সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী pdf, Soumitra Chattopadhyay biography in Bengali

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী

ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম একজন অভিনেতা ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সাথে তিনি চৌদ্দটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যিনি শিল্পীদের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ পুরস্কার আর্দ্রে দেস আর্টস এট ডেস লেত্রেসে ভূষিত।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এমন এক কৃতি বাঙালি সন্তান যার কথা চিরকাল বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। তিনি একাধারে ছিলেন অভিনেতা, কবি, লেখক, নাট্যকার, তথা কণ্ঠশিল্পী। তাঁর জীবনের বিভিন্ন কাহিনী আজকের এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রাথমিক জীবন, Soumitra Chattopadhyay early life

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয় ১৯৩৫ সালের ১৯শে জানুয়ারী। তিনি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে। তাঁর পিতা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় পেশাগত দিক থেকে ছিলেন ওকিল এবং তিনি কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন। তাঁর মায়ের নাম আশালতা চট্টোপাধ্যায়ের। তৎকালীন সময়ে বিখ্যাত থিয়েটার ব্যক্তিত্ব মৃত্যুঞ্জয় শীল ছিলেন তাঁর খুব ভালো বন্ধু, যিনি একজন অভিনেতা হওয়ার কারণে সৌমিত্র চ্যাটার্জির উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিলেন। 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রাথমিক জীবন

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা, Soumitra Chattopadhyay education

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পঞ্চম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জনস বিদ্যালয়ে। তারপর পিতার বদলির চাকরি হওয়ার কারণে তিনি নিজের বিদ্যালয় জীবন শেষ করেন হাওড়া জেলা স্কুল থেকে। এরপর অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সিটি কলেজ থেকে সাহিত্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পর্কিত পড়াশুনা সম্পন্ন করেন তিনি।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় ক্যারিয়ার, Soumitra Chattopadhyay film career

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে শিশির ভাদুড়ির অভিনয় দক্ষতা এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি নিজের ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত গন্তব্য হিসেবে অভিনয়কে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমদিকে বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করতে শুরু করেন তিনি, ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়। তবে প্রথমে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ঘোষক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ তার অভিনয় জীবনের ভবিষ্যৎ পথের সংজ্ঞা দিয়েছে। বলতে গেলে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই অভিনেতা হিসেবে উপযুক্ত রূপ পেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় ক্যারিয়ার

সৌমিত্র চ্যাটার্জী সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিশিষ্ট মুখ হিসেবে বিবেচিত। দেবী, চারুলতা, অরণের দিন রাত্রি, ঘরে বাইরে, শাখা প্রশাখা, গণশত্রু এবং আরও অনেক ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের অভিনয় দক্ষতা পরিবেশন করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সর্বদা সৌভাগ্যবান মনে করতেন তিনি। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ২৭টি ছবির ১৪টি ছবিতেই সৌমিত্র কোন না কোন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

চারুলতা

তাঁর সাথে সত্যজিৎ রায়ের এহেন সম্পর্কের কারণে তাকে সত্যজিতের মানসপুত্র বলেও অভিহিত করা হতো। তবে শুধু সত্যজিৎ রায়ই নয়, তিনি মৃণাল সেনের আকাশ কুসুম, মোহ পৃথিবী; তপন সিনহার ঝিন্দের বন্দি, হুইল চেয়ার, ক্ষুধিত পাষাণ; তরুণ মজুমদারের আলো, সংসারের শ্রীমন্তে, গণদেবতা ইত্যাদি ছবিতেও নিজের অভিনয় দক্ষতার প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সুদীর্ঘ ৬০ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ৩০০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে শেষ বার রুপোলি পর্দায় দেখা গিয়েছিল ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বেলাশুরু’ ছবিতে, যেখানে তাঁর অনবদ্য অভিনয় সকলেরই মন ছুঁয়ে যায়। 

সুদীর্ঘ ৬০ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ৩০০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত / নির্দেশিত নাটকসমূহ, Soumitra Chattopadhyay acted and directed dramas

  • ১৯৯০ ঘটক বিদায়
  • ১৯৯৪ চন্দনপুরের চোর
  • ১৯৯৫ টিকটিকি
  • ১৯৬৩ তাপসী
  • ১৯৯২ দর্পণে শরৎশশী
  • ১৯৭৮ নামজীবন
  • ১৯৮৮ নীলকন্ঠ
  • ১৯৯৮ প্রাণতপস্যা
  • ১৯৮৭ ফেরা
  • ১৯৮৩ রাজকুমার
  • ১৯৮৭ ফেরা
  • ১৯৮৮ নীলকন্ঠ
  • ১৯৯০ ঘটক বিদায়
  • ১৯৯২ দর্পণে শরৎশশী
  • ১৯৯৪ চন্দনপুরের চোর
  • ১৯৯৫ টিকটিকি
  • ১৯৯৮ প্রাণতপস্যা
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত / নির্দেশিত নাটকসমূহ

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, Soumitra Chattopadhyay-  a multi talented personality

অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কিংবদন্তি, তবে আবৃত্তি শিল্পী হিসেবেও তার নাম অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথেই উচ্চারিত হয়। তিনি কবি এবং অনুবাদকও। একজন আইকনিক বহু-প্রতিভাবান শিল্পী শুধু অভিনয়ের জনই নয় বরং কবিতা, আবৃত্তি এবং মঞ্চ-অভিনয়ের জন্যও পরিচিত ছিলেন। তিনি লেখক হিসেবে সফলভাবে নিজের নামে বারোটি বই প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর হৃদয়ে সর্বদাই রয়ে গেছেন এবং জীবনানন্দ দাশ তাঁর চিরন্তন সন্ধান।

অভিনয়ের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন সফল ও প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পী তথা চিন্তাবিদ। প্রসঙ্গত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কর্মজীবনের শুরুতে যখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে একজন ঘোষক হিসেবে কাজ করছিলেন তখন তাঁর অপূর্ব কন্ঠস্বরের জন্য বাচিকশিল্পী মহলে তাঁর বিশেষ খ্যাতি হয়ে গিয়েছিল। একজন সুদক্ষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি অসংখ্য শ্রুতিনাটকে অংশগ্রহণ করেছেন, এছাড়া আবৃত্তির মাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রাণদান করেছেন অসংখ্য কবিতাকে।

এইসব ছাড়াও তিনি একজন চিন্তাশীল কবি ও লেখক হিসেবেও সাহিত্য জগতে বিশেষ ভূমিকা রেখে গিয়েছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অগ্রপথিকেরা, মধ্যরাতের সংকেত, চরিত্রের সন্ধানে ইত্যাদি। 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বই, Books written by Soumitra Chattopadhyay

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বইগুলি হল :

  • শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩)
  • মানিক দা’র সঙ্গে (২০১৪)
  • পরিচয় (২০১৩)
  • অগ্রপথিকেরা (২০১০)
  • প্রতিদিন তব গাঁথা (২০০৯)
  • চরিত্রের সন্ধানে (২০০৪)
  • শব্দরা আমার বাগানে
  • কবিতা সমগ্র (২০১৪)
  • মধ্যরাতের সংকেত (২০১২)
  • নাটক সমগ্র ১ (২০১৫)
  • নাটক সমগ্র ২ (২০১৭)
  • নাটক সমগ্র ৩
  • গদ্য সংগ্রহ (২ খন্ডে)
  • শেষ বেলায় (২০২২)

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত পুরস্কার এবং সম্মান, Awards  and Recognition

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় ক্যারিয়ারে বহু মর্যাদাপূর্ণ সম্মান ও পুরস্কারের অধিকারী হয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : 

  • ১৯৯৮ সালে, তিনি সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। 
  • 2004 সালে, তিনি মর্যাদাপূর্ণ পদ্মভূষণে ভূষিত হন।
  • 2012 সালে, তিনি ভারতের সিনেমা জগতের সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন।  
  • ২০১৭ সালে ফরাসি সরকার তাকে লিজিওন অফ অনার সম্মানে ভূষিত করে। 
  • ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার লাভ করেন।

তিনি একবার বলেছিলেন, “আমি পুরস্কারের জন্য কাজ করি না। এগুলো আমার সৃজনশীলতাকে অনুপ্রাণিত করে না। আমি যখন কাজ করি তখন আমি আমার নৈপুণ্যে সৎ থাকার চেষ্টা করি।” 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত পুরস্কার এবং সম্মান

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবন, Soumitra Chattopadhyay personal life

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দাম্পত্য জীবনের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন দীপা চট্টোপাধ্যায়কে। ১৯৬০ সালে তাদের বিবাহ হয়েছিল। তাদের সংসারে একজন কন্যা সন্তান এবং একজন পুত্র সন্তান রয়েছে যাদের নাম সৌগত চট্টোপাধ্যায় এবং পৌলমী চট্টোপাধ্যায় (বসু)।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু, Death of Soumitra Chattopadhyay

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ২০২০ সালের ১৫ই নভেম্বর ইহলকের মায়া ত্যাগ করে পরলোক গমন করেছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮৫ বছর। চলচ্চিত্র জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি স্ত্রী দীপা চ্যাটার্জি, এক ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে চলে গেলেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু

শেষ কথা, Conclusion 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের প্রায় সারাটা জীবনকেই শিল্পীরূপে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি দর্শকদের কাছে একজন বিখ্যাত সৃজনশীল সত্তা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্র শিল্পের গ্যালাক্সির কিংবদন্তি তারকাদের একজন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আধুনিক বাংলা সাংস্কৃতিক জগতের এমনই এক উল্লেখযোগ্য অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব যিনি নিজের অভিনয়, রচনাশৈলী, কন্ঠ এবং সর্বোপরি আপন চেতনা দ্বারা বাংলা সংস্কৃতিক জগতকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। বাংলার দর্শকগণ চিরকাল হৃদয়ের কাছের মানুষ বলে মনে রাখবে তাঁকে।

Frequently Asked Questions :

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়  কবে জন্মগ্রহণ করেন?

১৯৩৫ সালের ১৯শে জানুয়ারী।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার কোনটি ?

দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু কবে হয় ?

২০২০ সালের ১৫ই নভেম্বর।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts