আবু তারেক মাসুদ ছিলেন একজন বাংলাদেশি স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক এবং গীতিকার। তাঁর প্রথম ফিচার চলচ্চিত্র হল মাটির ময়না (২০০২), যার জন্য তিনি ২০০২-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়া তারেক মাসুদের আগ্রহের বিষয় ছিল লোকসঙ্গীত এবং লোকজ ধারা। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা তারেক মাসুদের জীবনী নিয়ে আলোচনা করবো।
তারেক মাসুদের প্রাথমিক জীবন, Early life of Tareque Masud :
তারেক মাসুদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ ও মায়ের নাম নুরুন নাহার মাসুদ। তারেক মাসুদের চাচার মেয়ে, অর্থাৎ তবে বোনের ছেলে নজরুলগীতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। তারেক মাসুদের চাচাতো বোন তাহমিনা রাব্বানি শাম্মি, চাচাত ভাই বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী মাহমুদুর রহমান বেনু ও ছোটো ভাই হচ্ছেন নাহিদ মাসুদ।
তারেক মাসুদের শিক্ষাজীবন, Educational Life Of Tareque Masud :
তারেক মাসুদ ভাঙ্গা উপজেলার ঈদগা মাদ্রাসায় প্রথম পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকার লালবাগের এক মাদ্রাসা থেকে মৌলানা পাস করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তাঁর মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের পর তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেন এবং পাশ করেন। এরপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। স্নাতক বিষয়ে পড়াশুনা করার জন্য তিনি প্রথমে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়ে, ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তাঁকে বেশিরভাগ সময়েই ঢাকা আর্ট কলেজে কাটাতে দেখা যেত। বলতে গেলে, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন থেকেই তিনি লেখক শিবির, বাম আন্দোলন এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র জীবন, Film career Tareque Masud :
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ১৯৮২ সালের শেষ দিকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স করেছিলেন তিনি। কোর্স শেষ করে তিনি নিজের জীবনের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করার কাজ শুরু করেন, যা করতে লেগেছিল সাত বছর।
১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আদম সুরত’ প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছিল প্রখ্যাত বাংলাদেশী শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের উপর। এরপর তিনি বেশ কিছু ডকুমেন্টারি, অ্যানিমেশন এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তারেক মাসুদের পরিচালিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সোনার বেড়ি (১৯৮৫)।
সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র রানওয়ে (২০১০)।
১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একটি ভ্রাম্যমাণ গানের দলকে নিয়ে মুক্তির গান নির্মাণ করেন। মার্কিন নির্মাতা লিয়ার লেভিনের ১৯৭১ সালে ক্যামেরাবন্দী কিছু ফুটেজের সাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংরক্ষণাগার থেকে নেয়া ফুটেজ জুড়ে দিয়ে এই ছবিটি নির্মাণ করা হয়। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করার জন্য তিনি ১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার লাভ করেন।
২০০২ সালে তাঁর নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মাটির ময়না মুক্তি পায়। ছবিটি তিনি নিজের শৈশবে মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্মিত। ছবিটির জন্য মাসুদ দেশে-বিদেশে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে।
তাছাড়াও চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং “একটি দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের হৃদয়স্পর্শী ও স্বচ্ছ উপস্থাপনা”র জন্য মাসুদ ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট লাভ করেন। অন্যদিকে উল্লেখ্য ছবির জন্য তিনি ২৭তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কারও লাভ করেছিলেন।
এছাড়া মারাকেচ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ক্যাথরিন মাসুদের সাথে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার লাভ করেন তিনি। পাশাপাশি গোল্ডেন স্টারের মনোনয়ন লাভ করেন। এছাড়াও কেরালা চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন ক্রো ফিজেন্ট পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছিলেন তিনি।
এসব ছাড়াও ছবিটি বাংলাদেশ থেকে অস্কারের বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র শাখায় নিবেদন করা হয়েছিল।
মাসুদের পরবর্তী চলচ্চিত্র ছিল ‘অন্তর্যাত্রা’ (২০০৬)। ছবিটি দুটি প্রজন্মকে তুলে ধরেছিল, যারা বাংলাদেশ থেকে লন্ডন চলে যায় এবং পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসে।
