আমাদের জীবনে রোজই কোনো না কোনো ঘটনা ঘটে যায়, কখনো বড় আবার কখনো ছোটো। কিছু ঘটনা এমন থাকে যার ঘটার সম্ভাবনা আগে থেকেই আমরা বুঝে নেই অথবা আমাদের পূর্বেই অনুমান হয়ে যায় যে এমন কিছু ঘটতে পারে। কিছু ঘটনা আমাদের আনন্দ দেয় আবার কোনো কোনো ঘটনা আমাদের মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে সময়ের সাথে সাথে আমাদের মন থেকে এগুলো মুছে যায়। তবে আকস্মিক কিছু ঘটলে বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই আমাদের মনে স্মৃতি তৈরি করে রাখে। আজ এমনই একটি ঘটনার কথা বলবো।
ঘটনার দিনের শুরু, The day when the incident happened
আমার বয়স তখন অনেক কম, আমি মাত্র ক্লাস ৪ এ পড়ি। সকালে উঠে স্কুলে গিয়েছিলাম। সময় মত ফিরেও এসেছিলাম বাড়িতে। অন্য স্বাভাবিক দিনের মতোই শুরু হয়েছিল সেই দিনটা। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর দৈনন্দিন কাজ গুলো করে নিলাম। দুপুর হলে মা ও দিদার সাথে বসে আমার শিশুকালের গল্প শুনছিলাম। সময়টা ছিল চৈত্র মাস।
গরমের সময়, রোদও কড়া। আমাদের বাড়ি কিছুদিন আগে মাত্র পাকা করা হয়েছিল, তাই সিলিং ফ্যানও নতুন লাগানো হয়। ঘরের ভেতরে বসে ফ্যানের বাতাসে গরম ততটা গায়ে লাগছিল না। দিদা তখন বলছিলেন যে আগেকার সময়ে এমন চৈত্রের দুপুরের রোদ মাটি থেকে যেন সব জল টেনে নিত, যখন তাদের জমি ছিল, ফসল উৎপাদনে এসময় খুব সমস্যা সৃষ্টি হত।
বড় ভূমিকম্প হলে যেমন মাটিতে ফাটল দেখা দেয় ঠিক তেমন ফাটল দেখা যেত ফসলের মাঠে। তখন ভাবতে পারিনি যে ভূমিকম্পের উচ্চারণ হতে হতেই এর সত্যিকারের অনুভূতিও পেয়ে যাবো।
হঠাৎ করেই শুরু হয় ভূমিকম্প, The earthquake started suddenly
আমি কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে মনে সেই পরিস্থিতির ছবি পরিকল্পনা করছিলাম, এমন সময় হঠাৎ করে বিছানা নড়তে লাগলো, আমি তো প্রথম ভেবেছি মা বা দিদার মধ্যে মধ্যে কেউ পা নাড়াচ্ছে কিন্তু তৎক্ষণাৎ তাদের পায়ের দিয়ে লক্ষ্য করে দেখি এমন কিছুই না। তারা দুজন ধড়মড়িয়ে উঠলো বিছানা থেকে, সাথে আমাকেও টেনে নামালো।
আমি তো সেই মুহূর্তে একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনা। বাড়ির সবাই ঘরে বাইরের দিকে ছুট দিল। আমি বের হতে হতে দেখলাম ঘরের প্রায় সব জিনিসই কাঁপছে, আলমারির উপর থেকে কিছু জিনিস তো নিচে পড়েই গেলো, আমি ফিরে সেগুলো তুলতে যাচ্ছিলাম ওমনি মা বললেন সেটা পরে তোলা যাবে এখন বাইরে যাওয়া জরুরী।
আমি এর আগে ভূমিকম্প সম্পর্কে বই তে পড়েছিলাম। আমার মনে আছে স্কুলে একবার ভূমিকম্প নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগে কি কি করণীয় তা নিয়ে একটি কর্মশালা আয়োজিত হয়েছিল, কিন্তু প্রত্যক্ষ এই অভিজ্ঞতা হওয়ার সময় সেটা এতটাই হঠাৎ করে হয়েছিল যে আমি কি করবো কি না তাই বুঝতে পারছিলাম না।
আশে পাশের বাড়িতে উলু ধ্বনি দিচ্ছে, আবার কেউ ঘণ্টা বাজাচ্ছেন আবার কেউ শঙ্খ বাজাচ্ছেন। আমি জীবনে প্রথমবার ভূমিকম্প অনুভব করলাম সেদিন। প্রায় ৪-৫ মিনিট ধরে এই ভূকম্পন বজায় ছিল। চারদিক শান্ত হলে পর সকলে বাইরে দাঁড়িয়ে এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। বাবা বললেন বেশ কয়েক বছরের মধ্যে এমন অভিজ্ঞতা তাদের হয় নি। আমি আর কি বলবো, আমার তো এটাই ছিল প্রথম অভিজ্ঞতা।
ভূমিকম্পের পর ঘরের অবস্থা, The condition of the house after the earthquake
