পাহাড়, বনভূমি ও নদীর স্বাদ যদি কেউ একসাথে নিতে চায় তবে অবশ্যই একবার হলেও ঘাটশিলা যাওয়া উচিত। আমিও আমার পরিবারের সাথে পুজোর ছুটিতে ঘুরতে গিয়েছিলাম ঘাটশিলায়। আমার জীবনের সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ছিল এটি। খুব মজা করেছিলাম সবাই মিলে। কত কিছু দেখলাম সেখানে, সেই সময়টার কথা মনে পড়লেই খুব আনন্দ পাই।
ঘাটশিলা কোথায় অবস্থিত? Where is Ghatshila situated?
ঘাটশিলা ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার অন্তর্গত একটি শহর। ঘাটশিলার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে সুবর্ণরেখা নদী। কথিত আছে যে এই নদীর বালুতটে নাকি সোনা পাওয়া যায়, তাই হয়তো এই নদীর নাম দেওয়া হয়েছিল সুবর্ণরেখা। চারিদিকে উঁচু নীচু পাহাড়ের টিলা, এছাড়াও নদী, জঙ্গলে ঘেরা শান্ত পরিবেশ ঘাটশিলার প্রকৃতিকে মনোরম করে তোলে। সুবর্ণারেখা নদীর ঘাটে শত শত শিলা রয়েছে বলেই হয়তো বলে এই স্থানের নামকরণ করা হয়েছে ঘাটশিলা।
ঘাটশিলা ভ্রমণ যাত্রা, A trip to Ghatshila
ঘাটশিলা কলকাতা থেকে খুব বেশি দূরে নয়, মাত্র ২১৫ কিলোমিটার। হাওড়া থেকে জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ঘাটশিলা যাওয়ার সবথেকে দ্রুত ট্রেন, প্রথমে সবাই মিলে এই ট্রেনে যাওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল, কিন্তু সময় বেশি লাগবে বলে বিমানে যাওয়া স্থির হয়। কথামত, বিমানে রাঁচি পৌঁছে গেলাম, এখান থেকে ১৫৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ঘাটশিলা। রাঁচি বিমানবন্দর পৌঁছানোর পরে রেলপথে বা গাড়ি নিয়ে যাত্রা করা যায়।
রাঁচি বিমানবন্দর থেকে ঘাটশিলা পৌঁছতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় লাগে। তবে আমরা রেলপথে না গিয়ে বিমান বন্দর থেকেই গাড়ি ভাড়া করে চলে গেলাম গন্তব্যে। তবে নতুন কোনো জায়গায় যাওয়ার আগে সেই স্থান সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে রাখা ভালো, তাই আমিও এই পর্যটন স্থানের ব্যাপারে জানতে গিয়ে দেখলাম যে ঘাটশিলায় রয়েছে তামার খনি, তাছাড়া শহরটি ঝাড়খন্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। এখানে একটি রেলস্টেশন আছে যা দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের অন্তর্ভুক্ত।
তবে একটা ব্যাপার আমার কাছে সবচেয়ে মজার বিষয় বলে মনে হয়েছে, সেটা হল ঝাড়খন্ডে অবস্থিত হলেও ঘাটশিলার স্থানীয় অধিবাসীদের বৃহৎ অংশ বাংলা ভাষাভাষী। নিঃসন্দেহে এটি ঝাড়খণ্ডের একটি বিশিষ্ট পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত এবং বিপুল সংখ্যক বাঙালি পর্যটক আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্য এখানে আসেন।
ঘাটশিলার ভ্রমণ স্থানসমূহ, Places to visit at Ghatshila
ঘাটশিলা শহরটি মহান বাঙালি ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের জন্যও বিখ্যাত। তাঁর অন্যতম প্রধান উপন্যাস “পথের পাঁচালী”র ছবি মনে করিয়ে দেয় এই ঘাটশিলা।
এই শহরটিতে বিহারী, বাঙালি, গুজরাটি, মারোয়ারি, পাঞ্জাবি এবং অন্যান্যদের মতো বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং গোষ্ঠী একটি ধর্মনিরপেক্ষ সম্প্রীতির সাথে বাস করে, যা দেখে খুব ভালো লাগলো। এখানকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে ভারতীয় ইতিহাসের মধ্যযুগে ঘাটশিলা বাঙালি সম্প্রদায় দ্বারা শাসিত ছিল। আমাদের ৪ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা হয়েছিল। তাই আমরা ঘাটশিলার উত্তর- দক্ষিণ- পূর্ব – পশ্চিম চার দিকে চার দিন ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঘাটশিলা ভ্রমণে যে জায়গাগুলো দেখলাম :-
