সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অন্যতম প্রধান উপকরণ হল মেলা। বিনোদনহীন ব্যস্ত তথা নিরানন্দপূর্ণ একঘেয়ে জীবনে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে মেলা। একটি জাঁকজমকপূর্ণ মেলার প্রতীক্ষায় হাজার মানুষ প্রহর গোণে। জাত-ধর্ম-বর্ণ একাকার হয়ে মুখরিত হয় প্রতিটি মেলা প্রাঙ্গণ। মানুষের সাথে মানুষের তথা শিল্পের সাথে শিল্পীর এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি হয় মেলায়। বলতে গেলে যেন মানুষের মেলা আর মেলার মানুষ একসূত্রে বাঁধা পড়ে মেলা প্রাঙ্গণে।
তেমনই একটি মেলার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার জীবনে। আমাদের ত্রিপুরার হাপানিয়া আন্তর্জাতিক মেলা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাজ্যভিত্তিক বইমেলা, যা ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়। আজ আমার দেখা এই মেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরবো।
আমাদের সমাজে মেলার উৎপত্তির ইতিহাস, History of origin of fair in our society
মেলার শুরু ঠিক কবে এবং কিভাবে হয়েছিল সে সম্পর্কে কোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস নেই। তাই মেলার জন্মকথা সম্পর্কে সঠিকভাবে কোনো ধারণা দেয়া হয়তো সম্ভব নয়। আমিও কখনো নিজের অভিভাবকদেরকে জিজ্ঞাসা করে এর উত্তর পাইনি। তবে একটা কথা বলা যায় যে যখন থেকে ব্যবসা- বাণিজ্যের শুরু হয়েছে, তখন থেকে শুরু হয়েছে মেলার।
আজকাল নানা উপলক্ষে মেলা বসে। বিভিন্ন অঞ্চলে আবহাওয়া তথা পার্বণভেদে বিভিন্ন জনপদে মেলার বৈচিত্র্য দেখা যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার শান্তিনিকেতনের মেলায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন “এই মেলার উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়- হৃদয় খুলে দান করবার ও গ্রহণ করবার এই মেলাই হলো প্রধান উৎস ও উপলক্ষ।” সত্যিই তো, ভেবে দেখলে বোঝা যায় মেলায় সকল সংকীর্ণতা যেন মুছে যায়।
প্রাচীন ইতিহাসে মেলার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। মুঘল আমলেও নানা উপলক্ষকে কেন্দ্ৰ করে প্রায়ই মেলা বসতো। ‘আইন-ই-আকবরী’তে উল্লেখ রয়েছে যে, মেলা এলেই চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। তখন মানুষের মন হয়ে উঠত আনন্দমুখর। একসময় গ্রামাঞ্চলের মেলার চল ছিল বেশি। তখন মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কবিগান, পালাগান, যাত্রা, বয়স্কদের আসর ইত্যাদি।
আমার দেখা বইমেলা, My visit to a book fair
শুনেছি অতীতের সময়কালে নাকি প্রধানত শীতকালেই বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা হতো। কালক্রমে তা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ঋতু উৎসব, লোকজ সংস্কৃতি, পালা-পার্বণ ইত্যাদি রূপে বিস্তৃতি পায়। সময়ের সাথে সাথে দিনে বছরের বিভিন্ন পার্বণ ভেদে বৈশাখী মেলা, কার্তিকের মেলা, রথের মেলা, পৌষ সংক্রান্তির মেলা, দরগার মেলা, জগন্নাথ মেলা, রাস পূর্নিমার মেলা, মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে মেলা, গঙ্গাস্নানের মেলা ইত্যাদির চল শুরু হয়, যা মূলত গ্রামবাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল।
কিন্তু কালক্রমে তা গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে আধুনিক সমাজের ব্যস্ত জীবনের কর্মকোলাহলের মাঝেও ঠাঁই করে নিয়েছে। তবে বহুকাল ধরে একটি মেলা প্রতি বছরই প্রায় সকল জনপদের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, সেটি হল বইমেলা।
অন্য সকল মেলার থেকে বইমেলা আমার সবচেয়ে প্রিয়। এর কারণ হল বইমেলায় গিয়ে বহু জানা অজানা জ্ঞান লাভ করা যায়, আমাদের স্কুলের পাঠ্য বইয়েও এতকিছু থাকে না। বইমেলায় কোন বই না পাওয়া যায়! সাধারণ জ্ঞানের বই থেকে শুরু করে রান্নার বই সহ বহু বিদেশি লেখকের বইও পাওয়া যায়। এর ফলে আমরা এমন অনেক বিষয়েও জানতে পারি যার সম্পর্কে আমরা কখনো কারো কাছে শুনিনি।
বইমেলার পরিবেশ সম্পর্কিত কিছু উল্লেখোগ্য বিষয়, The environment of the book fair
বইমেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার পর প্রথমেই আমার চোখে পড়ে মেলার চোখ ঝলসানো তোরণদ্বার এবং আলোকসজ্জা। খুব আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়েছে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলার তোরণদ্বার বইয়ের বিচিত্র প্রচ্ছদ দিয়ে সাজানো হয়েছে। মেলার ভেতরের অংশে একটু জায়গা পরে পরেই দেশ-বিদেশের বিখ্যাত ব্যাক্তিদের বাণী দিয়ে ব্যানার সাজানো হয়েছে- সে যেন এক অপূর্ব দৃশ্য। যে দিকেই তাকাচ্ছিলাম, মন আমার আনন্দে ভরে উঠছিল।
