সমুদ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা, A visit to a sea side- essay in Bengali 

সমুদ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

সমুদ্রের প্রতি আমার তেমন আকর্ষন ছিল না কোনো সময়। মূলত পাহাড়ের প্রতি আমার আকর্ষণ, কিন্তু তাই বলে সমুদ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করবো না! সেটা কি করে হয়। ভ্রমণ আমার খুব প্রিয় বিষয়, বিশেষ করে কোনো নতুন অভিজ্ঞতা পেতে এবং ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা আমার মনে উৎফুল্লতা জাগিয়ে তুলে। তাই এবার পরিবার সমেত সমুদ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ভ্রমণ পরিকল্পনা, Travel plans

বাড়িতে যখন সমুদ্র ভ্রমণের কথা আলোচনা করা হচ্ছিল তখন বাবা উল্লেখ করলেন পুরী যাওয়ার কথা। আমাদের বাড়ি ত্রিপুরায়, সেখান থেকে পুরী যাওয়া তেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার না, তাই সকলেই সম্মতি দিল। স্থির হল আমি, মা, বোন ও বাবা মিলে পুরীর সমুদ্র সৈকতে গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে আসবো। কিন্তু চিন্তার বিষয় এই যে সারাদিন সমুদ্রের ধারে কি করব ! তখন বাবা বললেন যে পুরীর আশেপাশে যে দর্শনীয় স্থানগুলো আছে তা দেখা যাবে। বই তে পুরী সম্পর্কে বহু গল্প পড়েছিলাম, এবার প্রত্যক্ষ দর্শন করার পালা। মন বেশ উৎসুক ছিল এই নতুন অভিজ্ঞতা পেতে।

পুরী কোথায় অবস্থিত? Where is Puri situated 

পুরী সমুদ্র সৈকতটি ভারতের ওড়িশা রাজ্যের পুরী শহরে অবস্থিত। এখানে পৌঁছানোর জন্য ট্রেন, গাড়ি উভয় সুবিধাই রয়েছে। এই সমুদ্র সৈকতটি বঙ্গোপসাগরের তীরে, উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বর থেকে ৬০ কিমি দূরে অবস্থিত। প্রাচীনকালে পুরী শ্রীক্ষেত্র এবং নীলাচল নামেও পরিচিত ছিল। এই শহরে বেশ কিছু হিন্দু মন্দির ও মঠ আছে, এছাড়া এখানকার মূল আকর্ষণ হল জগন্নাথ মন্দির।

পুরী কোথায় অবস্থিত

ভ্রমণের যাত্রা শুরু, The journey begins

ত্রিপুরা থেকে ভুবনেশ্বর যাওয়ার জন্য বিমান পরিষেবা চালু আছে, তাই আমরা সেই পথটুকু বিমানে যাত্রা করলাম। তারপর ট্রেনে করে পৌঁছে গেলাম পুরী স্টেশনে। সেখান থেকে অটো ধরে চললাম স্বর্গদ্বারের দিকে।

গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই দেখতে পেলাম সমুদ্রকে। হোটেল আগে থেকেই বুক করে রাখা ছিল, একদম সমুদ্রের সামনে অবস্থিত একটি হোটেল। স্বর্গদ্বারের পাশেই। যেতে যেতে সমুদ্রের গর্জন আর হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। হোটেলটির সামনে অনেক খাবারের দোকান, কাপড়ের দোকান আছে। একদম জমজমাট এলাকা।

ভ্রমণের যাত্রা শুরু

পাশেই শ্মশান, কিন্তু এ নিয়ে কারও মনে কোনো ভয় নেই, কোনো ভ্রুকুটি নেই। দিব্যি সবাই ঘুরছে ফিরছে আনন্দ করছে। এসব দেখে বেশ ভালই লাগলো। আমাদের পৌঁছতে রাত ৮ টার বেশি হয়, তাই সেদিন আর না বেরিয়ে হোটেলে বিশ্রাম নিলাম। হোটেলেই খাবারের ব্যবস্থা ছিল, তাই আর বাইরে যেতে হয়নি। সেদিন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম, সকালে উঠে প্রথম সূর্য দেখবো বলে।

