বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন সালমান শাহ। (১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ – ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬) অভিনেতা ও মডেল হিসেবে তিনি খুব কম সময়েই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান, জনপ্রিয়, সফল এবং কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সালমান শাহ’ র জন্ম, Birth of Salman Shah :
চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ওরফে সালমান শাহ ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জন্ম হয় বাংলাদেশের সিলেটের দাড়িয়া পাড়ায়। তাঁর নানার বাড়ি ‘আব এ হায়াত’ ভবনে জন্ম হয়েছিল তাঁর, যা এখন সালমান শাহ্ ভবন হিসেবে পরিচিত।
সালমান শাহ’র পিতার নাম কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা নীলা চৌধুরী। তিনি ছিলেন নিজের পরিবারের বড় ছেলে।
সালমান শাহ’ র শিক্ষা লাভ, Education of Salman Shah :
সালমান শাহ’ র পড়াশুনা করেছিলেন খুলনার বয়রা মডেল হাইস্কুলে। উক্ত স্কুল থেকেই চিত্রনায়িকা তথা তাঁর ছবির প্রথম নায়িকা মৌসুমী তাঁর সহপাঠী ছিলেন।
পরবর্তীতে ঢাকার ধানমন্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে ১৯৮৭ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ক্রমে ধানমন্ডির মালেকা সায়েন্স কলেজ (বর্তমান ডক্টর মালিকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ) থেকে বি.কম. পাস করেন তিনি।
সালমান শাহ’র প্রকৃত নাম কি, What is the real name of Salman Shah ?
সালমান শাহ’র প্রকৃত নাম ”চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন”। গণমাধ্যমে তাকে “বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের রাজপুত্র”, “আধুনিক ঢালিউডের প্রথম সুপারস্টার”, “অমর মহানায়ক” এবং “স্বপ্নের নায়ক” উপাধিতে ব্যক্ত করা হয়।
মডেলিং- এর কাজ, Worked as Model :
১৯৮৬ সালে সালমান শাহ সর্বপ্রথম পাবলিক টেলিভিশন বিটিভি তে এক অনুষ্ঠান-এর জন্য একটি মিউজিক ভিডিওর মডেল হিসেবে কাজ করেন। এটাই ছিল টিভির পর্দায় তাঁর প্রথম আবির্ভাব।
এরপর তিনি বেশ কিছু টিভি বিজ্ঞাপনে কাজ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন স্টেজ শোতে মডেল হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
নাটকে অভিনয়, Acting in drama :
১৯৮৫ সালে সালমান বিটিভির ‘আকাশ ছোঁয়া’ নাটক দিয়ে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করেছিলেন। ক্রমে তিনি অনেকগুলো নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পান। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : দেয়াল (১৯৮৫), সব পাখি ঘরে ফিরে (১৯৮৫), সৈকতে সারস (১৯৮৮), নয়ন (১৯৯৫), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬) ইত্যাদি। তাঁর অভিনীত নয়ন নাটকটি ১৯৯৫ সালে শ্রেষ্ঠ একক নাটক হিসেবে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করে।
এছাড়া তিনি মঈনুল আহসান সাবের রচিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘পাথর সময়’(১৯৯০) ও ইতিকথা(১৯৯৪) ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেছিলেন।
সালমান শাহ’র অভিনয়জীবন শুরু, Beginning of Salman Shah’s acting career :
টেলিভিশন নাটক দিয়ে সালমান শাহ’র অভিনয়জীবন শুরু হয়েছিল। ক্রমে ১৯৯০-এর দশকে চলচ্চিত্রে তিনি অন্যতম জননন্দিত শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন।
তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালে। ছবির নাম ছিল ‘ কেয়ামত’, যা ছিল সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত। এই ছবিতে সালমানের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে কাজ করেছিলেন মৌসুমী।
সালমান শাহ সাড়ে তিন বছরের অর্থাৎ স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে সর্বমোট ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত অধিকাংশ সিনেমাই ছিল ব্যবসাসফল। ১৯৯০ দশকের বাংলাদেশে সাড়া জাগানো অনেক চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় এই নায়ক কাজ করেছিলেন।
তাঁর সিনেমাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : বিক্ষোভ, সুজন সখি, কন্যাদান, স্বপ্নের ঠিকানা, মায়ের অধিকার, এই ঘর এই সংসার, সত্যের মৃত্যু নেই, আনন্দ অশ্রু ইত্যাদি।
উল্লেখ্য ছবিগুলোতে অভিনয় করার মাধ্যমে তিনি দেশের শীর্ষ তারকায় পরিণত হন। তিনি বিভিন্ন ঘরানার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পারিবারিক গল্প তো আছেই, এছাড়াও তিনি কমেডি, সামাজিক ও রাজনৈতিক গল্প, অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র, গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত গল্প, আসন্ন যুগের গল্প, রোমান্স এবং ট্র্যাজেডি ভিত্তিক ছবিতে দক্ষতার সাথে বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
সালমান শাহ’র চলচ্চিত্র জীবনে সফলতা, Salman Shah’s success in film career :
চলচ্চিত্রে তিনি নিজের বহুমুখী অভিনয় প্রতিভা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন ধরনের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে নিজের সক্ষমতার পরিচয় দেন। তাঁর দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ছবির ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক সাফল্য ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেন।
বলাই বাহুল্য অনেক কম সময়ের মধ্যে তিনি ঢালিউডে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নেয়া অভিনেতায় পরিণত হন। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ এবং ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ঢালিউড বক্স অফিসে সর্বকালের শীর্ষ দশ সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যবসাসফল ছবির মধ্যে শাবনাজ এর সাথে আশা ভালবাসা ও মায়ের অধিকার, লিমা এর সাথে প্রেমযুদ্ধ ও কন্যাদান, শিল্পী এর সাথে প্রিয়জন, শাহনাজ এর সাথে সত্যের মৃত্যু নেই এবং বৃষ্টি এর সাথে এই ঘর এই সংসার অন্যতম। সালমানের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন শাবনাজ, শাহনাজ, লিমা, শিল্পী, শ্যামা, সোনিয়া, বৃষ্টি, সাবরিনা ও কাঞ্চি।
জনগণের কাছে সালমান শাহ’র গ্রহণযোগ্যতা, Acceptance of Salman Shah to the public :
সালমান শাহ’র সর্বস্তরের জনগণের কাছে ফ্যাশন সেন্স ও ভালো অভিনিয়ের জন্য বিখ্যাত হন। গণমাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সেরা ফ্যাশন আইকন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
দেশের চলচ্চিত্র বিশ্লেষকগণ অর্থপূর্ণ সিনেমার একটি নতুন ব্র্যান্ড প্রবর্তন এবং আধুনিক যুগের নায়কদের অনুপ্রাণিত করার জন্য সালমানের শৈল্পিকতা ও ফ্যাশনকে কৃতিত্ব দেন।
তাঁর অভিনয় দক্ষতা, অভূতপূর্ব সফলতা, ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা, কালজয়ী প্রভাব, খ্যাতির বিস্তৃতি এর কারণে তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় অভিনেতার খেতাব দেয়া হয়েছিল।
সালমান শাহ’র মৃত্যু, Salman Shah’s death :
খ্যাতির চূড়ায় থাকাকালীন অভিনেতা সালমান শাহ প্রাণ হারান। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে চলচ্চিত্র জগৎ সহ সালমানের অনুগামীরা শোকাহত হন। তাঁকে বাংলাদেশের সিলেটের শাহ জালাল (র.) মাজার প্রাঙ্গণে সমাধি দেওয়া হয়েছিল।
সালমান শাহ মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকটি ছবির কাজ অসম্পূর্ণ ছিল। মন মানে না, কে অপরাধী, তুমি শুধু তুমি, প্রেমের বাজি সহ একাধিক মুভি সালমান শাহ অর্ধেক শুটিং করে মারা যান। পরবর্তীতে একমাত্র প্রেমের বাজি ব্যতীত বাকি সকল সিনেমাগুলি অন্য নায়কদের নিয়ে নতুন করে শুটিং করা হয়।
