সময়টি ছিল আঠারো শতক, যখন ব্রিটিশদের রাজধানী হিসেবে কলকাতা (তৎকালীন ক্যালকাটা) ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধ হচ্ছিল। চন্দননগর, যা কলকাতা থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত, সেখানেই বাস করতেন এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মাধব বাবু। তিনি এতটাই নামকরা ছিলেন যে প্রশাসন তাঁর নামানুসারে একটি জলাধার (ট্যাঙ্ক) নামকরণ করেছিল।
তবে, সেসময়ে রঘু নামের এক কুখ্যাত ডাকাতও বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ সরকার তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করেছিল। কিন্তু কেউ কখনো তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি, কারণ তিনি ছিলেন এক রকমের ‘রবিন হুড’।
রঘু ডাকাতের খ্যাতি আসে তাঁর বুদ্ধিমত্তা, সাহস এবং প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাবের কারণে। তিনি ব্রিটিশ এবং তাঁদের মদতপুষ্ট জমিদারদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করতেন। লোকমুখে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন কিংবদন্তি ছড়িয়ে পড়ে, যা তাঁকে এক রহস্যময় এবং আকর্ষণীয় চরিত্রে পরিণত করে।
তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত ধনীদের থেকে লুট করে সেই অর্থ দুর্ভিক্ষপীড়িত পরিবার, বিধবা এবং দরিদ্র শিশুদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন।
তার এই দায়িত্ববোধ এবং মানবতার প্রতি সহানুভূতির জন্য সাধারণ মানুষ তাকে একজন নায়ক হিসেবে দেখত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শেষ সপ্তক’ কবিতার সংকলনে এই রঘুর উল্লেখ করেছেন।
একদিন, মাধব বাবু তাঁর বন্ধুদের সাথে আড্ডারত অবস্থায় রঘুকে নিয়ে একটি মন্তব্য করে ফেলেন। তিনি বলেন,
‘ওর সাহস নেই আমার বাড়িতে আসার। সে জানে আমার বাড়ি যথেষ্ট ভালোভাবে পাহারা দেওয়া হয়।’
তাঁর এক বন্ধু ভয়ে বলে ওঠেন,
‘ওসব বলিস না! রঘু খুব ধুরন্ধর আর ভয়ঙ্কর মানুষ।’
কয়েকদিন পর মাধব বাবু একটি চিঠি পান। তার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়,
‘মাধব বাবু, আমি আপনার বাড়ি একদিন আসতে চাই।’
চিঠিটি স্বাক্ষরিত ছিল অন্য কেউ নয়, স্বয়ং রঘু’র ।
চিঠি পড়ে মাধব বাবু আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কীভাবে তাঁর কথাটা রঘুর কানে পৌঁছাল? প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় মাধববাবু কলকাতা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে নিজ খরচে অতিরিক্ত নিরাপত্তার আবেদন করেন। তবে পরবর্তী কয়েকদিন কিছুই ঘটেনি। ফলে তিনি ধরে নেন এটি হয়তো তাঁর কোনো বন্ধুর মজার ছল ছিল। অবশেষে, অতিরিক্ত নিরাপত্তা তুলে নেওয়া হয়।
কিছুদিন পর গভীর রাতে, অন্ধকারে একটি নৌকা মাধব বাবুর বাড়ির ঘাটে নিঃশব্দে এসে থামে। বাড়ির গেট তালাবদ্ধ থাকলেও নৌকায় আসা লোকেরা নিরুৎসাহিত হয়নি। তাঁরা বাড়ির চারপাশের উঁচু নারকেল গাছ ব্যবহার করে দেয়াল টপকে ছাদে উঠে আসে। রক্ষীদের হত্যা করে তাঁরা প্রতিটি ঘর লুট করে ফেলে। মাধব বাবু শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন।
তারপর কয়েকদিন পর, মাধব বাবু আরেকটি চিঠি পান। সেই চিঠিটি তে লেখা ছিল,
‘আমাদের সেই রাতের সফর কেমন লাগল?’