পুরীর সমুদ্র সৈকতে প্রথম দিন, First day at Puri sea beach

পরদিন ভোরে উঠে পড়লাম, দেখলাম মা ও বোন এখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। তাদের ডাকলাম, কিন্তু তাদের উঠার ইচ্ছে নেই। তাই আমি আর বাবা মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রের তীরে যাবো বলে। তীরে যখন পৌঁছে গেছি তখন সূর্যোদয় হবে হবে ভাব। দেখল বেশ কিছু মানুষ হাঁটতে এসেছে এখানে। অন্যদিকে বেশ কিছু মানুষ বস্তা ভরে ঝিনুক কুড়োতে ব্যস্ত। সমুদ্রের ঢেউ ফিরে ফিরে এসে যেন তাদের ১টা ২ টা করে ঝিনুক দিয়ে যাচ্ছে। কি মজা লাগছিল এই দৃশ্যটা দেখতে।

পুরীর সমুদ্র সৈকতে প্রথম দিন

তারপর হঠাৎ করেই মেঘের চাদর সরিয়ে সূর্য উঁকি দিল। আকাশে এক লালচে ভাব। কি অপরূপ দৃশ্য। মন ভরে গেলো আমার। বাবাও এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ। সমুদ্রের তীরে এই সূর্যোদয় দেখা যেন এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা বলে মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম মা ও বোন এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য পায় নি, তাই কয়েকটা ছবি ও ভিডিও তুলে রাখলাম তাদের দেখাবো বলে। সেখানে কিছুসময় বসে থেকে ফিরে এলাম হোটেলে।

ফেরার পথে আমি আর বাবা চা বিস্কুট খেয়ে এলাম, সাথে মা ও বোনের জন্য নিয়েও এলাম। এসে দেখি ওরা সবে উঠেছে। আজ চন্দ্রভাগা সৈকত দেখার পরিকল্পনা ছিল। তাই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়তে হবে। চন্দ্রভাগা পুরী থেকে একটু দূরে অবস্থিত। তাই আমরা ভাবলাম দূরের জায়গাগুলো আগে দেখে নিয়ে তারপর কাছে যা আছে দেখবো।

চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকত, Chandrabhaga sea beach

স্থির করে রাখা সময় মতোই তৈরি হয়ে গিয়ে রওনা হলাম চেনা পথে অচেনাকে জানার জন্য। পথে উড়িষ্যার কোনার্ক সূর্য মন্দির দর্শন করলাম, যাকে অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য ইউনেস্কো বিশ্ব সভ্যতার একটি উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই স্থান সম্পর্কে বই তে পড়েছিলাম।

এয়োদশ শতকের সময়কালে পূর্ব-গঙ্গা রাজ্যের অধিপতি মহারাজ নরসিংহ দেব সূর্য দেবতার আরাধনা করার জন্য নাকি এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দিরটির অভিনব আকার, বিশালত্ব আর কারুকার্যের জন্য দেশব্যাপী প্রসিদ্ধ। মন্দিরটি ওড়িয়া ও দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে নির্মিত এবং এটি ধূসর বেলে পাথরে বিশাল একটি রথের আকারে গড়া হয়েছে। মন্দিরে একসময় সূর্যদেবতার এক বিশাল বিগ্রহ ছিল, কিন্তু তা এখন নেই।

চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকত

কালের করাল গ্রাসে এই স্থাপত্যের অনেকটাই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। ইতিহাস, স্থাপত্য শৈলি এবং সুপ্রাচীন কারিগরী কৌশলের জাদুদন্ডে এক লহমায় মুগ্ধ বিস্ময়ে মত্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর পথ ধরলাম চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকতের দিকে, সেখানে যেতে যেতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে আসল, সেখানে সমুদ্র তীরে বেশ মজা করে সূর্য ডুবু ডুবু ভাব করতেই ফেরার পথ ধরলাম।

চিল্কা হ্রদের মনোরম দৃশ্য, Beautiful view of Chilka Lake

পরদিন পরিকল্পনা অনুযায়ী চিল্কা হ্রদের উদ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়া। ভারতবর্ষের বৃহত্তম তথা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম উপহ্রদ এটি। বইতে এর কথাও পড়েছিলাম, কিন্তু নিজের চোখে এই সুবিশাল হ্রদের দর্শনের অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। এই হ্রদের মূল আকর্ষণ হল – রম্ভা আর বারকুল। আমরা একটা নৌকা ভাড়া নিয়ে রওনা দিলাম ‘কালিজয় দ্বীপ’-এর দিকে ।

চিল্কা হ্রদের মনোরম দৃশ্য

চিল্কায় একটা জায়গা আছে যেখানে গেলে ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়, তবে গেলে যে দেখতে পাওয়া যাবেই এমন কোনও কথা নেই। চিল্কার সাথে সমুদ্রের যোগাযোগ আছে এবং এর পরিসর সুবিশাল বলে এখানে ঢেউও দেখতে পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছলাম কালিজয় দ্বীপ-এ। এখানে একটা কালিজয় দেবীর মন্দির আছে। এই মন্দিরে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম। বলাই বাহুল্য জলপথে ভ্রমণটা খুবই মজার ছিল, নোনা জলে ভেসে প্রায় সারাটা দিন উপভোগ করলাম ।

জগন্নাথ মন্দির দর্শন, Jagannath temple visit

পরের দিনটা ছিল জগন্নাথ মন্দির দর্শনের জন্য স্থির করা। পুরী এসে জগন্নাথ দর্শন না করলে কি করে চলবে। শুনেছি পুরীর জগন্নাথ মন্দির নাকি নানারকম অলৌকিক রহস্যে ভরা৷ যেমন, মন্দিরের চূড়ার পতাকা বায়ুর উল্টো দিকে ওড়ে৷ মন্দিরের উপর কখনও কোনো পাখি বসতে দেখা যায় না।

মন্দিরের ওপর দিয়ে বিমান ও পাখি উড়ে যায় না৷ মন্দিরের রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে নাকি গঙ্গানদী প্রবাহমান, যা বাইরে থেকে কেউ দেখতে পায় না। এসমস্ত প্রচলিত কাহিনী এই মন্দিরটিকে যেন আরও অলৌকিক রূপ দান করে। সারাদিন প্রায় মন্দিরেই কেটে গেলো, পুজো করা, প্রসাদ খাওয়া, মন্দিরের প্রতিটি অংশ ঘুরে দেখা, সবকিছুর পির বেশ ক্লান্ত হয়ে গেলাম। পুরীর এই জগন্নাথ মন্দিরে সারাবছর ধরেই দেশে বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্তরা জগন্নাথ দর্শনের জন্য আসেন।

জগন্নাথ মন্দির দর্শন

ঐতিহাসিক এই মন্দিরটি ১০৭৮ সালে তৈরি হয়। ফিরে এসে আবার সবাই মিলে পুরীর সমুদ্র তীরে বসলাম, সমুদ্র সৈকতে গিয়ে বিশেষ করে মানুষের স্নান করা আর ছবি তোলার কাণ্ডকারখানা দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা হয়ে গেল, তখন বেশ কিছু দোকানদার সামুদ্রিক মাছগুলোর পকোড়া নিয়ে বসেছে, আমরা সবাই কিছু না কিছু খেয়ে নিলাম। বাজার বসেছিল, সেটাও ঘুরে নিলাম, তারপর চলে গেলাম হোটেল রুমে। পরদিন আবার ফিরে যাবো ত্রিপুরায়। মজার একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছি বাড়িতে।

শেষ কথা, Conclusion 

পুরীতে সমুদ্রের টানকে কোনো ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। রাতের গহন অন্ধকারেও সমুদ্রের রূপ ছিল রহস্যময়, আবার দিনে তেমনই আনন্দ-উচ্ছ্বল। সাহসিকতার সাথে সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝেও জেলেরা নৌকা নিয়ে ভেসে যায়। দিনরাত এক করে তারা ভাসছে অজানা নিয়তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে। তবে একটা কথা বলতেই হয় সমুদ্রের তীরে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের আকাশ মন ভরিয়ে দেয়।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts