আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। তিনি একাধারে একজন গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদকও। তিনি সারা বিশ্বে রক ব্যান্ড ‘এল আর বি’ এর গায়ক ও গীটারবাদক হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা বাংলাদেশের এই বিখ্যাত গায়কের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম, Birth of Ayub Bachchu :
আইয়ুব বাচ্চুর পুরো নাম আইয়ুব বাচ্চু রবিন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬২ সালের ১৬ ই আগস্ট। স্বনামধন্য এই গায়কের জন্ম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে (বর্তমান বাংলাদেশ)। আইয়ুবের পিতার নাম ইশহাক চৌধুরী এবং মাতার নাম নুরজাহান বেগম। তাঁর পরিবারটি ছিল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। তাদের পরিবারে সবাই ধার্মিক ছিলেন এবং সঙ্গীতকে বাচ্চুর নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা কেউ সহজে গ্রহণ করেননি। আইয়ুব বাচ্চুর আরো দুজন ভাই-বোন ছিল। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
গায়কের শিক্ষাগত যোগ্যতা, Singer’s Educational Qualification :
১৯৭৫ সালে আইয়ুব বাচ্চু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭৯ সালে তিনি উক্ত স্কুল থেকে এস এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর অধীনস্থ চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ক্রমে একই কলেজে থেকে তিনি স্নাতকোত্তর শিক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন।
আইয়ুবের দাম্পত্য সঙ্গী, Ayub’s spouse :
সংগীতজ্ঞ আইয়ুব বাচ্চু দাম্পত্য সঙ্গী হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন ফেরদৌস আইয়ুব চন্দনাকে। ১৯৯১ সালের ৩১শে জানুয়ারিতে তাদের বিবাহ হয়। তাদের দাম্পত্য সংসারে দুইজন সন্তান রয়েছে। মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব এবং ছেলে আহনাফ তাজওযার আইয়ুব।
কর্মজীবনের শুরু, Career of Ayub :
১৯৭৩ সালে বাচ্চুর বাবা তাঁকে তাঁর ১১তম জন্মদিনে একটি গীটার উপহার দেন। কৈশর জীবনের শুরুর দিক থেকে তিনি বিভিন্ন ব্রিটিশ এবং আমেরিকান রক ব্যান্ডের গান শোনা শুরু করেন, তন্মধ্যে জিমি হেনড্রিক্স এর গীটার বাজানো তাঁকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল। তিনি গীটার বাজানো শিখেছিলেন জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ ব্যক্তির কাছে, যে তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামে থাকতো। ১৯৭৬ এর দিকে তিনি নিজের বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে ইলেকট্রিক গীটার বাজানো শিখেছিলেন, যা ছিল একটি টিস্কো গীটার।
সঙ্গীত জগতে আইয়ুব বাচ্চুর কর্মজীবনের সময়কাল হল ১৯৭৭–২০১৮ সাল অবধি। বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের শিরোমণি আইয়ুব বাচ্চু প্রথম গান প্রকাশ করেন ১৯৭৭ সালে ‘হারানো বিকেলের গল্প’ শিরোনামে। তবে তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ বের হয় ১৯৮৬ সালে আর দলীয় গানের প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে।
আইয়ুব বাচ্চুর কর্মজীবন শুরু হয়ে গিয়েছিল কলেজ জীবন থেকেই। তিনি ১৯৭৬ সালে কলেজে পড়াশুনা করার সময় “আগলি বয়েজ” নামক ব্যান্ড গঠন করেন। বলতে গেলে এই ব্যান্ডের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গীত জীবনের সূচনা করেছিল।
পরে ১৯৭৭ সালে তিনি “ফিলিংস” (বর্তমানে “নগর বাউল” নামে পরিচিত) নামক ব্যান্ডে যোগদান করেন। উক্ত ব্যান্ডটির সাথে তিনি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাজ করেন।
একই বছরে তিনি যোগদান করেন জনপ্রিয় রক ব্যান্ড সোলস-এর প্রধান গীটারবাদক হিসেবে। উক্ত ব্যান্ডের সঙ্গে তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, সুপার সোলস (১৯৮২), কলেজের করিডোরে (১৯৮৫), মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭) এবং ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট (১৯৮৮) প্রমুখ চারটি অ্যালবামে কাজ করেছিলেন।
পরবর্তীতে, ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল তিনি নিজের ব্যান্ড লিটল রিভার ব্যান্ড গঠন করেছিলেন। এই ব্যান্ড পরবর্তীকালে লাভ রান্স ব্লাইন্ড নামে (সংক্ষেপে এল আর বি) জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি মৃত্যু অবধি অর্থাৎ ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৭ বছর ধরে ব্যান্ডটির সঙ্গে কাজ করেছিলেন।
বলাই বাহুল্য যে, আইয়ুব বাচ্চু একজন একক শিল্পী হিসেবে যথেষ্ট সফলতা পেয়েছিলেন। একের পর এক অ্যালবাম প্রকাশের পর, ২০০৭ সালে তিনি দেশের প্রথম বাদ্যযন্ত্রগত অ্যালবাম সাউন্ড অফ সাইলেন্স প্রকাশ করেন।
আইয়ুব বাচ্চুর পুরস্কার প্রাপ্তি, Award received by Ayub Bachchu :
আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের একজন অন্যতম সেরা গীটারবাদরক এবং অন্যতম প্রভাবশালী গীটারবাদক হিসেবে পরিচিত। এল আর বি ব্যান্ডের সাথে তিনি ছয়টি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন এবং একটি সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস লাভ করেছেন। এছাড়াও ২০০৪ সালে তিনি বাচসাস পুরস্কার জিতেছিলেন। এই পুরস্কারটি তিনি সেরা পুরুষ ভোকাল বিভাগে লাভ করেন। এছাড়াও ২০১৭ সালে সে টেলে সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার জয় করেন।
গায়ক আইয়ুব বাচ্চুর অসুস্থতা, Singer Ayub Bachchu’s illness :
সুখ্যাত গায়ক আইয়ুব বাচ্চু শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ভোগেছিলেন বেশ কিছুদিন। ছয় বছর ধরে ফুসফুসে জল জমার কারণে অসুস্থতায় ভোগেন। তাঁর এই সমস্যার কারণে তিনি ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন। ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর ভর্তি হয়ে সেখানে চিকিৎসা গ্রহণ করার পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।
আইয়ুব বাচ্চুর জীবনাবসান, Death of Ayub Bachchu :
আইয়ুব বাচ্চু ২০১৮ সালের ১৮ই অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন সকালে অসুস্থবোধ করার কারণে তাঁকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানে ডাক্তাররা সকল ৯টা ৫৫ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর দুইদিন আগে তিনি রংপুরে তার শেষ কনসার্ট করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে চট্টগ্রামের চৈতন্য গলি’তে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে, তাঁর মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
গায়কের প্রতিভার স্বীকৃতি, Acknowledgment of Ayub‘s talent :
বাংলাদেশের চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে আইয়ুব বাচ্চুকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ১৮ ফুট উচ্চতার একটি গিটারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ‘ রূপালী গিটার ‘ হল আইয়ুব বাচ্চুর এক জনপ্রিয় গানের শিরোনাম। সেই নাম অনুসারে এই ভাস্কর্যের নাম রাখা হয়েছিল রূপালী গিটার। চট্টগ্রামের মেয়র আজম নাছির উদ্দিন উক্ত ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেছিলেন।
আইয়ুব বাচ্চুর গানের অ্যালবামসমূহ, Ayub Bachchu Song Albums :
১৯৯১ সালে নিজে গঠন করেন ব্যান্ড এলআরবি। তাঁর নিজের ব্যান্ড এলআরবি-র অ্যালবামগুলো হলো :
- ‘এলআরবি’ (১৯৯২),
- ‘সুখ’ (১৯৯৩),
- ‘তবুও’ (১৯৯৪),
- ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫),
- ‘ফেরারী মন’ (১৯৯৬),
- ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬),
- ‘আমাদের বিস্ময়’ (১৯৯৮),
- ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০০),
- ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩),
- ‘মনে আছে নাকি নেই’ (২০০৫),
- ‘স্পর্শ’ (২০০৮)
- ‘যুদ্ধ’ (২০১২)।
একক অ্যালবামের গান :
- রক্ত গোলাপ (১৯৮৬)
- ময়না (১৯৮৮)
- কষ্ট (১৯৯৫)
- সময় (১৯৯৮)
- একা (১৯৯৯)
- প্রেম তুমি কি! (২০০২)
- দুটি মন (২০০২)
- কাফেলা (২০০২)
- প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩)
- পথের গান (২০০৪)
- ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬)
- জীবন (২০০৬)
- সাউন্ড অব সাইলেন্স (২০০৭)
- রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮)
- বলিনি কখনো (২০০৯)
- জীবনের গল্প (২০১৫)
- সুপার সোলস (১৯৮২)
- কলেজের করিডোরে (১৯৮৫)
- মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭)
- ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট (১৯৮৮)
নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে গাওয়া গানসমূহ :
- লুটতরাজ (১৯৯৬)
- সাগরিকা (১৯৯৮)
- লাল বাদশা (১৯৯৯)
- আম্মাজান (১৯৯৯)
- গুন্ডা নাম্বার ওয়ান (২০০০)
- ব্যাচেলর (২০০৪)
- রং নাম্বার (২০০৪)
- চাঁদের মত বউ (২০০৯)
- ৮:০৮-এর বনগাঁ লোকাল (২০১২)
- চোরাবালি (২০১২)
- টেলিভিশন (২০১৩)
- এক কাপ চা (২০১৪)
শেষ কথা, Conclusion :
আইয়ুব বাচ্চুকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং গীটারবাদক বলা হয়। বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি দেশকে আরো ভালো গান উপহার দিতেন। তবে আজও তিনি নিজের গানের মধ্য দিয়ে শ্রোতাদের মনে অমর।
Frequently Asked Questions :
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং গীটারবাদক
বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলা
লাভ রান্স ব্লাইন্ড