাতে অ্যানা বাড়ি ফিরে আসার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন বৃদ্ধ পিতা। সেই রাতের পর ফ্রয়েড অনুভব করেন যে ভিয়েনা আর নিরাপদ নয়। শেষমেষ ১৯৩৮ সালের ৪ জুন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে করে ফ্রয়েড পরিবার জার্মানির সীমানা পেরিয়ে ফ্রান্সে প্রবেশ করে, বস্তুত জীবনের শেষ একটি বছর লন্ডনে স্বস্তিতে আর আরামেই কেটেছিল ফ্রয়েডের।
লন্ডনে আর্নেস্ট জোন্স বন্ধু ফ্রয়েড ও তাঁর পরিবারের জন্য ১৯২০ সালে তৈরি একটি পুরনো দিনের স্থাপত্যরীতিতে গড়া বিশাল এক ম্যানসন খুঁজে বের করেছিলেন। অন্যদিকে লন্ডনের সাধারণ মানুষজন থেকে অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়ে তৃপ্ত বোধ করেছিলেন ফ্রয়েড। বাড়িটিকে তিনি ‘এই ব্রহ্মাণ্ডে আমার শেষ ঠিকানা’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
লন্ডনের উত্তর-পশ্চিমের হ্যাম্পস্টেড এলাকায় ছিল বাড়িটি, হ্যাম্পস্টেড মেট্রো স্টেশনকে নিচে দিকে রেখে ডানে একটা মোড় নিলেই ফিট্সজন্স অ্যাভিনিউয়ের রাস্তা, এই রাস্তায় কিছুটা এগোলেই ম্যারস্ফিল্ড গার্ডেন্স রাস্তা পাওয়া যায়, সেই রাস্তায় যাওয়ার পথে ২০ নম্বর বাড়িতেই জীবনের শেষ এক বছরের সময়টা কাটিয়েছিলেন সিগমুন্ড, যা ছিল নিজের কর্মস্থল তথা প্রিয় শহর ভিয়েনা থেকে অনেকটা দূরে।
জীবনের শেষের দিকে, Sigmund Freud during his last days
সিগমুন্ড ফ্রয়েড কিশোর বয়স পার হতে না হতেই ধূমপান শুরু করেন। মাত্র ২৪ বছর বয়স থেকে তিনি তামাকজাত ধূমপান সেবন শুরু করে দিয়েছিলেন; প্রথমদিকে অর্থাৎ শুরুতে তিনি শুধু সিগারেট পান করতেন, কিন্তু ক্রমে সিগার (চুরুট বা বিড়ি) সেবনকারী হয়ে ওঠেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, ধূমপান নাকি কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করছে এবং একসময় পরিমিত ধূমপান করার মাধ্যমে তিনি আত্ম-নিয়ন্ত্রণের চর্চাও চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ফ্রয়েডের সহকর্মী উইলহেম ফ্লিয়েস একসময় ধূমপান নিয়ে তাঁকে স্বাস্থ্যগত সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন, কিন্তু এরপরেও তিনি ধূমপান অব্যহত রাখেন। ফলস্বরূপ তিনি মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ফ্রয়েড অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে সৃষ্ট মুখগহ্বরে লিউকোপ্লাকিয়া নামক একটি জমাট মাংসপিন্ড দেখতে পান। কিন্তু তিনি তা গোপন রাখেন, পরবর্তীতে সেই বছরেই এপ্রিল মাসে তিনি আরনেস্ট জোনসকে ব্যাপারটা জানান যে সেই জমাট মাংসপিন্ডটি কেটে বাদ দেওয়া হয়ে গেছে।
এর বেশ কিছু বছর পর, ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝির সময়ে, ফ্রয়েডের চোয়ালে ক্যান্সারের কারণে ব্যাপক যন্ত্রণা অনুভব হতে থাকে। চিকিৎসক এই যন্ত্রণাকে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য বলে ঘোষণা করে দেন। ফ্রয়েড তাঁর একজন বন্ধু চিকিৎসক ও ম্যাক্স স্কার-এর সঙ্গে স্বেচ্ছামৃত্যুর ব্যাপারে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে ম্যাক্স স্কার ও কন্যা আনা ফ্রয়েডের সঙ্গে যৌথ পরামর্শ করার মধ্য দিয়ে তিনি ১৯৩৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর অধিক মরফিন গ্রহণের মাধ্যমে স্বেচ্ছামৃত্যু স্বরূপ আত্মহত্যা করার মধ্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার, Conclusion
সিগমুণ্ড ফ্রয়েড একজন দুর্দান্ত চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং নিজের চিকিৎসার প্রভাব নিজ শহর ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বহু মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করেছিলেন এবং সকলের কাছে নিজেকে শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে তৈরি করতে পেরেছিলেন।
Frequently Asked Questions
“মনোবীক্ষণের জনক”
১৮৫৬ সালের ৬ মে।
১৯৩৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর।