আজকের অত্যাধুনিক যুগে সারা বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত নিত্যনতুন পণ্যসম্ভারের খোঁজখবর পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রশস্ত উপায় হল বিজ্ঞাপন। পৃথিবীর সর্বশ্রেণীর ক্রেতা এবং উপভোক্তা বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রভাবিত হন।
রাস্তার ধারে থাকা ল্যাম্প পোস্টের গায়ে, যানবাহনের পেছনে, বাড়ির দেয়ালে, বিভিন্ন ছোটো বড় সংবাদপত্রে, সামরিকপত্রে, সাইনবোর্ড, দেয়াল লিখন, দূরদর্শন – সর্বত্রই বিজ্ঞাপনের বাহার দেখতে পাওয়া যায়, যা সকলের চোখকেই একবার হলেও আকৃষ্ট করে, আবার কিছু বিজ্ঞাপন এমনও হয় যা মনকে স্পর্শ করে যায়। বিজ্ঞাপনের প্রয়োগ যত বেশি চিত্তাকর্ষক হয়, মানুষের মধ্যে তত বেশি প্রভাব বিস্তার করে।
বিজ্ঞাপন কি? What is advertisement?
কোন পণ্য বা পরিষেবা বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে প্রচার করার প্রক্রিয়াকেই বিজ্ঞাপন বলা হয়। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুগামীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা থাকে যাতে মানুষ সেই পণ্য বা পরিষেবা ক্রয় করে নেয়। বিজ্ঞাপনই আমাদের বিভিন্ন ব্যাপার সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে; যেমন পড়াশোনা সম্পর্কিত তথ্যাদি, হালফিলের কোনো চলচ্চিত্র, বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত নাটক, সংগীত, সাহিত্য ইত্যাদির খবর।
এছাড়াও মনোরঞ্জন এবং খেলাধুলা জগতের রকমারি ঘটনাগুলো তথা বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিজ্ঞাপনই আমাদের খবর জোগায়। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বহু মানুষের পেশার ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়। তাছাড়া জনবিনোদনের জন্য এক উৎকৃষ্ট উপায় হল বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে মানুষের চেতনাকে প্রভাবিত করে বিজ্ঞাপিত পণ্যটির চাহিদা বাজারে বাড়িয়ে দেওয়া এবং বিক্রি আরো বাড়ানো।
বিজ্ঞাপন মাধ্যম, advertisement as a media
বিজ্ঞাপন মাধ্যম বলতে এমন উপায় বা অবলম্বনকে বোঝায় যার মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তুকে জনসমক্ষে তুলে ধরা সম্ভব। প্রত্যাশিত ক্রেতাসাধারণের নিকট বিক্রয় বা পরিষেবা সংক্রান্ত সংবাদ অথবা বিভিন্ন অফার সম্পর্কে তথ্য পৌঁছানোর প্রক্রিয়াকেই বিজ্ঞাপন মাধ্যম বলা হয়। বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যম প্রচুর রয়েছে। এই প্রকার গুলির মধ্যে রয়েছে :
অনলাইন বিজ্ঞাপন : এই প্রকারে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এই ক্ষেত্রে, Google ads, Facebook ads, LinkedIn, Twitter ads, Instagram ads, ইত্যাদি হল বিজ্ঞাপন প্রচারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম।
ছাপানো বিজ্ঞাপন : ম্যাগাজিন, পত্রিকা, ব্যানার, লিফলেট এবং আরো অন্যান্য কিছু মাধ্যমে বিজ্ঞাপন ছাপানো হয় এবং প্রচার করা হয়।
ইমেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন : এই ক্ষেত্রে, ইন্টারনেট এবং ইমেইল এর সহায়তায় বিজ্ঞাপন ক্রেতাদের কাছে পাঠানো হয়।
ডিজিটাল বিজ্ঞাপন : বিপণনকারী মোবাইল/সেলুলার নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে পণ্য বা সেবা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে ও ক্রয় করার জন্য উৎসাহ দেওয়ার জন্য কিছু বিশেষ রকম ছাড় প্রদান করে বিজ্ঞাপন তৈরি করে পাঠানো হয়। বর্তমান সময়ে ক্রেতা ও ভোক্তা জগতে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও ইন্টারনেট ব্যবহার জনপ্রিয় হবার কারণে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বেশ জনপ্রিয়।
পরিবহন বিজ্ঞাপন : বিভিন্ন প্রকার গাড়িতে দেখতে পাওয়া যায়, বিশেষ করে ট্রাক বা বাস, ট্যাক্সি, রিকশার ইত্যাদির গায়ে পণ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে পণ্য বিজ্ঞাপিত করা হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যম যেমন, টিভি (TV), রেডিও ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলির মাধ্যমেও বিজ্ঞাপন জনসমক্ষে তুলে ধরা যায়। তাছাড়া রয়েছে বিজ্ঞাপনী ফলক, যেমন : রাস্তার মোড়ে হার্ডবোর্ডের বিজ্ঞাপনী ফলক তৈরি করে তার ওপর বিশেষ কোনো পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যাপারটা তো প্রাচীনকাল থেকেই একটা জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনী মাধ্যম হিসেবে আমরা দেখেছি। তবে এই মাধ্যম বেশ স্থায়ী প্রকৃতির, যার কারণে অনেকদিন ধরে এরূপ বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্র সুবিধা প্রদান করে।
বিজ্ঞাপনের সুফল ও কুফল: advantages and disadvantages of advertisement
পৃথিবীর অন্য সকল বিষয়ের মতন বিজ্ঞাপনেরও নির্দিষ্ট কিছু সুফল ও কুফল রয়েছে। এক্ষেত্রে সুফলের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করতে হয় যে,
- বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যেভাবে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা যায় তা এক কথায় অতুলনীয়। সাধারণ জিনিসকেও বিজ্ঞাপনের সাহায্যে অসাধারণ করে তোলা যায়।
- বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচার-প্রসারে বিজ্ঞাপন অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তাই সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোন একটি বিষয়ের সংযোগ স্থাপন করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের জুড়ি মেলা ভার।
- বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বিজ্ঞাপন তৈরি করার কাজ একটি সার্বিক ইন্ডাস্ট্রির পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গিয়েছে, যার ফলে অসংখ্য মানুষ শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন তৈরির কাজের ওপর নির্ভর করেই নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
- আধুনিক যুগে বিজ্ঞাপন নতুন প্রকার সৃজনশীলতারও সুযোগ করে দেয়, নিজের মধ্যে থাকা শিল্পীকে বিজ্ঞাপন তৈরির এবং সঠিক উপস্থাপনার মাধ্যমেও প্রকাশ করা যায়।
- অনেক সময় দূরে কোথাও কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলে আমরা সাধারণত জানতে পারি না, তাই অনেকেরই চাকরির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বহু মানুষের পেশার ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়।
তবে উপরিউক্ত সুফলের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের বেশ কিছু কুফলও বর্তমান। যথা :
- বর্তমান যুগে মানুষের জীবন অত্যন্ত বেশি মাত্রায় বিজ্ঞাপনকেন্দ্রিক হয়ে ওঠার কারণে বিভিন্ন অসাধু উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপনকে ব্যবহার করা আরো সহজ হয়ে উঠেছে।
- বিজ্ঞাপনের জৌলুসে মানুষ অনেক সময় এমন অনেক দ্রব্য ক্রয় করে নেয়, যা তার কাছে অত্যাবশ্যক নয়। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে মানুষের অর্থের অপচয় ঘটে থাকে, যা হয়তো তারা অন্য কোনো ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারতো।|
- কিছু কিছু বিজ্ঞাপনের উপস্থাপনা এতটাই আকর্ষণীয় হয় যে, এগুলো মানুষকে বিভিন্ন সময়ে ক্ষতিকর জিনিস কিনতেও উৎসাহিত করছে।
- বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন ধর্ম বৈষম্য, শ্রেণী বৈষম্য, বর্ণ বৈষম্য ইত্যাদির মতো নানা বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
- বিজ্ঞাপনের উপর প্রত্যেক দেশের নিজস্ব আইনানুগ বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও বহুক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে অশ্লীলতা বা বিকৃত রুচির প্রকাশ ঘটে, যা জনমানসের উপর প্রায়শই খারাপ প্রভাব ফেলে।
- বিজ্ঞাপনের প্রভাবে অনেক সময় পণ্যের প্রকৃত গুণাগুণ ও প্রয়োজনীয়তা বিচার না করেই উপভোক্তরা সেই বিজ্ঞাপিত পন্য ক্রয় করেন। লক্ষ্য করে দেখা যায় যে এমন অনেক দ্রব্য আছে যেগুলি শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের সুবাদেই বিক্রয়যোগ্য হয়ে ওঠে।
বিজ্ঞাপনের ভবিষ্যৎ, Future of advertisement
আধুনিক যুগে বিজ্ঞাপনের সাথে তথ্যপ্রযুক্তির যে অপরূপ মেলবন্ধন ঘটেছে, তাতে বিজ্ঞাপনের মান দিন দিন আরো উন্নত হয়ে উঠছে। তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সামাজিক মননে আজকের যুগে যে আমূল বিবর্তন ঘটেছে তা কারও অজানা নয়, এই বিবর্তনের তালিকায় মধ্যে বিজ্ঞাপনও আছে। বলতে গেলে বিজ্ঞাপনের মান পূর্ব সময় থেকে আরো উন্নত হয়ে উঠেছে।
তাছাড়া এখনকার সময়ে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে একটি বিজ্ঞাপন অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই বিবর্তনের ধারায় বিজ্ঞাপনই যেন ঠিক করে দিচ্ছে যে মানুষ কোন খাবার খাবে, কী দেখবে, কি পরবে, এমনকি কি নিয়ে চিন্তা করবে এবং কিভাবে চিন্তা করবে সেটাও যেন বিজ্ঞাপনই নিশ্চিত করে দিচ্ছে। বিশেষত সার্চ ইঞ্জিনগুলি এবং ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া; এই দুই স্তম্ভের উপর ভর করেই বিকশিত হচ্ছে ভবিষ্যতের বিজ্ঞাপনী মাধ্যম।
বর্তমান যুগে বিজ্ঞাপনকে হয়তো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের থেকে পৃথক করে আর দেখা যাবে না। বিজ্ঞাপন এর প্রয়োজনীয়তা তথা উপযোগিতা সম্পর্কে কারও মনে কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। কিন্তু বিজ্ঞাপনের সর্বব্যাপী প্রসারের সাথে মানুষের স্বাভাবিক জীবনের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার ভবিষ্যত প্রভাব অনেকের মনেই সন্দেহ জাগিয়ে তোলে।
উপসংহার, Conclusion
বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনে বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম, এ কথা অস্বীকার করার নয়। আধুনিক যুগে বিজ্ঞাপন আমাদের সামাজিক জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে রেখেছে। কিন্তু জাগ্রত নাগরিক হিসেবে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে বিজ্ঞাপনের পিছনে প্রায়শই থাকে বাণিজ্যিক লক্ষ্য। বিজ্ঞাপন সমাজের উন্নতিতে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করার সুবাদে যেন প্রত্যেক দেশের সংস্কৃতির এক অভিন্ন অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ক্রেতাদের সতর্ক হওয়া উচিত এবং বিজ্ঞাপনের রংবাহারে প্রলোভিত না হয়ে বরং প্রয়োজন অনুযায়ী ভালোভাবে যাচাই করে বিজ্ঞাপনে দেওয়া পরিষেবাগুলি নেওয়া উচিত।