সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ জীবনী রচনা / Biography of Syed Mustafa Siraj in Bengali

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ জীবনী রচনা

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ছিলেন ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের একজন সুবিখ্যাত লেখক। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ নিজের জীবদ্দশায় ১৫০ টি উপন্যাস এবং ৩০০ টি ছোটগল্প লিখেছেন। লেখক হিসেবে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়তার অধিকারী ছিলেন। তাঁর লেখাগুলো পাঠকদের মধ্যে বহুল প্রশংসা অর্জন করে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা এই সুলেখকের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর  জন্ম ও পরিবার পরিচয়, Birth and family identity of Syed Mustafa Siraj

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ১৯৩০ সালের ১৪ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম হয় তৎকালীন ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মুর্শিদাবাদ জেলার, খোশবানপুর গ্রামে। লেখকের বাবার নাম ছিল সৈয়দ আবদুর রহমান এবং মায়ের নাম আনোয়ারা বেগম। সিরাজ এমন এক পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন যে বাড়িটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আবৃত্ত ছিল।

তাঁর বাড়ির লোকজন বই পড়তে ভালোবাসতেন। পরিবারের প্রায় সকলেই আরবি, ফার্সি এবং অন্যান্য কিছু ভাষা সহ সাতটি ভাষা জানতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাত্র নয় বছর বয়সে সিরাজ নিজের মাকে হারিয়েছিলেন। 

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর  জন্ম ও পরিবার পরিচয়

লেখকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, Educational qualification of Syed Mustafa Siraj 

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি বহরমপুর কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি বি.এ পাশ করেন।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর কর্মজীবন, Syed Mustafa Siraj career

লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। একসময় তিনি রাঢ় বাংলার লোকনাট্য “আলকাপ” নামে একটি লোকনাট্য গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন। সেখানে তিনি বাঁশি বাজানো এবং নৃত্য ও অভিনয় শেখানোর কাজ করতেন। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি বেশ কিছু জায়গায় অনুষ্ঠান করেছিলেন।

তিনি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান সহ কলকাতাতেও অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি এই লোকনাট্য গোষ্ঠী ত্যাগ করেন এবং কবিতা লিখতে শুরু করেন। লেখার সময় তিনি নিজের আসল নাম ব্যবহার না করে ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। তাঁর ছদ্মনাম ছিল ‘ইবলিশ’।

এই ছদ্মনামে লেখক ‘কাঁচি’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন। বহরমপুর থেকে ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকায় উক্ত গল্পটি প্রকাশিত হয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখা প্রথম কবিতার নাম ‘শেষ অভিসার’। তাঁর একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল ‘লাল শিমুলের দিন’।

 সৈয়দ আবদুর রহমান একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তাঁর এই জ্ঞান তিনি নিজের লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং বৃহত্তর লেখার জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথমবার ছোটগল্প প্রকাশ করেন।

তাঁর স্বনামে রচিত প্রথম ছোটগল্প ‘ভালোবাসা ও ডাউন ট্রেন’ প্রকাশিত হয় উক্ত পত্রিকায়। এই সময়েই তিনি যুক্ত হন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সঙ্গে। কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। তবে সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি লেখার কাজও চালিয়ে যান। 

সাহিত্যে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অবদান, Syed Mustafa Siraj contribution and literature 

সাহিত্যে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অশেষ অবদান রয়েছে। তিনি পাঠকদের মনোরঞ্জনের জন্য বহু কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছিলেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে লেখেন ‘খোশবাসপুরের গুপ্তকথা’।

শৈশবে মাতৃ বিয়োগের পর সৈয়দ নিজের পিতার সঙ্গে বর্ধমানের কর্ড লাইনে নবগ্রাম রেল স্টেশনের কাছে কিছুদিন ছিলেন। সেই নবগ্রাম গোপালপুরের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেন ‘প্রেমের প্রথম পাঠ’ উপন্যাস। এটি ছিল তাঁর লেখকজীবনের প্রথম দিকে লেখা একটি সুখ্যাত উপন্যাস। সময়ের সাথে সাথে এক এক করে প্রকাশ হতে থাকে ‘ পিপি ও ঘাটবাবু’, ‘হিজল বিলের রাখালেরা’, ‘তরঙ্গিণীর চোখ’, ‘উড়ো পাখির ছায়া’, ‘মানুষের জন্ম’, ‘রণভূমি’, ‘রক্তের প্রত্যাশা’, ‘মাটি’ প্রভৃতির মত তাঁর লেখা অসাধারণ কিছু গল্প।

এই গল্পগুলি তাঁকে লেখক হিসেবে জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯৬৬ সালে সিরাজের প্রথম উপন্যাস ‘নীল ঘরের নটি” প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তাঁর রচিত বিখ্যাত ছোটোগল্প  ‘রানির ঘাটের বৃত্তান্ত’ অবলম্বনের বাংলা সিনেমা তৈরি হয়েছে, যার নাম ছিল ‘ফালতু” ।

২০০৭ সালে উক্ত ছবি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিল। সাহিত্য শিল্পী সিরাজের গল্প এবং বেশ কিছু গ্রন্থ ভারতের সমস্ত স্বীকৃত ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এছাড়াও ইংরেজি সহ বিশ্বের বহু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা বিশেষ কিছু গ্রন্থ৷

তাঁর লেখায় বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া যায়, যেমন সিরাজ রচিত ‘তৃণভূমি” উপন্যাসে কান্দি মহকুমার এক বৃহৎ অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয় বর্ণিত আছে। উপন্যাসটি ছাপা হয় অধুনালুপ্ত ‘ধ্বনি’ নামক এক ছোট পত্রিকায়। “উত্তর জাহ্নবী” উপন্যাসে আছে এক বিশেষ সময় ও সমাজের কথার উল্লেখ, যা বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত।

অন্যদিকে “অলীক মানুষ” এ আছে এক বিস্তৃত ভুবনের কাহিনী, যা তাঁকে ভিন্ন লেখকের মর্যাদার চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত করেছে। উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয় ‘চতুরঙ্গ’ নামে একটি লিট্‌ল ম্যাগাজিনে। তিনি ‘ আনন্দ বাজার ‘ এর মত বড় পত্রিকায় চাকরি করলেও তাঁর সেরা উপন্যাসগুলি ছাপা হয়েছে ছোট পত্রিকায়। এসব ছাড়াও তিনি কিশোর ও প্রাপ্তববয়স্ক পাঠকদের দাবি মেটানোর জন্য সৃষ্টি করেছিলেন “গোয়েন্দা কর্নেল” নামে একটি বিশেষ চরিত্র।

লেখকের তাঁর পাঠকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মধুর। এমনকি তাঁর সার্বিক ব্যবহারে ও আচরণে ছিল পরিশীলিত ভদ্রতা ও আন্তরিকতা, যার ফলস্বরূপ তিনি নিজের সহকর্মী তথা পাঠকমহলে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, “আমার পরেই সিরাজ, সিরাজই আমার পরে অধিষ্ঠান করবে।” তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যের প্রসঙ্গে সিরাজ বলেছিলেন , ” তারাশঙ্কর তো হিমালয় , আমি তাঁর তুলনায় উইঢিবি মাত্র “।

সিরাজের লেখা ভৌতিক গল্প, Syed Mustafa Siraj horror stories

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর রচিত ভৌতিক গল্পের সংখ্যা প্রচুর। মূলত ছোটদের কথা মাথায় রেখেই লিখেছেন তাঁর সিংহভাগ ভৌতিক কাহিনী। তবে সেই গল্পগুলো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিগণের মধ্যেও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কলকাতার রেডিও মির্চির জনপ্রিয় বেতার অনুষ্ঠান “সানডে সাসপেন্স” এ তাঁর লেখা বিভিন্ন গল্পের পাশাপাশি বেশ কিছু ভৌতিক কাহিনী সম্প্রচারিত হয়েছে। সিরাজের লেখা উল্লেখযোগ্য ভৌতিক গল্পগুলি হল :