ফুলডুংরী টিলা:
ফুলডুংরী টিলা ঘাটশিলা থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে জাতীয় হাইওয়েতে অবস্থিত। সেখানে গিয়ে হালকা হাওয়া অনুভব করলাম, যা মনে স্নিগ্ধতা এনে দেয়। সেখান থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার মজাই আলাদা। পাহাড়ের গায়ে একটি সর্পিল পথ রয়েছে যার মধ্য দিয়ে যে কেউ ওই পাহাড়ের চূড়ায় যেতে পারে। পাহাড়টিতে প্রচুর পরিমাণে লম্বা সাল গাছ রয়েছে এবং সর্পিল পথটি লাল নুড়ি দ্বারা আবৃত যা প্রচুর পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।
ধারাগিরি ফলস:
পাহাড় দেখার পর চলে গেলাম ধারগিরি জলপ্রপাত দেখতে, যা ঘাটশিলা থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। ধারগিরি নামক পাহাড় থেকে ২১ ফুট নিচে নেমে আসে এই জলপ্রপাতটি, যার দৃশ্য মনমাতানো। এখানে একটি কালী মন্দিরও রয়েছে। অঞ্চলটি মূলত একটি বনাঞ্চল পাহাড়ী ধরণের। এখানে ট্রেকিং করার সুযোগ পেয়ে খুব মজা লাগছিল, পাথুরে পথ ধরে হাইকিং করে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চার আমার এক অনন্য উপলব্ধি।
বুরুডি লেক :
ঘাটশিলা ঘুরতে আসার আগে আমি অনেকের কাছে শুনেছি যে বুরুডি লেক নাকি এখানকার সেরা জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। ঘাটশিলা থেকে এই স্থানটি ৬ কিমি উত্তরে অবস্থিত। বুরুডি লেকের চারপাশে ছিল শাল পিয়ালের বন। এটি নাকি ব্রিটিশ শাসনে নির্মিত হয়েছিল। প্রতিবছর অক্টোবর মাসে হ্রদের তীরে ঘাটশিলায় পনের দিনের জন্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সৌভাগ্যবশত আমরা সেই মেলাও পেয়ে গেলাম। মেলার দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে কিছু কেনাকাটাও করলাম সবাই। এছাড়াও হ্রদে বোটিং করার সুযোগ রয়েছে। তাই সবাই মিলে কিছুক্ষণ বোটিং করলাম।
রঙ্কিনীদেবীর মন্দির:
ঘাটশিলার রঙ্কিনী কালী মন্দিরটি রাজ্য তথা বহি:রাজ্য ব্যাপী খ্যাত। কালিমাতার উপাসনা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল এই মন্দির, এখানে প্রতিষ্ঠিত কালি প্রতিমা “রঙ্কিনী মাতা” নামে পরিচিত। মন্দিরের পুরোহিত আমাদের জানান যে অতীত কাহিনী অনুসারে ঘাটশিলার এই মন্দিরে নাকি নরবলী করা হত।
স্থানীয় লোকদের মধ্যে এই রঙ্কিনী দেবী অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং তারা মা রঙ্কিনী দেবতার শক্তি এবং প্রভাবকে খুব বিশ্বাস করেন। মন্দিরে গিয়ে বহু পূণ্যার্থী দেখতে পেলাম, তবে তাদের মধ্যে স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি পর্যটকরাও ছিলেন। মন্দির দর্শন শেষে আমরা যাদুগোরা পাহাড়েও ভ্রমণ করতে গেলাম যা এই মন্দিরের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ছিল।
পঞ্চ পান্ডব পাহাড়:
ঘাটশিলা থেকে উত্তর-পূর্বে প্রায় পাঁচ কিমি দূরে একটি ছোট পাহাড় হল পঞ্চ পাণ্ডব। এটি মূলত একটি পাথরের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য, পাহাড়টির পাথর ক্ষয় হওয়ার কারণে পাঁচ জন পুরুষের মাথা হিসাবে স্থাপিত হয়ে রয়েছে, যা দেখে আমার গায়ে কেনো জানি কাটা দিয়ে উঠেছিল, কি অপূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। একেই বলে প্রকৃতির খেলা। স্থানীয় লোকজন একে পাণ্ডবের পাঁচ ভাইয়ের প্রাকৃতিক সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করেন।
চিত্রকুট পাহাড়ের শিব মন্দির:
ঘাটশিলার চিত্রকুট পাহাড়ের কথা আমি আগেও শুনেছি, সেখানে একটি শিব মন্দিরও রয়েছে। সেখানে গিয়ে শিব শংকরের দর্শন শেষে টিলা থেকে নীচের দিকে নজর দিলাম, দেখতে কি অসাধারণ লাগছিল, সেখান থেকে নামতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না আমার। মনে হয়েছিল প্রকৃতি যেন নিজের মাধুর্যের সবটা মেলে ধরেছে আমার সম্মুখে।
রাতমোহনা:
আমাদের হোটেলের বেশ কাছেই ছিল সুবর্ণরেখা নদীর তীর, সেখান থেকে একটি এগিয়ে গেলেই রাতমোহনা, যা ঘাটশিলার একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ। এখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা হয়তো আমি কোনো দিনও ভুলবো না। এই মুহূর্ত অনুভব করার জন্য আমরা সবাই একদিন খুব ভোরে উঠে এসেছিলাম এখানে সূর্যোদয় দেখবো বলে, আবার সেদিনই বিকেলবেলা হেঁটে হোটেল থেকে সেখানে গিয়েছিলাম সূর্যাস্ত দেখার উদ্দেশ্যে।
গালুডিহি ব্যারেজ:
ঘাটশিলার সূর্যাস্ত দেখার জন্য আরেকটি স্থানও রয়েছে, সেটা হল গালুডিহি ব্যারেজ। সূর্যাস্তের সময় এই ব্যারেজ দেখতে অপূর্ব লাগে। ব্যারেজের কাছেই রয়েছে আদিবাসীদের গ্রাম। আমরা ভ্রমণের তৃতীয় দিন সূর্যাস্তের আগে হেঁটে হেঁটে ভ্রমণ করলাম গ্রামটি, তারপর সন্ধ্যে হতেই ফিরে এলাম হোটেলে।
গৌরী কুঞ্জ:
সাহিত্য প্রেমীদের কাছে অতি প্রিয় একটি নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমিও বইয়ে লেখকের বহু গল্প পড়েছিলাম, কিন্তু তাঁর বাড়ি কখনো দেখতে পাবো সেটা কল্পনাও করিনি। এই গৌর কুঞ্জ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। লেখকের স্ত্রী’র নাম অনুসারে এই বাড়ির নামকরণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এটি একটি সংরক্ষণশালা, যেখানে গিয়ে লেখকের ব্যবহৃত বেশ কিছু সামগ্রী দেখতে পেলাম।
এসব ছাড়াও আরো বেশ কিছু জায়গায় ভ্রমণ করেছিলাম, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘাটশিলা ফলস, নারোয়া ফরেস্ট, হিন্দুস্তান কপার লিমিটেড, পূর্ণ পানি, মোসাবোনি খনি, যাদুগোড়া, সুরদা পাহাড়, মৌভান্ডার ইত্যাদি স্থান। ঘাটশিলায় বহু মানুষ আসে পাশের শহর থেকে পিকনিক করতে এসেছিল, বুঝতে পারলাম যে ঝাড়খণ্ডের স্থানীয় দর্শকদের কাছে এটি একটি পিকনিক স্পট হিসাবেও বিখ্যাত।
ঘাটশিলায় খাবার হোটেল, Hotels at Ghatshila
ঘাটশিলায় বেশ কিছু ভালো রেস্তোরাঁ রয়েছে, তাছাড়া এখানে নিরামিষ বা আমিষ দুই ধরণের খাদ্যের হোটেল আছে। আমরা ঘুরতে গিয়ে বুরুডি লেকের আশেপাশেও খাওয়া দাওয়া করেছিলাম, এখানকার খাওয়ার হোটেলে খাবারের দামও কম এবং ভাত ডাল মাছ মাংস ডিম নিরামিষ সব ধরনের খাবার পেয়েছিলাম।
শেষ কথা, To conclude
ঘাটশিলার মনোরম পরিবেশে ছুটির দিন কাটাতে খুব ভালো লেগেছিল আমার। সেখানকার পাহাড় নদীর একত্রিত সুন্দর প্রকৃতি মনে আনন্দ দেয়। তাছাড়া ঘাটশিলায় অনেক ভালো ভালো হোটেল রয়েছে, কম বেশি সব রেঞ্জের থাকার ব্যবস্থা আছে এখানে, তাই আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। ছিমছাম পরিষ্কার শান্ত পরিবেশে বেশ মজার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি আমরা সবাই