ঢাকার ইস্কাটনে নিজ বাস ভবনে তাঁকে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলেও তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য থেকে যায়। ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশের তদন্ত বিভাগ জানায় যে সালমান শাহ আত্মহত্যাই করেছিলেন।
সালমান শাহ’র ব্যক্তিগত জীবন, Salman Shah’s Personal Life :
সালমান শাহ ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট সামিরা হককে বিয়ে করেন। সামিরা হক পেশায় ছিলেন একজন বিউটি পার্লার ব্যবসায়ী। সালমানের ২টি চলচ্চিত্রে তাঁর স্ত্রী অভিনেতার পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন।
অনেকেই সালমান শাহর মৃত্যুর জন্য স্ত্রী সামিরার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন, এমনকি পরবর্তীকালে সালমানের পরিবারের পক্ষ থেকে স্ত্রী সামিরা ও আরো কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়; কিন্তু পরে এই মামলার আর কোনো অগ্রগতি হয় নি।
সালমান শাহ’র জনপ্রিয়তা, Popularity of Salman Shah :
সালমান শাহ’র অভিনয়, সুদর্শন চেহারা ও ব্যক্তিত্বের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন যা তার মৃত্যুর পর ও বজায় আছে। তাঁর পেশাগত অর্জন, ব্যক্তিগত জীবন, শৈল্পিক সম্ভাবনা, অকাল মৃত্যু এবং স্থায়ী জনপ্রিয়তা সর্বদাই সংবাদ মাধ্যমে আলোচনার বিষয় ছিল। তার দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তার কৃতিত্ব দেওয়া হয় তাঁর পর্দায় উপস্থিতি, সংলাপ বিতরণ, কন্ঠস্বর এবং ফ্যাশন সেন্সকে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা শাকিব খান, আরিফিন শুভ, শরীফুল রাজ, সিয়াম আহমেদ এবং নিরব হোসেন সহ বেশ কয়েকজন সালমানকে শ্রেষ্ঠ নায়ক, ফ্যাশন আইকন এবং অভিনয়ের অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।
সালমান শাহ এর প্রথম ছবি কোনটি, Which is the first film of Salman Shah ?
বাঙালির হৃদয়ের নায়ক সালমান শাহ’র প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন মৌসুমী, সালমান শাহ, রাজিব, আহমেদ শরীফ, আবুল হায়াত প্রমুখ।
সালমান শাহ কত বছর বয়সে মারা গেছে, How old was Salman Shah when he died ?
মাত্র ২৫ বছর বয়সে মারা গেছেন সালমান—অমর এই নায়কের অকালে চলে যাওয়াটা সকলের কাছেই রহস্য, সেটা আত্মহত্যা নাকি হত্যাকাণ্ড তা আজও অজানা।
সালমান শাহ এর শেষ ছবির নাম কি, What is the name of the last movie of Salman Shah ?
সালমান শাহ মারা যাওয়ার পর এ অভিনেতার একমাত্র অসমাপ্ত সিনেমা ‘বুকের ভিতর আগুন’-এর শুটিংয়ে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে এমন অনেক কথাই শুনতে হয়েছিল তখনকার নবাগত নায়ক ফেরদৌস আহমেদকে।
শেষ কথা, Conclusion :
সালমান শাহ অভিনয় দক্ষতা যেমন অসাধারণ ছিল, তেমনি তাঁর স্টাইল ও ফ্যাশন সচেতনতা যুগের চেয়েও অনেক এগিয়ে ছিল মাত্র ২৫ বছরের জীবন তাঁর। চার বছরে ২৭ টি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রেখে গেছেন অসাধারণ সব চলচ্চিত্র। বলা যায়, তাঁর সময়ে দেশের চলচ্চিত্রে নতুন একটি ধারার সূচনা হয়েছিল। বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি ঢালিউডকে আরো বহু ভালো সিনেমা উপহার দিতে পারতেন।
Frequently Asked Questions
টেলিভিশন নাটক দিয়ে অভিনয় শুরু করা ইমন চৌধুরীর ১৯৯৩ সালে সালমান শাহ নামে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার মাধ্যমে।
“বাংলা চলচ্চিত্রের রাজপুত্র”, “আধুনিক ঢালিউডের প্রথম সুপারস্টার”, “অমর মহানায়ক”, “স্বপ্নের নায়ক”।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর।