স্টিভেন অ্যালান স্পিলবার্গ একাধারে একজন প্রখ্যাত আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং সম্পাদক, চিত্রনাট্যকার, তথা মার্কিন ইতিহাসের এক অন্যতম সফল চলচ্চিত্র নির্মাণকারী হিসেবেও সুপরিচত। কর্মজীবনে তিনি তিনবার অস্কার জয় করেন। স্টিভেন স্পিলবার্গের জীবনে বহু আকর্ষণীয় তথ্য রয়েছে, যা আজকের এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে আমরা আলোচনা করব।
জন্ম ও পরিবার, Birth and family
স্টিভেন স্পিলবার্গ ১৯৪৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর আমেরিকার সিনসিনাটি (ওহিও) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এক ইহুদি পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তাঁর পিতার নাম আর্নল্ড মীর, যিনি পেশাগত দিক থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম লিয়া অ্যাডলার, যিনি একজন পেশাদার পিয়ানোবাদক ছিলেন। স্টিভেনের তিন বোন ছিল, যাদের নাম ন্যান্সি, সুসান এবং আন।
শৈশবকালের স্মৃতি, Childhood memories
ছোটবেলায় স্টিফেন টিভি দেখতে খুব পছন্দ করতেন, বেশিরভাগ সময় তিনি টিভির সামনেই কাটাতেন। চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিজ দেখা নিয়ে ছেলের আগ্রহের কথা চিন্তা করে, তাঁর পছন্দমত পিতা তাঁকে একটি পোর্টেবল চলচ্চিত্রের ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। এদিকে ছেলে স্টিফেন এমন একটা উপহার পেয়ে এতটাই আনন্দিত হয় যে সে অল্প বয়স থেকেই শর্ট ফিল্মের শুটিং এর কাজ করতে থাকে।
স্টিফেন স্পিলবার্গ কিছু ফিল্মের ক্ষেত্রে রক্তের বিকল্প হিসাবে চেরির রস ব্যবহার করেছিলেন। তখনকার সময়েই এক শর্ট ফিল্ম এর উৎসবে স্টিফেন বিচারক প্যানেলে গিয়ে তাঁর নিজের তৈরি “এস্কেপ টু নোহোয়ার” নামক একটি সামরিক শর্ট ফিল্ম উপস্থাপন করেছিলেন, যা সেখানে সেরা কাজ হিসাবে স্বীকৃত পেয়েছিল। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তিনি মুভি ক্যামেরা দিয়ে ছবি টি তৈরি করেন। তবে এই ছবির অভিনেতা হিসেবে ছিলেন তাঁর বাবা, মা, বোন এবং স্কুলের বন্ধুরা।
শিক্ষাজীবনে স্টিফেনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, Educational experiences
ইহুদি ছিলেন বলে হাই স্কুলে পড়াশুনা করার সময় কালে স্টিফেন স্পিলবার্গকে অন্যদের কাছে মারও খেতে হয়েছিল। এসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার ফলে ইহুদি ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তাঁর অনাস্থা এসে পড়ে। পরবর্তীতে তিনি এই ধর্মীয় পরিবেশ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল অবধি তিনি হিব্রু স্কুলেই পড়াশোনা করেছিলেন। এরপরে স্টিভেন স্পিলবার্গ ক্যালিফোর্ণিয়ার সারাটোগা হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং উক্ত স্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে স্নাতক উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী বছরই তাঁর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তখন স্পিলবার্গ পিতার সাথে
লস অ্যাঞ্জেলসে চলে আসেন এবং তাঁর মা ও অন্য বোনেরা সারাটোগাতে থেকে যান। পরবর্তী সময়ে স্টিফেন বেশ কয়েকবার দক্ষিণ ক্যালিফোর্ণিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্কুলে ভর্তির আবেদন জানান, কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে একেবারে কম নম্বর থাকার কারণে সুযোগ পাননি তিনি। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে তিনি ক্যালিফোর্ণিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন।
