১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী হিসাবে পরিচিত ছিল মুর্শিদাবাদ, ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত একটি বিস্ময়কর জেলা এটি। জেলাটি নিজের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্থাপত্যের জাঁকজমক এবং ঐতিহাসিকভাবে উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন নিদর্শনগুলির জন্য বিখ্যাত। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এখানে রয়েছে অসংখ্য প্রাসাদ, ঐতিহাসিক উদ্যান এবং বহু পুরনো মসজিদ। এসবের জন্য মুর্শিদাবাদ একটি বিশিষ্ট পর্যটন গন্তব্য হিসাবে অবিরত রয়েছে। তাছাড়া একচেটিয়া রেশম উৎপাদনের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত এই স্থান।
মুর্শিদাবাদে কি কি দেখবেন ? What to see in Murshidabad?
প্রাচীন ভারতবর্ষের অন্যতম সম্পদশালী শহর এবং স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী মুর্শিদাবাদ, যার আনাচে-কানাচে ঘুরলে বাঙলার সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে সকল বাঙালি গর্বিত বোধ করে। ইতিহাসের আকর্ষণে তাই তো প্রায় সারাবছর ধরেই বাঙালি তথা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের জনগণ, এমনকি বিদেশিরাও এখানে এসে ভিড় জমান। নবাবী আমলের ঐতিহাসিক সব প্রাসাদ এবং স্থাপত্যগুলির সম্মুখে দাঁড়ালে মন নিমেষে চলে যেতে পারে সূদুর অতীতে। জেনে নিন মুর্শিদাবাদ গেলে কোন কোন জায়গা ঘুরে দেখবেন
১. কাশিমবাজার প্রাসাদ
ভারতীয় ও ইউরোপীয় স্থাপত্যের মিশ্রণে তৈরি কাশিমবাজার রাজবাড়ি। এটি মুর্শিদাবাদে অবস্থিত একটি মহৎ প্রাসাদ। এই রাজকীয় ঔপনিবেশিক সম্মুখভাগটি ১৭০০ সালে রয় বংশের জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে রয় বংশীয় পরিবার কিছু কক্ষকে অতিথি কক্ষ এবং একটি ওয়াক-থ্রু মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করে। প্রাসাদ দেখার আদর্শ সময় হল দুর্গাপূজার সময়; তখন প্রাসাদের ‘চণ্ডী মন্ডপ’ সুসজ্জিত হয় এবং মণ্ডপের সামনের খোলা উঠানের মধ্যে পুজোর শুভ আচার পালন করা হয়। প্রাসাদটি ভিক্টোরিয়ান যুগের আসবাবপত্র, বিলাসবহুল জিনিসপত্রে ভরা। নাগলিঙ্গম, সভা ঘর, মালখানা এবং ক্লক টাওয়ার কাশিমবাজার রাজবাড়ির কিছু আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক আকর্ষণ।
২. খোশ বাগ
মুর্শিদাবাদ গেলে ঘুরে আসুন খোশ বাগ থেকে, যা হল মুর্শিদাবাদে অবস্থিত একটি মনোরম বাগান এলাকা। এটি প্রায় ৮ একর বিস্তৃত। বাগানটি বাংলার প্রথম নবাব, আলীরবর্দী খান নির্মাণ করেছিলেন। এটি আসলে রক্ষণাবেক্ষণ করা বাগানের রূপে থাকা একটি কবরস্থান। এখানে নবাব আলীবর্দী খানের কবরের পাশাপাশি সিরাজ-উদ-দৌলা, তাঁর স্ত্রী লুৎফান্নেশা এবং নবাব পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও সমাহিত করা হয়েছে। উক্ত ব্যক্তিদের কবরগুলি একটি বর্গাকার, সমতল-ছাদের সমাধির ভিতরে রাখা হয়েছে যা একটি তোরণ বারান্দা দ্বারা ঘেরা। এখানে একটি সুন্দর মসজিদও আছে যা পর্যটকদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ।
৩. হাজরদুয়ারি প্রাসাদ
মুর্শিদাবাদের একটি অতুলনীয় গন্তব্যস্থল হল হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। এটি কিলা নিজামনাত ক্যাম্পাসে ৪১ একর বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। হাজারদুয়ারি নামটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে প্রাসাদটি “এক হাজার দরজা” দিয়ে অলঙ্কৃত। প্রাসাদের গেট বা প্রধান ফটক সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক তথ্য হল এই যে এর মধ্যে ৯০০টি দরজা আসল এবং বাকিগুলি দর্শনার্থীদের বিভ্রান্ত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে অর্থাৎ মিথ্যা দরজা। প্রাসাদটির সৌন্দর্য যেন শ্বাসরুদ্ধকর এবং এর কাছাকাছি বয়ে যাওয়া ভাগীরথী নদীর মনোরম প্রাকৃতিক আকর্ষণের কারণে এই প্রাসাদের সৌন্দর্য্য আরো বহুগুণ বেড়ে যায়।
প্রাসাদটিতে গেলে নবাবি জীবনযাপন ও আরো বিভিন্ন অজানা তথ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন। এছাড়াও প্রাসাদের গ্রীক এবং ইতালীয় স্থাপত্য শৈলী মনোমুগ্ধকর। বর্তমানে প্রাসাদটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং এখানে গিয়ে সিরাজ উদ দৌলার তরবারি এবং ভিনটেজ গাড়ির মতো অনেক প্রাচীন সম্পদ দেখতে পাবেন।
৪. নিজামত ইমামবাড়া
১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব নাজিম মনসুর আলী খান ফেরাদুন জাহ ভগীরথ নদীর তীরে অবস্থিত নিজামত ইমামবাড়া নির্মাণ করেন। ১৮৪২ এবং ১৮৪৬ সালের অগ্নিকাণ্ডে এটি অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এর পর নবাব মনসুর আলী খান ১৮৪৭ সালে এটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। বাংলা ও ভারতে সবচেয়ে বড় ইমামবাড়া বলে নিজামত ইমামবাড়াকেই মনে করা হয়। নবাব আমলে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করতে প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল।
ইমামবাড়াটি ৬৮০ ফুট লম্বা এবং সেন্ট্রাল ব্লকটি ৩০০ ফুট লম্বা। এটি সত্যিই একটি চিত্তাকর্ষক স্থাপত্য। পর্যটকরা শুধু প্রাসাদের জাঁকজমক দেখতেই আসে না, তবে প্রাসাদের পরিবেশের চারপাশে প্রশান্তিও অনুভব করে।
৫. কাঠগোলা
মুর্শিদাবাদের কাঠগোলাকে একসময় কাঠগোলা প্রাসাদও বলা হত, এর কারণ এই অঞ্চলটি এখানে অবস্থিত প্রাসাদটির জন্য বিখ্যাত। ১৯৩৩ সালে লক্ষ্মীপত সিং দুগার কাঠগোলা উদ্যান নির্মাণ করেন যা বর্তমানে কাঠগোলা মন্দির নামেও পরিচিত। মন্দিরের প্রধান দেবতা ভগবান আদিশ্বর। মন্দিরের ভগবান আদিশ্বরের ৯০ সেন্টিমিটার লম্বা একটি সাদা মূর্তি আছে যা পদ্মাসনে উপবিষ্ট। মন্দিরের নকশাটি অনন্য যা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক দর্শককে আকর্ষণ করে।
৬. কাটরা মসজিদ
মুর্শিদাবাদের একটি জনপ্রিয় মসজিদ হল কাটরা মসজিদ। এটি ১৭২৩ এবং ১৭২৪ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল নবাব মুর্শিদ কুলি খানের বিশ্রামস্থল হিসেবে। এটি মুর্শিদাবাদ শহরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের এক অন্যতম স্মৃতিস্তম্ভ এটি। মসজিদের প্রবেশ পথের সিঁড়ির উপর মুর্শিদকুলী খানের সমাধি নির্মিত হয়েছে।