ভূমিকম্পের আলোচনা শেষে সকলে ঘরে ঢুকলাম। দেখি বেশ কিছু জিনিস নিচে মেঝেতে পড়ে রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত একটি বাল্ব কম্পনের কারণে খুলে নিচে পড়ে ভেঙে রয়েছে। টুকরোগুলো যেন কারো পায়ে না গেঁথে যায় তাই মা তাড়াতাড়ি করে সেগুলো পরিষ্কার করলেন। বাবা স্থানীয় খবরের চ্যানেল টিভি তে চালিয়ে দিলেন।
খবরে ভূমিকম্প নিয়ে কথা বলছিল, যেখানে প্রকাশ করা হয় যে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৩। আমি কৌতূহলী হয়ে সারা ঘর ভালোভাবে দেখতে শুরু করি, কোথাও কোনো ফাটল ধরেছে কি না তাই খুঁজছিলাম। হঠাৎ দেখলাম রান্নাঘরের জানালার নিচের অংশে একটা ফাটল দেখা দিয়েছে।
এটা দেখে আমার কৌতুহল আরো বেড়ে যায়। এবার আমি উঠোনের চারদিক খুঁজতে শুরু করলাম, কিন্তু সেখানে কিছুই পেলাম না। রান্নাঘরের সেই জানালার কাছে গিয়ে দেখি ঠিক জানালার নিচের দেওয়াল যেখানে মাটিতে মেশে সেখানে হালকা একটি ফাটল। আমি মনে মনে সাত পাঁচ ভাবতে শুরু করলাম। বই তে ছবি দেখেছি ইমারত ভেঙে পড়ে যায় ভূমিকম্পে, যদি আজ আমাদের বাড়িতেই এমন হয় ! না জানি কি হতো তবে !
যাই হোক, ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে একথা সবাইকে বললাম, তারাও এসে দেখলো এবং মেরামতের ব্যাপারে আলোচনা করলেন। বিকেল হলে পর আমি বাবার সাথে আশেপাশের এলাকা পরিদর্শনে গেলাম। দেখার জন্য মন খুব উৎসুক হচ্ছিল যে চারদিকে কোথায় কি হয়েছে ভূমিকম্পের কারণে। দেখলাম ১-২ টা পুরোনো গাছ পড়ে গেছে মাটিতে।
তাছাড়া প্রতিবেশীদের একজনের বাড়িতেও আমাদের মত ফাটল দেখা দিয়েছে। তাদের সাথে আমাদের তফাৎ এটাই ছিল যে আমাদের দেওয়ালে ফাটল ছিল আর তাদের ঘরের মেঝেতে। বাইরের যাদের সাথেই কথা বললাম দেখলাম সবাই ভয় পেয়েছে এই ভূমিকম্পের কারণে।
ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা, Earthquake experience
ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটি স্মরণীয় ঘটনা ছিল। আমার সেদিন আনন্দও হয়েছিল, ভয়ও অনুভব হয়েছিল। ভয়ের কারণ হয়তো খুব স্বাভাবিক, সেটা এমন ভয়ংকর ভুকম্পে সকলেরই হতে পারে।
তবে আনন্দ এজন্য হচ্ছিল কারণ আমার ভূমিকম্প নিয়ে আগেই পড়া হয়ে গিয়েছিল, তবে এভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পেয়ে যাবো সেটা হয়তো কখনো ভাবি নি। আমার জীবনের এই ঘটনা সর্বদাই মনে রাখার মত, এমনকি আমার তো মনে হয় যেন আমি চাইলেও কোনোদিন এটা ভুলতে পারবো না।
তবে আশা করেছিলাম যে পরবর্তী সময় ভূমিকম্প হয়ে সেবারের মত হতভম্ব বোধ করবো না। এমন সময় কি করতে হয় কি না তা অনুসারে প্রতিক্রিয়া দেব; যেমন : ভূমিকম্পের সময় ঘরের ভেতর না থেকে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়াতে হয়, ইত্যাদি। তবে এরপর থেকে এখন অবধি বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, কখনো হালকা কম্পন আবার কখনো একটু জোরদার। তবে আর সেদিনের মত আতঙ্কিত বা অবাক হই নি।
শেষ কথা, Conclusion
ছোটবেলায় পাঠ্য বইয়ে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা কবিতা ‘ হঠাৎ যদি ‘ কবিতা হয়তো সকলেই পড়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে,”আমায় যদি হঠাৎ কোনো ছলে
কেউ ক’রে দেয় আজকে রাতের রাজা,
করি গোটাকয়েক আইন জারি
দু’এক জনায় খুব কষে দিই সাজা।”
ঠিক এমনই হঠাৎ কোনো ছলে যেন ভূমিকম্প এসে আমায় এক নতুন অভিজ্ঞতা দিয়ে গেল। এমন ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটে যায়, যা ভুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।