এবারও চিঠিতে স্বাক্ষর ছিল রঘুর।
এই ঘটনাটি মাধব বাবুর জীবনে একটি গভীর দাগ ফেলে যায় এবং চন্দননগরের ইতিহাসে যেন একটি নতুন কাহিনীর জন্ম দেয়।
রঘু, দেবী কালী’র একনিষ্ঠ ভক্ত, একদিন রাতে প্রশাসনের হাত থেকে পালানোর সময় সে একটি জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ে। সেই জঙ্গলকে ঘিরেই তার মনে হয়েছিল একটি বসতি স্থাপনের কথা। রঘু ও তার সঙ্গীরা সেখানে বসতি স্থাপন করেছিল বলে শোনা যায়। কিংবদন্তি অনুসারে, এক রাতে দেবী কালী স্বপ্নে রঘুর কাছে আসেন এবং তাকে নির্দেশ দেন যে সেই জঙ্গলে একটি মূর্তি স্থাপন করে পূজা করতে হবে। দেবীর আদেশ পালন করে রঘু সেখানে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে এবং নিয়মিত পূজা শুরু করেন।
প্রত্যেক অভিযানের আগে রঘু ‘লোটিয়া মাছ’ (বোম্বাই ডাক) ভেজে দেবীকে নিবেদন করত। তবে কার্তিক মাসের অমাবস্যা রাতে রঘুর ভক্তি এক ভয়াবহ মোড় নেয়। ওই রাতে সে দেবীকে তুষ্ট করতে মানব বলি দিত। যে কেউ ওই রাতে জঙ্গলের কাছে এলে, রঘুর লোকেরা তাকে বন্দী করে হত্যা করত এবং দেবীর কাছে উৎসর্গ করত।
এক অমাবস্যা রাতে বিখ্যাত কবি ও কালীভক্ত রামপ্রসাদ সেন সেই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রঘুর লোকেরা তাকে ধরে ফেলে এবং রঘুর কাছে নিয়ে যায়। রামপ্রসাদ বুঝতে পারেন যে তাকে মানব বলি দেওয়া হবে। তিনি রঘুকে অনুরোধ করেন যে বলি দেওয়ার আগে তাকে দেবী কালী’র উদ্দেশ্যে একটি গান গাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক। রঘু তার শেষ ইচ্ছা মেনে নেয়।
রামপ্রসাদ হাত জোড় করে গান শুরু করেন। গান শুনে রঘু ও তার দলবলের মন পুরোপুরি মুগ্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ রঘু দেখতে পায় দেবী কালী স্বপ্নে এসে দাঁড়িয়ে আছেন, যেন বলি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। রঘু দেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং প্রতিজ্ঞা করে যে সে আর কখনো মানব বলি দেবে না। এই পরিবর্তন তাকে একজন শিক্ষালব্ধ এবং উন্নত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
পরে রঘু রামপ্রসাদ সেনের একনিষ্ঠ ভক্ত ও শিষ্য হয়ে ওঠে। রামপ্রসাদের কাছ থেকে সে গান ও কবিতা রচনা শিখতে শুরু করে।
কিংবদন্তি অনুসারে, দেবী কালী স্বপ্নে রঘুর কাছে এসে তাকে মূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং পূজার নির্দেশ দেন। এই ঘটনাটি তাকে সাধারণ ডাকাত থেকে একজন ভক্ত হিসেবে মানুষের মনে গভীরভাবে স্থান করে দেয়।
প্রায় দুই শতাব্দী পরে, ১৯৬৭ সালে, ‘হাম দো ডাকু’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায়। এই সিনেমায় রঘুর বংশধর অভাস কুমার গাঙ্গুলী, যিনি সবার কাছে কিশোর কুমার নামে পরিচিত, অভিনয় করেছিলেন। যদিও সঠিক সম্পর্ক জানা যায়নি, তবে মনে করা হয় কিশোর কুমার রঘুর প্রাচীনতম পরিচিত বংশধরদের একজন।
এই কাহিনী শুধু রঘুর ভক্তির গল্পই নয়, বরং মানবতার প্রতি তার পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হিসেবেও পরিচিত। এটি দেখায় যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মানুষও সঠিক দিশা পেলে ভালো হয়ে উঠতে পারে।
এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃত ভক্তি বা আস্থা হলো অন্যের কল্যাণে নিবেদিত হওয়া এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মানবিক মূল্যবোধকে রক্ষা করা।
রঘুকে ঘিরে অনেক গল্প, কিংবদন্তি এবং উপকথা প্রচলিত রয়েছে। এসব গল্পে বাস্তব ও কল্পনার এক অসাধারণ সংমিশ্রণ তাকে চিরকালীন চরিত্রে রূপান্তরিত করেছে।
লোককাহিনি, গান ও নাটকের মাধ্যমে রঘু ডাকাতের কাহিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে । তাঁর চরিত্রের রহস্যময়তা এবং গল্পের রোমাঞ্চকর বাঁক মানুষকে আকৃষ্ট করে এসেছে প্রতিবার । সাধারণ মানুষ অনেক সময় তাঁর ডাকাতি দেখত সামাজিক প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে, যা তাঁকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।
সবশেষে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, রঘু ডাকাত কেবল একটি নাম নয়, বরং একজন ব্যক্তি যিনি ভয়াবহতা, ভক্তি এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেকে ইতিহাসের একটি অমূল্য অংশ করে তুলেছেন। তার জীবনের গল্প সাধারণ মানুষের জন্য এক চিরন্তন শিক্ষার উৎস।