মাস্কেট্রি অ্যাপারেচার সহ দুটি বিশাল মসজিদের কোনার টাওয়ার কাটরা মসজিদের সবচেয়ে লক্ষণীয় নিদর্শন। এছাড়াও ইট-নির্মিত বহু পুরোনো মসজিদের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য, যেমন দ্বিতল গম্বুজ ঘর, মিনার, কুরআনের শিলালিপি, খিলান এবং স্তম্ভগুলি এই স্থানটিকে মুর্শিদাবাদের এক অন্যতম দর্শনীয় গন্তব্য করে তুলেছে।
৭. জাহান কোষ কামান
“বিশ্ব ধ্বংসকারী কামান” নামেও পরিচিত জাহান কোষ কামান। এটি ঢাকার কারিগর জনার্দন কর্মকার ১৬৩৭ সালে তৈরি করেছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলার নবাবী আমলের যুদ্ধাস্ত্রের এটি একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র হিসেবেও পরিচিত এটি। এটি কাটরা মসজিদের কাছেই স্থাপন করা হয়েছে।
কামানটির দৈর্ঘ্য ১৭ ফুট ৬ ইঞ্চি, পরিধি ৫ ফুট, ওজন ২১২ মণ; কামান বিস্ফোরণের জন্য ২৮ সের (১৭ কিলো) বারুদের প্রয়োজন হয়। কামানটি তৈরী করা হয়েছিল অষ্ট ধাতু অর্থাৎ সোনা, রূপা, দস্তা, তামা, জিঙ্ক, টিন, লোহা ও পারদ দিয়ে; অষ্ট ধাতু দিয়ে তৈরী হবার জন্য আজও কামানটি মরচে বিহীন। এই কামান চাকা সহ একটি ক্যারেজের উপর শায়িত আছে এবং অশুত্থ গাছের শিকড় দ্বারা বেষ্টিত।
৮. নসিপুর প্রাসাদ
মুর্শিদাবাদে অবস্থিত একটি চোখ ধাঁধানো পর্যটন কেন্দ্র হল নসিপুর রাজবাড়ি। নশিপুরে অবস্থিত এই রাজকীয় প্রাসাদবাড়ির চারদিক ঘিরে আছে বনেদিয়ানা। রাজা কীর্তি চন্দ্র সিংহ বাহাদুর ১৮৬৫ সালে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সাথে এর বিশেষ মিল রয়েছে, তাই একে প্রায়শই হাজারদুয়ারি প্রাসাদের ক্ষুদ্রাকৃতি বলা হয়।
নসিপুর প্রাসাদের দুটি সেরা স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য হল বিশাল সিঁড়ি এবং বিশাল উল্লম্ব স্তম্ভগুলি। প্রাসাদের ভিতরে একটি বিশাল বিনোদন হল আছে। নশিপুর রাজবাড়ী বর্তমানে জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে ও নশিপুর রাজপরিবারের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, ফরমান, তৎকালীন কর আদায়ের বৈধ কাগজপত্র এবং অন্যান্য ধনসম্পদ সেখানে রক্ষিত আছে। অন্যদিকে রাজপ্রাসাদের নিকট রামচন্দ্রের একটি মন্দিরও আছে যা মুর্শিদাবাদের বৃহত্তম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি।
এগুলি হল মুর্শিদাবাদ জেলার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে কয়েকটি।
মুর্শিদাবাদে কোথায় থাকবেন, where to stay at Murshidabad?
মুর্শিদাবাদে থাকার জন্য বহু হোটেল আছে। এখানে দিন প্রতি ভাড়া ৭০০-৮০০ থেকে ২০০০-২৫০০ টাকায় থাকার যোগ্য হোটেল পেয়ে যাবেন। একটু ভালো হোটেল চাইলে ১০০০-১২০০ টাকায় পেয়ে যাবেন।
মুর্শিদাবাদে কোথায় খাবেন, Where to have meals at Murshidabad?
মুর্শিদাবাদে বহু খাবারের হোটেল আছে। ভাত চাইলে ভাত নয়তো অন্য ভিন্ন ধরনের খাবারও পেয়ে যাবেন এখানে।
শেষ কথা, Conclusion
একসময়ের বাংলা-বিহার- ওড়িশার রাজধানী মুর্শিদাবাদের রাজকীয় প্রাসাদ এবং অপূর্ব ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলির তাদের জন্য একটি আশীর্বাদ স্বরূপ যারা বাংলার সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যেতে পারেন মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদ বছরের যে কোনো সময় যেতে পারেন। তবে গরমের কারণে পুজোর সময় থেকে শীত কালে গেলে বেশি ভাল লাগবে।