  • আজমগড়ের অশরীরী
  • খুলি যদি বদলে যায়
  • হরির হোটেল
  • ভূতে-মানুষে
  • তিন-আঙুলে দাদা
  • সেই সব ভূত
  • ডনের ভূত
  • রাতের মানুষ
  • চোর বনাম ভূত
  • রাতদুপুরে অন্ধকারে
  • আম কুড়োতে সাবধান
  • সত্যি ভূত মিথ্যে ভূত
  • ছুটির ঘণ্টা
  • ভুতুড়ে ফুটবল
  • ম্যাজিশিয়ান-মামা
  • ভৌতিক বাদুড় বৃত্তান্ত
  • তুতানখামেনের গুপ্তধন
  • মুরারিবাবুর মোটরগাড়ি
  • ভুতুড়ে বেড়াল
  • ঝড়ে-জলে-অন্ধকারে
  • কেংকেলাস
  • মুরারিবাবুর টেবিলঘড়ি
  • স্টেশনের নাম ঘুমঘুমি
  • ভূত নয় অদ্ভুত
  • অদ্ভুত যত ভূত
  • মুরারিবাবুর আলমারি
  • শ্যামখুড়োর কুটির
  • বাঁচা-মরা
  • অন্ধকারে রাতবিরেতে
  • কেক্রাদিহির দণ্ডীবাবা
  • অদলবদল
  • জটায়ুর পালক ইত্যাদি।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর ব্যক্তিগত জীবন, Syed Mustafa Siraj personal life

সুখ্যাত ভারতীয় লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের স্ত্রীর নাম হাসনে আরা সিরাজ। 

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার, Awards and Recognition

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ নিজের কর্মজীবনে নিজের অসাধারণ উপন্যাস ও গল্পগুলোর মাধ্যমে সাহিত্যে বিশাল অবদান রেখেছেন, আর এর পরিপ্রেক্ষিতে পেয়েছেন বহু পুরস্কার। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: আনন্দ পুরস্কার , সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার , বঙ্কিম পুরস্কার, ভুয়ালকা পুরস্কার, শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার , বিদ্যাসাগর পুরস্কার , দীনেশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, নরসিংহদাস পুরস্কার প্রভৃতি।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জীবনাবসান, Syed Mustafa Siraj death

লেখকের জীবন কাল ছিল ৮১ বছরের। ২০১২ সালের ৪ ঠা সেপ্টেম্বর কলকাতায় নিজ বাসভূমিতে বার্ধক্য জনিত শারীরিক অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরং করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮১ বছর।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জীবনাবসান

উপসংহার, Conclusion 

বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক হলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তাঁর কবিতা, উপন্যাস, ছোটোগল্প পাঠকদের যথার্থভাবে মনোরঞ্জন করে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষত রাঢ় অঞ্চলের উল্লেখ তাঁর রচনায় বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। বাংলা সাহিত্যে অতুল কৃতিত্বের জন্য তিনি বেশ কিছু সন্মান ও পুরস্কারও পেয়েছেন। তিনি বহু নতুন লেখককে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং তাঁর লেখাগুলো ভবিষ্যত লেখকদেরকেও উৎসাহ প্রদান করবে।

Frequently Asked Questions

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের তাঁর শৈশবে কোন্ রচনাটি লেখেন ?

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের তাঁর শৈশবে কোন্ রচনাটি লেখেন ?

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছদ্মনাম কী ?

ইবলিশ

ইবলিশ ছদ্মনামে লেখক কোন্ রচনাটি লিখেছিলেন ? 

কাঁচি’ নামে একটি গল্প।

কাঁচি’ গল্পটি কোন্ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ?

হরমপুর থেকে প্রকাশিত ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকায়

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখা প্রথম কবিতার নাম কী ?

শেষ অভিসার।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের স্বনামে প্রকাশিত প্রথম গল্পের নাম কী ?

ভালোবাসা ও ডাউন ট্রেন

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts