পুরী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, Travel experience in Puri in Bangla

পুরী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

বর্তমানের ব্যস্ত জীবনযাপনের সাথে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে মন চায় কোথাও ঘুরে আসার জন্য। প্রকৃতির কোলে কয়েকটা দিন থেকে আসার জন্য হঠাৎ মন যেন আনচান করতে শুরু করে।

দীর্ঘ দিন ধরে একঘেয়ে কাজ করে যেতে কারোরই ভালো লাগে না। তাই ভ্রমণে কোথাও ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে হয়। তবে সব সময় যে দূরে কোথাও যেতে হবে তেমনটা জরুরী নয়

। আমাদের কাছাকাছিও এমন বহু জায়গা থাকে যেখানে ঘুরতে গিয়েও আনন্দ লাভ করা যায়। এমনই এক ভ্রমণে আমি আমার পরিবারের সাথে গিয়েছিলাম।

যাত্রাপথের শুরু, Start of the journey :

আমার মতো আমার পরিবারের সবাই ঘুরতে ভালবাসে। তাই আমি কখনো ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবতে গেলে বন্ধুদের সাথে প্ল্যান করতে হয় না। পরিবারের সবাই মিলেই ঘুরে আসতে পারি।

গত সেপ্টেম্বরে মা-বাবা হঠাৎ একদিন বললেন কোথাও ঘুরতে যেতে মন চাইছে, এদিকে আমিও কাজের থেকে কয়েকটা দিনের ছুটি কাটানোর কথা ভাবছিলাম। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয় গেলো পুরী যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে। সঙ্গে সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার বিভিন্ন প্রস্তুতি শুরু নেওয়া হল।

সব জিনিস গুছানো হয়েগেলো ২দিনের মধ্যেই। সেপ্টেম্বরে গরমের দাপট কিছুটা কম ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা বেরিয়ে পড়লাম পুরীর উদ্দেশ্যে। প্রথমে কলকাতা পৌঁছে সেখান থেকে রাতের একটি ট্রেনে করে পরদিন সকালে পুরী পৌঁছলাম।

ট্রেনে করে যাত্রা

ট্রেন থেকে নেমে অটো করে পুরী বিচের কাছাকাছি একটি হোটেলে উঠলাম। হোটেলের দোতালায় আমাদের ঘর, সেখান থেকেই শুনতে পেলাম সমুদ্রের ঢেউ এর গর্জন। মনে হল সমুদ্র যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।

পুরীতে প্রথম সমুদ্র দর্শন, A view of sea for the first time in Puri :

হোটেলের রুমে এসে দেখলাম প্রায় 9.30 বাজে, ভাবলাম কিছু খাওয়া দাওয়া করে সমুদ্রের ধারে গিয়ে আসবো। কথা মত কাজও হল, হোটেলেই খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। হালকা কিছু ব্রেকফাস্ট করে আমরা এগিয়ে গেলাম সমুদ্র সৈকতের দিকে।

হোটেলের ঠিক উল্টো পাশে ছিল সৈকতে যাওয়ার রাস্তা। বালুর উপর হেঁটে চলে গেলাম সমুদ্রের জলের ধারে।
চারিদিকে চেয়ে দেখলাম সমুদ্র তীরে লোকের ছড়াছড়ি, কেউ বালিতে বসে আছে আবার কেউ ঢেউ এর জলে স্নান করছে, কেউ ঝিনুক খুঁজছে, অন্যদিকে কেউ কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত।

পুরী সমুদ্র সৈকত

রোদ ছিল কিন্তু রোদের তেজ তখনও তেমন বেশি নয়। এদিকে ঢেউ এর উপর রোদের আলো পড়ায় ঢেউগুলো যেন ঝিলিক দিচ্ছে। সামনের দিকে চাইতেই চোখে পড়ল অন্তহীন নীলের বিস্তার। দূর থেকে সাদা ফেনা বুকে নিয়ে ছুটে আসছে টেউ। একের পর এক ঢেউ আমাদের পায়ে আছড়ে পড়ছিল। ওহ! সে কি দৃশ্য।

সমুদ্রের ঢেউ দেখে যেন অনেকটা সময় এমনিতেই কাটিয়ে নেওয়া যায়। কিছু ছবি তুললাম সবাই মিলে। মুহূর্তগুলো স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখার জন্য ক্যামেরাবন্দি হওয়াও জরুরী।

এরপর আমি আর আমার বোন মিলে বালুর উপর নিজের নাম লিখলাম, ঢেউ এসে তা ধুয়ে নিয়ে গেল, আমরাও ঢেউ এর সাথে খেলা করতে শুরু করলাম। ঢেউ আসলে দৌঁড়ে পিছে চলে যাচ্ছি, আবার ঢেউ ফিরে যাওয়ার সময় আমরাও ঢেউ এর পিছু নিচ্ছি।

এভাবে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে ফিরে আসলাম সবাই। আমাদের রুমের বাইরে একটা ঝুল-বারান্দা ছিল, স্নান সেরে এসে সেখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছি, যতদূর দেখা যায় শুধু জল আর জল, আবার দূরে আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি নৌকা। বুঝতে পারলাম এগুলো জেলেদের নৌকা। সাহসিকতার সাথে সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝেও জেলেরা রোজ নৌকা নিয়ে ভেসে যায়। দিনরাত এক করে তারা ভাসছে অজানা নিয়তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে।

জগন্নাথ মন্দির দর্শন, Jagannath temple visit :

দুপুরের খাবার খাওয়া হয়ে গেলে একটি সময় বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে চলে গেলাম জগন্নাথ মন্দিরে। মন্দিরের বাইরে থেকে দেখলাম মন্দিরের চূড়ায় লাল সূর্য অস্ত যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। সে কি অপূর্ব দৃশ্য, বলে বোঝানো দায়।

পুরীর জগন্নাথ মন্দির

এর পাশাপাশি মন্দিরের চূড়াতে পতাকা উত্তোলন দেখলাম আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কিভাবে এত খাড়া চূড়ায় ছোট একটি ছেলে মন্দিরের গা বেয়ে উঠে পতাকা টাঙিয়ে দিল, তা ভাবাই যায় না।

জগন্নাথ মন্দির থেকে দর্শন করে ফেরার পথে মার্কেট ঘুরে নিলাম। মার্কেট থেকে হেঁটে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। কেনাকাটার জিনিসপত্র সব রুমে রেখে এসে আবারো গেলাম সমুদ্র তীরে।

সেখানে অনেকগুলো দোকান বসেছে। জানতে পারলাম রোজ সন্ধ্যায় এই দোকানগুলো সাজানো হয়। ঝিনুকের তৈরি জিনিস থেকে শুরু করে সমুদ্রের মাছ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার পাওয়া যাচ্ছে এখানে। এসবকিছু উপভোগ করলাম সবাই মিলে। রাতের গহন অন্ধকারেও সমুদ্রের রূপ ছিল রহস্যময়, আবার দিনে তেমনই আনন্দ-উচ্ছ্বল।

সমুদ্রের তীরে সূর্যোদয় এর দৃশ্য, Sunrise view on the beach :

সমুদ্র সৈকত ও সূর্যাস্ত

পুরীর সমুদ্রের তীরে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের দৃশ্য নিয়ে একটা কথা বলতেই হয় সমুদ্রের তীরে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের আকাশ মন ভরিয়ে দেয়। আমি যাত্রা শুরুর আগেই মনে স্থির করে রেখেছিলাম হয়ে আর কিছু না হলেও এই দুটো অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে যাব।

তাই পুরীতে দ্বিতীয় দিন খুব ভোরে ওঠে বাবার সাথে চলে গেলাম সমুদ্রতীরে। সূর্যোদয় দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। ভাবিনি এত ভিড়েও কেউ থাকবে তখন সমুদ্র তীরে। কিন্তু গিয়ে দেখি অনেক মানুষ হাঁটছে বালুচরে। কিছু কিছু মানুষ থলি নিয়ে ঝিনুক কুড়োচ্ছে। আবার কেউ কেউ এমনি বসে আছে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখলাম আকাশ লালচে হয়ে উঠেছে, মেঘগুলোও যেন এই রং মেখে নিয়েছে নিজের গায়ে। মেঘের আড়ালে দেখা পেলাম সূর্য দেবের। সূর্যের আলো ঢেউয়ের উপর পড়তেই জলেও লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ল। মন টা খুশি হয়ে উঠল আমার। কিছু ছবি তুলে নিলাম। এরপর ফিরে এলাম ঘরে।

পুরীর কিছু দর্শনীয় স্থান, Places to visit in Puri :

পুরী ঘুরতে গেলে কাছেই আরো কিছু দর্শনীয় স্থান আছে যা ঘুরে আসা যায়। তাই হোটেল মালিকের সাথে কথা বলে রাতেই একটা গাড়ি ঠিক করে নিলাম।

কোণার্ক মন্দির

সকালে ওঠে তৈরি হয়ে নিয়ে পুরী থেকে আমরা কোনার্ক, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, চিলকা, লিঙ্গরাজ মন্দির, নন্দনকানন প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গেলাম। নানারকম কেনাকাটাও করেছি। কোনার্কের সূর্য মন্দিরের স্থাপত্য ও কারুকার্য আমাদের সকলকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল।

এসবের পাশাপাশি চন্দ্রবাঘা বিচেও গেলাম। কোনার্ক সূর্য মন্দির থেকে এই সমুদ্র সৈকত ৩ কিমি দূরে অবস্থিত। এখানে চন্দ্রভাগা নদী বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হওয়ার কারণে এই নামটি এসেছে।

এই বিচে অভিজ্ঞতা পেলাম সমুদ্রতীরের সূর্যাস্তের। আবারো চারদিক লালচে আভা ভরিয়ে দিয়ে সূর্য বাড়ি ফেরার পথে অগ্রসর হল। লাল সূর্যের অস্ত যাওয়ার পূর্বের শেষ প্রতিচ্ছবি জলের উপর দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব সেই দৃশ্য দেখে মনটা ভরে উঠলো।

শেষ কথা, Conclusion :

পুরী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে শেষে আমার একটা কথাই বলার আছে যে পুরী ভ্রমণই আমাকে প্রথম সমুদ্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। তাই এই ভ্রমণের মুহূর্তগুলো সারা জীবন আমার মনে থাকবে। তবে আমি মনে মনে ঠিক করেছি যে, সুযোগ পেলে আবারও সমুদ্রের টানে পুরী যাব।

RIma Sinha

Rima Sinha is working as a writer and also as a journalist. she got her bachelor of arts degree from Tripura University. She has also completed Master of Arts in Journalism and mass communication from Chandigarh University.

Recent Posts