“হ্যাভেনলি লাইটস” প্রকল্পে কাজ, Work on “Heavenly Lights” project
১৯৬৩ সালে এলিয়েনদের নিয়ে একটি দুর্দান্ত ছবি স্পিলবার্গের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং স্কুলছাত্রীদের দ্বারা অভিনীত হয়েছিল, যার শীর্ষক ছিল “হ্যাভেনলি লাইটস”, উক্ত ছবি একটি স্থানীয় সিনেমা হলেও উপস্থাপিত হয়েছিল। ছবির প্লটটিতে এলিয়েনদের দ্বারা মানুষের অপহরণের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছিল। স্টিভেনের বাবা-মা এই ছবির কাজে বেশ কিছু অর্থ ব্যয় করেছিলেন, এছাড়াও স্টিফেনের মা ফিল্ম ক্রুদের বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং তাঁর বাবা ছবির জন্য মডেলগুলি তৈরি করতে সহায়তা করেছিলেন। উক্ত প্রকল্পে প্রায় ৬০০ ডলার বিনিয়োগ করা হয়।
স্টিফেন স্পিলবার্গের চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস, Stephen Spielberg’s film making history
স্টিফেন স্পিলবার্গ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সেখানে দীর্ঘদিনের ছুটি পাওয়ার পর তিনি “এমব্লিন” নামক একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন। উক্ত চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ারের পর, “ইউনিভার্সাল পিকচারস” নামের এক বিখ্যাত চলচ্চিত্র সংস্থার প্রতিনিধিরা স্টিফেনকে এক চুক্তির সাক্ষর করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপর তিনি নাইট গ্যালারী এবং কলম্বোর মতো প্রকল্পের চিত্রায়নের কাজ করেন।
১৯৭১ সালে, স্টিফেন স্পিলবার্গ নিজের প্রথম বৈশিষ্ট্যযুক্ত চলচ্চিত্র ‘ডুয়েল’ শ্যুট করেন যা চলচ্চিত্র সমালোচকদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। ৩ বছর পর তিনি পরিচালক হিসেবে প্রথমবার পর্দায় চলচ্চিত্র নির্মাণের সূচনা করেন। তিনি এক বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে “দ্য সুগারল্যান্ড এক্সপ্রেস” নির্মাণ করেছিলেন। পরের বছর, স্টিভেন স্পিলবার্গ বিখ্যাত থ্রিলার “জাভস” এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করেন। উক্ত ছবি বক্স অফিসে ২৬০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করেছিল! এরপর তিনি ইউএফও নিয়ে এক ছবি তৈরি করেন যা তাঁকে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান অর্জন করতে সাহায্য করে।
১৯৮৪ সালে তাঁর পরিচালনায় ইণ্ডিয়ানা জোনস ধারাবাহিকের প্রথম পর্বটি মুক্তি পায় ‘ইণ্ডিয়ানা জোনস অ্যাণ্ড দ্য টেম্পল অফ ডুম’ নামে। প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে এই ছবিটিও। তাছাড়া বিখ্যাত চলচ্চিত্র জুরাসিক পার্কও তারই সৃষ্টি। উক্ত ছবির সাফল্য দেখার পর, স্টিভেন স্পিলবার্গ “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড: জুরাসিক পার্ক” এর সিক্যুয়াল পরিচালনা করেন, যা ১৯৯৭ সালে বক্স অফিসে প্রভূত ডলার আয় করে। পরবর্তী বছরে, তিনি “অ্যামিস্টাড” এবং “সেভিং প্রাইভেট রায়ান” এর মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন।
