বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হলেন ওয়ারেন বাফেট; অন্যদিকে তিনি স্টক মার্কেট প্লেয়ার হিসেবে খ্যাত। তাছাড়া ওয়াল স্ট্রিট জাদুকর নামেও পরিচিত তিনি। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বিল গেটস নিজের সেরা বন্ধু এবং প্রেরণা হিসাবে ওয়ারেন বাফেটকে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি এমন একজন সফল ব্যক্তি, যাকে ঘিরে এই বিশ্বের অর্থনীতি আবর্তিত রয়েছে। বাফেট বিলিয়ন ডলার আয় করেন তবুও তার সততা ও পেশাদারিত্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। তিনি বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের মালিকানার অধিকারী। আজ আমরা মার্কিন ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেটের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
ওয়ারেন বাফেট এর পরিচয়, Warren Buffett’s identity
ওয়ারেন বাফেট মূলত একজন মার্কিন ব্যবসায়ী তথা বিনিয়োগকারী এবং জনহিতৈষী ব্যক্তি। বিংশ শতকের সবচেয়ে সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে ওয়ারেন বাফেটকে ধরা হয়। অন্যদিকে বাফেট বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসেবেও সুপরিচিত। তিনি বহু বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।
ওয়ারেন বাফেট এর জন্ম ও শৈশব জীবন, Birth and Childhood
ওয়ারেন বাফেটের জন্ম হয় ১৯৩০ সালের ৩০ শে আগস্ট। তিনি ওমাহার নেব্রাস্কা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ওমাহার বাসিন্দা ছিলেন বলে তাঁকে ওমাহার দেবনী বা ওমাহার ওরাকলও বলা হয়ে থাকে। তাঁর পিতার নাম হাওয়ার্ড বাফেট এবং মায়ের নাম লীলা স্টল। ওয়ারেনের বাবাও পেশাগত দিক থেকে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগকারী এবং একজন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন, সে সূত্রে বলা যায় যে ওয়ারেন নিজের মধ্যে বিনিয়োগের শিল্প উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন।
নিজের বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও শেয়ার বাজারেই ভবিষ্যত খুঁজে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তিনি আজও, ওমাহাতে নিজের কেনা প্রথম বাড়িতেই থাকেন, যা তাঁর সরলতা এবং উচ্চ চিন্তাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। ওয়ারেন বাফেটের পূর্বপুরুষের উপাধি ছিল ফিশার, তাই তিনি নিজের বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে নিজেকে ফিশার বলে সম্বোধন করেছেন।
শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন দিক, Educational experiences
ওয়ারেন বাফেট ওয়াশিংটন ডিসির উড্রো উইলসন হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন। পরবর্তীতে তিনি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ার্টন স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি সেখানে মাত্র দুই বছর অধ্যয়ন করেছিলেন, পরে ওই কোর্স ছেড়ে দেন এই বলে যে সেখানকার অধ্যাপকদের থেকে তিনি নাকি বেশি জানেন। তারপর ওয়ারেন বাফেট নেব্রাস্কা লিঙ্কন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলম্বিয়া স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টে ব্যবস্থাপনা অধ্যয়ন করেন তিনি। সেখানে বেঞ্জামিন গ্রাহামের ক্লাসে তিনি A+ গ্রেড পান এবং সেখান থেকেই অর্থনীতিতে M.S. ডিগ্রি অর্জন করেন, যা পরবর্তীতে বাফেটের পুরো জীবনকে বদলে দিয়েছিল।