আমি গিয়েছিলাম আমার বাবার সাথে, সেখানে গিয়ে অনেক বন্ধু বান্ধবের সাথে দেখা হয়, তারাও তাদের মা বাবার সাথে এসেছে। দেখলাম অন্য বন্ধুরাও আমার মত বই দেখছে, বই কিনেছে।
মেলার বিশেষ আকর্ষণ কি ছিল, Special attractions of the book fair
সাধারণত মেলার জন্য বহুদিন থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়, প্রায় সব মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, এই বইমেলাতেও সেরকম আয়োজন ছিল। অন্য সব মেলায় দোকানে সাজানো বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীই হয় মেলার অন্যতম আকর্ষণ। তবে আমার দেখা বই মেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল বিভিন্ন রাজ্য তথা ভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রকাশনী সংস্থাগুলো। বিদেশি লেখকেদের বহু মজার গল্পের বই ছিল মেলার একটি দোকানে, আমি সেখানে গিয়ে চার পাঁচটি বই নেড়েচেড়ে দেখলাম, কোনোটা ছিল গোয়েন্দা গল্প, আবার কোনোটা ভূতের গল্প, অন্যদিকে কিছু ছিল হাস্যরসে পরিপূর্ণ।
আমার গোয়েন্দা গল্প পড়তে খুব ভালো লাগে, তাই আমি শার্লক হোমস এর একটি বই কিনলাম, যা ছিল বেশ কিছু মজার গল্পে ভরা। বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে আমি যেন নিজেকে জ্ঞানের সাগরে হরিয়ে ফেলেছিলাম। সেদিন বইমেলায় গিয়ে দেখলাম কত জ্ঞানীগুনী, মনীষী নীরব ভাষায় এখানে কথা বলছে, বইয়ের পাতা উল্টে আমি তাদের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলাম। ছোট-বড় প্রায় দুইশত বইয়ের দোকান ছিল মেলায়।
থরে থরে সাজিয়ে রাখা আছে নানা রঙের মলাটে মোড়া, নানা লেখকের, নানা ধরনের বই। দেখে মনে হয় এ যেন বইয়ের মিছিল। বইগুলোতে আছে পৃথিবীর সকল জ্ঞানের কথা; আছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা, আরো আছে সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসার কথাও, সাথে আছে ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ধর্মের কথা; আছে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির থেকে ধ্বংসের কথা।
এক কথায় বিচিত্র এক জ্ঞানের সমাবেশ ছিল এই বইমেলা। মনে হয়েছিল যেন এমন একটি মেলা না দেখলে আমার জীবনটাই অপূর্ণ থেকে যেত৷
মেলার আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্য, Information about the organization organizing the fair
বইমেলার আয়োজন করেছে রাজ্য সরকার। প্রতি বছরই মহসমারোহ সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এই মেলার আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের খ্যাতনামা পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতাগণ এতে অংশগ্রহণ করে থাকে, বিদেশ থেকেও বেশ কিছু প্রকাশকরা আসেন এখানে। মূলত দেশ-বিদেশের বিখ্যাত লেখক ও মনীষীদের রচিত পুস্তকের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটানোর জন্যই এ মেলার আয়োজন করা হয়।
বইমেলার উপকারিতা সম্পর্কে কিছু কথা, A few words about the benefits of book fair
বইমেলায় গিয়ে যা মনে হয়েছে যেন সারা বিশ্বের মানুষের দরবারে উপস্থিত হয়ে আমি নিজের দেশের অবস্থান যাচাই করতে সমর্থ হয়েছি। সকল শ্রেণির মানুষই বইমেলায় এসে উপকৃত হতে পারেন, একথা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-বৃদ্ধ সবারই রুচিসম্মত বইয়ের সমাবেশ পাওয়া যাবে এখানে।
সর্বশ্রেণির পাঠক এখানে এসে নিজের প্রয়োজন মতো বই কিনতে পারে। বইপ্রেমী মানুষজন বইয়ের বিপুল সমারোহ দেখে আনন্দ পেতে পারে। বিভিন্ন লেখন এবং বইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে আমার আত্মতৃপ্তি লাভ হয়েছে। বইমেলায় বই ছাড়াও সেখানে আয়োজন করা হয়েছিল নাট্যাভিনয়, গান-বাজনা, ইত্যাদির। তাছাড়া বহু বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ নানা বিষয়ে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।
উপসংহার, Conclusion
আমার দেখা বইমেলার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। অনেক কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছি এখানে এসে। বহু লেখকের নাম জানতে পেরেছি। প্রতিবছর আমি বইমেলায় গিয়ে নতুন নতুন লেখকদের বই কিনে পড়বো বলে ভেবে নিয়েছি, কারণ এই মেলা হল এমন একটা সুযোগ যেখানে আমি ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য থেকে শুরু করে অতি সাধারণ বিষয় নিয়েও বহু তথ্য নতুনভাবে জানতে পারি।