এরপর একে একে, পরিচালনা করেন ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান, মিউনিখ, টার্মিনাল এবং ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ল্ড সহ আরো অনেক ছবি। ২০০৮ সালে, স্টিফেন স্পিলবার্গ, ইন্ডিয়ানা জোন্স- দ্য কিংডম অফ দ্য ক্রিস্টাল স্কাল এর বিষয়ে তাঁর পরবর্তী ছবি উপস্থাপন করেন, যা বক্স অফিসে $ 786 মিলিয়নেরও বেশি আয় করে। তারপরে স্টিফেন ওয়ার হর্স নাটক, ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র দ্য স্পাই ব্রিজ, ইত্যাদি আরো অন্যান্য বহু প্রকল্পগুলি নিয়ে কাজ করেন এবং বহু চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন।
ব্যক্তিগত জীবন, Personal life
স্টিভেন স্পিলবার্গের প্রথম স্ত্রীর নাম অ্যামি ইরভিং, তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান অভিনেত্রী। উক্ত অভিনেত্রীর সাথে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক ৪ বছর ছিল। বৈবাহিক সম্পর্ক থাকাকালীন এই দম্পতির এক ছেলে জন্ম নেয়, যার নাম রাখা হয় ম্যাক্স স্যামুয়েল।
স্টিফেন পরবর্তীতে আবার কেট ক্যাপশ নামে একটি অভিনেত্রীকে বিয়ে করেন, যার সাথে তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে একসাথে কাটিয়েছেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য জীবনে স্টিফেন তিনটি সন্তানের পিতা হন, যাদের নাম: সাশা, সাওয়ের এবং ডাস্ট্রি।
তাছাড়াও সে সময়ে, স্পিলবার্গস নিজের সন্তানকে ছাড়া আরও তিনজন শিশুকে দত্তক নিয়ে তাদের লালন পালন করেন। তাদের নাম: জেসিকা, থিও এবং মাইকেল জর্জ। ব্যক্তিগত জীবনে স্টিফেন নিজের অবসর সময়ে কম্পিউটারে গেম খেলা উপভোগ করতেন। একসময় তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ভিডিও গেমগুলির বিকাশের কাজে জড়িত হয়েছিলেন, তাছাড়া তিনি গল্প লেখক হিসাবেও কাজ করছিলেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি, Awards and recognition
চলচ্চিত্র জগতে স্টিফেন স্পিলবার্গের অসামান্য কৃতিত্ব রয়েছে। চলচ্চিত্রে অবদান রাখার জন্য বহু পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি।
১৯৯৫ সালে স্টিফেন এএফআই লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান।
১৯৯৮ সালে অর্ডার অফ দ্য মেরিট ফেডেরাল রিপাবলিক অফ জার্মানি থেকে পুরস্কার পান।
২০০৩ সালে হলিউড ওয়াক অফ ফেম পুরস্কার পান স্টিভেন স্পিলবার্গ।
১৯৭৪ সালে তাঁর পরিচালনায় মুক্তি পাওয়া ‘দ্য সুগারল্যাণ্ড এক্সপ্রেস’ ছবিটি ঐ বছরই কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার পায়।
১৯৮২ সালে মুক্তপ্রাপ্ত ‘ই.টি – দ্য এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল’ ছবিটি- শ্রেষ্ঠ সাউণ্ড এফেক্ট, শ্রেষ্ঠ স্পেশাল এফেক্ট এবং শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত বিভাগে অ্যাকাডেমি পুরস্কারে মনোনীত হয়।
উপসংহার, Conclusion
স্টিভেন স্পিলবার্গ নিজের জীবনে শত শত চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিজের শুটিং করেছেন। বর্তমানে তিনি অন্যতম বিখ্যাত এবং বাণিজ্যিকভাবে খুব সফল একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গণ্য হন। অনেকের কাছেই তিনি অনুপ্রেরণা স্বরূপ। তার থেকে বহু পরিচালক বিভিন্ন কৌশল শেখার সুযোগ পান এবং চলচ্চিত্র পরিচালনা আরো ভালো ভাবে করার জন্য অনুপ্রাণিত হন।
Frequently Asked Questions :
১৯৪৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর।
এস্কেপ টু নোহোয়ার
তিনবার