ওয়ারেন বাফেট এর ব্যবসায়িক জীবনের শুরু, Warren Buffett’s business career
কলম্বিয়া স্কুলে অধ্যয়ন কালে বেঞ্জামিন গ্রাহামের সাথে যদি ওয়ারেন বাফেটের দেখা না হতো তবে হয়তো তাঁর জীবন স্বাভাবিকই রয়ে যেত। কিন্তু বেঞ্জামিন ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি ওয়ারেনের ব্যবসায়িক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন। তৎকালীন সময়ে বেঞ্জামিনও একজন স্টক মার্কেট বিনিয়োগকারী এবং পরামর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওয়ারেন বাফেট তাঁর থেকেই বিনিয়োগের বিভিন্ন কৌশল শিখে নিয়েছিলেন। বাফেট নিজেও বেশ কিছু সাক্ষাত্কারে এ বিষয় স্বীকার করেছেন যে তিনি ১৫ শতাংশ ফিশার এবং ৮৫ শতাংশ বেঞ্জামিন গ্রাহাম।
বেঞ্জামিনের থেকে বিভিন্ন কিছু শেখার পর ওয়ারেন স্টক মার্কেটের দুনিয়ায় নাম কামানোর পথে বেরিয়ে পড়েন। বেঞ্জামিন থেকে তিনি শিখে নিয়েছিলেন যে শেয়ারবাজারের অস্থিরতাকে কীভাবে নিজের লাভের মাধ্যম করা যায়। বাফেট প্রথম ব্যবসা শুরু করেন ১৩ বছর বয়সে। ১৯৪৩ সালে তিনি প্রথম আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছিলেন। তিনি ১৫ বছর বয়সে একটি পিনবল কিনেছিলেন এবং এর কয়েক মাসের মধ্যে তিনি আরো তিনটি পিনবলের মালিক হয়ে উঠেছিলেন।
এরপর নতুন ব্যবসা চালু ছিল। তবে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, ওয়ারেন সর্বদা সবক্ষেত্রে সফল ছিলেন না। ওয়ারেন বাফেট নিজের প্রাথমিক বিনিয়োগে একটি গ্যাস স্টেশন ক্রয় করেন, যেখানে তাঁকে অনেক লোকসান সহ্য করতে হয়। পরবর্তীতে ২২ বছর বয়সে এসে তিনি ব্যবসার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জয়ী হয়েছিলেন।
ওয়ারেন বাফেট এর ব্যাক্তিগত জীবন, Personal life
ওয়ারেন বাফেটের পেশাগত জীবনের মতো ব্যক্তিগত জীবনও ছিল উত্তেজনায় ভরপুর। ১৯৫২ সালে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রীর নাম সুসান বাফেট। এই দম্পতির সন্তান ছিল তিনজন। ১৯৫৩ সালে, প্রথম সন্তান এলিস বাফেটের জন্ম হয়, এর কয়েক বছর পর হাওয়ার্ড এবং পিটারের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু বিবাহের কিছু বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর, তারা ১৯৭৭ সাল থেকে আলাদা বসবাস করতে শুরু করেন, যদিও পরস্পরের মধ্যে কেউই কখনও বিবাহবিচ্ছেদ করেন নি।
২০০৪ সালে সুসানের মৃত্যু হয়, এর ঠিক দুই বছর পর ওয়ারেন অ্যাস্ট্রিড ম্যাঙ্কসকে বিয়ে করেন। ব্যাক্তিগত জীবনের অন্য দিকে দেখতে গেলে, ওয়ারেন বাফেট ব্রিজ খেলতে খুব পছন্দ করেন। এই খেলায় তিনি বেশিরভাগ সময়ই বিল গেটস এবং পল অ্যালেনকে নিজের সঙ্গী করতেন। তাছাড়া একসময় তিনি গলফ খেলার জন্য রাইডার কাপের আদলে এক প্রতিযোগিতা আয়োজিত করেছিলেন।
ওয়ারেন বাফেট এর সফলতা, Success of Warren Buffet
ওয়ারেন বাফেট ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজ করার সুযোগ পান বেঞ্জামিন গ্রাহামের সহায়তায়। গ্রাহাম তাঁকে নিজের ফার্মে $12,000 বেতনের একটি চাকরিতে নিয়োগ করেন। এই চাকরি করার সময়ই বাফেট স্টক মার্কেটের উত্থান-পতনকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার কিভাবে করতে পারেন তা বোঝার সুযোগ পান।
বেঞ্জামিন গ্রাহাম অবসর নেওয়ার পর ওয়ারেন বাফেট নতুনভাবে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করেন। তখন তিনি বাফেট পার্টনারশিপ লিমিটেড নামক এক বিনিয়োগ সংস্থা গঠন করেন। উক্ত ফার্মের মাধ্যমে হওয়া উপার্জন দিয়ে বাফেট নিজের প্রথম তথা বর্তমান বাড়িটি ৩১ হাজার ৫০০ ডলারের বিনিময়ে কিনেছিলেন।
১৯৬২ সাল নাগাদ, আমেরিকার একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। এরপর বাফেট বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে কোম্পানির শেয়ার কেনা শুরু করেন এবং ১৯৬৫ সাল নাগাদ তিনি এই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে সক্ষম হন। এরপর বার্কশায়ারও দ্রুত গতিতে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করে। তিনি ৭৫ বছর বয়সে অবসর ঘোষণা করেন এবং নিজের সম্পত্তির একটি বড় অংশ স্থানান্তর করেন মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনে ।
ওয়ারেন বাফেট এর লেখা বিখ্যাত বইগুলি, Famous books written by Warren Buffet
ওয়ারেন বাফেট নিজের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বই লেখার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর লেখা বইগুলি বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। বাফেটের উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল :
Dream Big
Buffetology
The Outsiders
First A Dream
Enlightenment Now
Security Analysis
Nuclear Terrorism
Take On The Street
Essays In Persuasion
The Wealth Of Nations
The Warren Buffett Way
Poor Charlie’s Almanack
Jack: Straight From The Gut
The Theory Of Investment Value
সম্মাননা, Recognition
১৯৭৯ সালের প্রথম বছর ফোর্বসের ধনী তালিকায় ওয়ারেন বাফেট প্রথমবারের জন্য নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন। ফোর্বস ম্যাগাজিনের প্রকাশিত র্যাঙ্কিং অনুসারে, ২০০৮ সালে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী ওয়ারেন বাফেট বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিদের একজন। উক্ত তালিকা অনুযায়ী তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। তাছাড়া ওয়ারেন বাফেট ২০১১ সালে বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। টাইম ম্যাগাজিন ২০১২ সালে ওয়ারেন বাফেটকে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
উপসংহার, Conclusion
ওয়ারেন বাফেট বিশ্বকে শিখিয়েছেন যে ধনী হওয়ার চেয়ে দয়ালু হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ারেন বাফেট নিজের জীবন সরলতার সাথেই অতিবাহিত করেছেন। বিশ্বের এই অন্যতম ধনী ব্যক্তি সর্বদা নিজেই নিজের গাড়ি চালান, তাছাড়া তার ডেস্কে কখনো কোনো সেল ফোন বা কম্পিউটার থাকে না।
তিনি বিশ্বকে এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, আপনি কত টাকা উপার্জন করেন তা কখনোই বিবেচ্য নয়, বরং আপনি কীভাবে এই টাকা বিনিয়োগ করেন তা হল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
Frequently Asked Questions :
ওয়ারেন বাফেট একজন ব্যবসায়ী ।
ওয়ারেন বাফেট এর জন্ম হয় আমেরিকায় ।
ওয়ারেন বাফেট এর জন্ম হয় ৩০ আগস্ট ১৯৩০ সালে ।
ওয়ারেন বাফেট হ্যাথাওয়ের মালিক ।
ওয়ারেন বাফেট এর একটি বইয়ের নাম Poor Charlie’s Almanack .
ওয়ারেন বাফেট এর প্রথম স্ত্রীর নাম Susan Thompson Buffett .
ওয়ারেন বাফেট এর কর্মজীবন ১৯৫১ সালে শুরু হয় ।
ওয়ারেন বাফেট ৭৫ বছর বয়সে অবসর নেন ।