দেশে ছড়িয়ে পরা জঙ্গিবাদ ও এর প্রভাব নিয়ে ২০১০ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘রানওয়ে’। এতে এক যুবককে ইসলামী শিক্ষার আড়ালে জঙ্গিবাদে উদ্ধুদ্ধ করার গল্প দেখানো হয়। উক্ত ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য মেরিল-প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার লাভ করেন।
মাসুদের শেষ তথা অসম্পূর্ণ কাজ ছিল ‘কাগজের ফুল’। ছবিটি ছিল ভারত বিভাগের গল্প নিয়ে তৈরি। এটি মূলত মাটির ময়নার পূর্ববর্তী পর্ব হিসেবে নির্মিত হচ্ছিল।
তারেক মাসুদের উল্লেখযোগ্য কর্ম, Notable Works of Tareque Masud :
- মাটির ময়না
- আদি নিবাস
- ফরিদপুর জেলা
- আন্দোলন
- চলচ্চিত্র আন্দোলন
- দাম্পত্য সঙ্গী
- ক্যাথরিন মাসুদ
- সন্তান
- নিষাদ বিংহাম পুত্রা মাসুদ
সম্মাননা, Honorableness :
চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে।
২০১৩ সালে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান/প্যাসিফিক/আমেরিকান ইন্সটিটিউট এবং দক্ষিণ এশিয়া সলিডারিটি ইনিশিয়েটিভ তাঁর চলচ্চিত্রের প্রথম উত্তর আমেরিকান ‘ফিরে দেখা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে একজন তিনি। সংগঠন শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। ১৯৮৮ সালে তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের কো-অডিনেটর হিসেবে কাজ করেন।
এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি কয়েকটি সাময়িকী ও পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখার কাজ করতেন।
ব্যক্তিগত জীবন, Personal Life :
তারেক মাসুদের স্ত্রীর নাম ক্যাথরিন মাসুদ। তিনি একজন মার্কিন নাগরিক। ক্যাথরিন এবং তারেক মিলে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। এর নাম দিয়েছিলেন অডিওভিশন। এই দম্পতির ‘বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ’ নামে এক ছেলে আছে।
তারেক মাসুদের মৃত্যু, Death of Tareque Masud :
তারেক মাসুদের মৃত্যু হয়েছিল সড়ক দুর্ঘটনায়। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ‘কাগজের ফুল’ নামক চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য লোকেশন দেখার উদ্দেশ্যে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে মানিকগঞ্জের সালজানা গ্রামে যান। ছবির শুটিংয়ের জন্য লোকেশন নির্বাচন শেষ করে ঢাকার উদ্দেশ্যে গাড়িবহর নিয়ে রওনা দেন তারেক মাসুদ ও তাঁর সঙ্গীরা।
পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সঙ্গে তাদের মাইক্রোবাসটির মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই তারেক মাসুদ এবং তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরের মৃত্যু হয়। এই দুর্ঘটনায় তারেকের সাথে কাজ করা ওয়াসিম, সেট ডিজাইনার জামাল হোসেন, মাইক্রোবাসের চালক মোস্তাফিজও মারা যান। এছাড়াও আহত হন তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন ও চিত্রশিল্পী দিলারা বেগম জলি।
মাসুদের নামে তৈরি চলচ্চিত্র সংসদ, Film Council created in the name of Masud :
তারেক মাসুদের নামে গড়ে তোলা বাংলাদেশের একটি চলচ্চিত্র সংসদ হল ‘তারেক মাসুদ ফিল্ম সোসাইটি’। উক্ত সোসাইটির প্রধান উদ্যোক্তা সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক এইচ. এম. মেহেদী হাসান। তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠক রেজাউল করিমকে সাথে নিয়ে এক বছর ধরে প্রস্তুতি নেন। তারপর ২০২২ সালের ২৬ শে মার্চ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের নিয়ে একটি সম্মেলন আয়োজন করেন। প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যে সোসাইটি সব শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড থেকে সনদ লাভ করে।
তারেক মাসুদের প্রকাশিত বই, Books published by Tareque Masud :
তারেক মাসুদের জীবনাবসান ঘটার পর ২০১২ সালে তাঁর লেখা চলচ্চিত্র সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলোকে একত্র করে “চলচ্চিত্র যাত্রা” নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটিতে ভূমিকা লিখেছেন ক্যাথরিন মাসুদ। লেখক হবার একটা টান সবসময়ই ছিল তারেকের মাঝে। তিনি একবার বলেছিলেন,
“চলচ্চিত্রকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম।”
শেষ কথা, Conclusion :
তারেক মাসুদের উল্লেখযোগ্য কর্মের কথা জানার পর মনে হয় যেন তিনি আজ বেঁচে থাকলে দেশের জনগণ তথা বিশ্বকে বহু সংখ্যক ভালো চলচ্চিত্র উপহার দিতে পারতেন। আশা করি আমাদের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা তারেক মাসুদের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
Frequently Asked Questions
ক্যাথরিন মাসুদ
চলচ্চিত্র যাত্রা
সড়ক দুর্ঘটনায়