বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু, কিন্তু একথা জেনেও আমরা দিনের পর দিন গাছ কেটে বন ধ্বংস করে চলেছি। বৃক্ষ যে শুধু প্রাকৃতিক শোভা বর্ধন করে তা-ই না, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বৃক্ষের প্রাচুর্যের ফলে মাটির ক্ষয় রোধ হয়, বন্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়, এমনকি বৃক্ষ ঝড় তুফানকে বাধা দিয়ে জীবন ও সম্পদকেও রক্ষা করে থাকে। তাছাড়া আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রেও বৃক্ষের ভূমিকা অপরিসীম।
যদি পৃথিবীতে বৃক্ষ না থাকতো তবে হয়তো এই পৃথিবী সম্পূর্ণটাই মরুভূমিতে পরিণত হতো। সবচেয়ে বড় কথা বৃক্ষ অক্সিজেন সরবরাহ করে আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস সচল রাখে। তাই বৃক্ষ প্রাণের অগ্রদূত বলেই পরিচিত। তাই আমাদের উচিত বনাঞ্চল ধ্বংস না করে বরং বৃক্ষরোপণ করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা।
পৃথিবীতে বৃক্ষের প্রয়োজনীতা, Necessity of trees in the world
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন কর্মের সাথে বৃক্ষের ভূমিকা জড়িত। এক কথায় পৃথিবীতে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, কারণ বৃক্ষ আমাদের পরিবেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। বলতে গেলে এটি পরিবেশের অন্যতম সম্পদ।
বৃক্ষের ভূমিকা আমাদের জীবনে কতটা সেটা বুঝতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয় যে আমাদের খাবারের যোগান আমরা গাছ থেকেই পাই, সেটা প্রত্যক্ষভাবে হোক কিংবা পরোক্ষভাবে। বিভিন্ন গাছের পাতা থেকে শুরু করে ফল ও বীজ, কান্ড অর্থাৎ পুরো অংশই আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি। এছাড়াও আমাদের পরিধেয় বস্ত্র প্রস্তুত করার জন্য বৃক্ষ থেকে তন্তু আহরণ করা হয়।
বৃক্ষ থেকে প্রাপ্ত কাঠ আমাদের বাড়িঘরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং আসবাব ইত্যাদি তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত হয়। তাছাড়াও আমাদের পড়ালেখা বা অফিসের কাজে ব্যবহৃত অতি প্রয়োজনীয় লেখার সামগ্রী যেমন কাগজ ও পেনসিল বৃক্ষের ছাল বা কাঠ দিয়েই তৈরি করা হয়ে থাকে। এসব কিছু ছাড়াও আমাদের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রেও ঔষধি গুণ সম্পন্ন বৃক্ষগুলির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাই কবি লিখেছেন –
“সুস্থ জীবন স্বপ্ন পূরণ, গোলকের ধাঁধাঁ মোরা,
স্নিগ্ধ বাতাস সাথে সুবাস,ধরতি বাঁচায় ওরা,
বৃক্ষ নীড়ে তারি কুটিরে,কতনা জীবের মেলা,
তারে মারিলে মরিবো মোরা,সৃষ্টি হারাবে বেলা।”
জীবন ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে বৃক্ষের ভূমিকা, Role of trees in protecting life and environment
ছোটবেলায় হোক কিংবা বড়বেলায়, যখনই কোনো পথিকের গল্প আমরা পড়েছি তখন একটা কথার উল্লেখ সেখানে অবশ্যই থাকে যে, কোনো পথিক ক্লান্ত হলে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। তবে শুধু গল্পে নয় বরং আমরা নিজেও হয়তো অনেকবার অন্য মানুষকে এভাবে করতে দেখেছি এবং নিজেরাই গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়েছি।
গাছের ছায়ায় বসে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই বলা যায় যে, বৃক্ষ জীবজগতকে ছায়া দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। বৃক্ষের ছায়ায় পরিবেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে বলে মাটির জল সহজে বাষ্পে পরিণত হয় না, বরং বিস্তৃত বনাঞ্চলের বৃক্ষগুলি জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ুকে ঘনীভূত করে, ফলে বৃষ্টিপাত হয়।
তাছাড়া গাছপালা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে অক্সিজেন গ্যাস পরিবেশে ছেড়ে দেয়, যার ফলে মানুষ ও অন্য প্রাণীকুল সহজে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে, তাদের অক্সিজেনের অভাব হয় না। তাছাড়া বৃক্ষ মাটির ক্ষয় রোধ করে, বৃক্ষ থাকলে মাটি সহজে বন্যার জল প্রবাহের সাথে ভেসে সরে যায় না, কারণ গাছের জড়গুলো মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে।
পৃথিবীতে বৃক্ষের বর্তমান অবস্থা, Current status of trees in the world
একটা সময় এমন ছিল যখন বিজ্ঞান এতটা অগ্রসর হয়নি। মানুষ খুব সাধারণ জীবনযাপন করতো, আজকের দিনে ব্যবহৃত বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তখনও আবিষ্কার হয়নি। এখনকার মতো কারখানা বা শিল্পাঞ্চল তখন ছিল না, কিন্তু একটা বিষয় যেটা প্রাচুর্যে ভরা ছিল সেটা হল বনাঞ্চল। বৃক্ষ সুশোভিত অঞ্চলগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বর্ধক ছিল।
কিন্তু ক্রমে মানুষ নিজের চাহিদা পূরণ তথা জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে বনাঞ্চল ধ্বংস করতে শুরু করে। বর্তমানে আমাদের দেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গাছের পরিমাণ অনেকটা কম হয়ে গেছে, তা সত্বেও মানুষ নিজ স্বার্থে অরণ্য সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে। এক কথায় বলতে গেলে মানুষ যত সভ্য ও বৈজ্ঞানিক ভাবে অগ্রসর হচ্ছে, প্রাকৃতিক সম্পদ ততই ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক নগরজীবনে শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি আরো বিভিন্ন সমস্যা বেড়ে চলেছে।
এ দেখেই হয়তো কবি ব্যাকুল হয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন “দাও ফিরে সে অরণ্য, লহ এ নগর।” এ বিষয় কারও অজানা নয় যে সৃষ্টির আদি ছিল অরণ্য দ্বারা আচ্ছাদিত। প্রাচীনকালে আমাদের পৃথিবীর প্রায় সমগ্র স্থলভাগই ছিল আরণ্যাবৃত। কিন্তু সময়ের সাথে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ বশত জনবসতির বিস্তার ও তাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে কৃষি জমি প্রসারের উদ্দেশ্যে বনভূমির বুক থেকে ক্রমশ বৃক্ষ ছেদনের নির্মম খেলা চলছে নিত্যদিন।
বৃক্ষ সংরক্ষণে আমাদের করণীয় হল বৃক্ষরোপণ, Necessity of Planting trees
আধুনিক সভ্যতার শিল্পের উপকরণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সীমাহীন প্রয়োজনের তুলনায় দেখতে গেলে আমাদের বৃক্ষের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের প্রত্যেকেরই পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণে অংশগ্রহণ করা উচিত। জনজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনা তথা ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দূরে থাকতে হলে আমাদের প্রত্যেকের বৃক্ষ রোপন করা দরকার। এর কারণ হল গাছ মানুষের বন্ধু এবং আমাদের প্রকৃতির সবচেয়ে অকৃত্রিম ও নির্বিবাদী এই বন্ধুকে আমাদেরই রক্ষা করতে হবে এবং সেটাও আমাদেরই স্বার্থে। কবির কথায় – ” গাছই জীবন তাতেই ভুবন, তাই করো সবে বৃক্ষরোপণ।”
বন সংরক্ষণ তথা বনসৃজন এর উদ্দেশ্যে আমাদের অবশ্যপালনীয় কিছু কর্তব্য হল, Our mandatory duties for saving trees
- অরণ্যের অবাধ উচ্ছেদ নিবারণ করা।
- অপরিণত বৃক্ষ ছেদন রোধ করা।
- দাবানলের হাত থেকে বনাঞ্চলকে রক্ষার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা।
- বিভিন্ন স্থানে যথেচ্ছ পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করা।
- রোপন করা চারা গাছের যত্ন ও সংরক্ষণ।
- বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণের কাজে স্থানীয় মানুষকে যোগদানের জন্য উৎসাহ দেওয়া।
- শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপক প্রচার করা।
- কিছুদিন পর পর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা।
বৃক্ষরোপণ তথা অরন্যের পুনরুদ্ধার হোক আমাদের অঙ্গীকার, Plantation and restoration of forests is our commitment
“বৃক্ষে বাঁচুক ধরণী, বৃক্ষে বাঁচুক ক্ষুধার্ত প্রকৃতির প্রাণ দুর্যোগে না ডরাই, হবো বৃক্ষে মহীয়ান।” এই কথা মাথায় রেখে বৃক্ষরোপণ তথা এর সংরক্ষণের মহাযজ্ঞে আমাদের সফল হতে হবে, তাহলেই হয়তো আমরা আবার বীজাণু মুক্ত স্নিগ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে পারবো। এভাবেই আমরা পৃথিবীর জীবকুলকে এক অমোঘ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবো।
বৃক্ষরোপণ করে আমাদের চারপাশে গাছপালা দিয়ে ভরে তুললেই আবারো পৃথিবীর প্রাণী ও উদ্ভিদকূল প্রকৃতির নিয়মে পারস্পারিক আদান-প্রদান করে পরম শান্তিতে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। তাই পৃথিবীর সংকটকালে দূর ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্নকে চোখে রেখে সমগ্র মানবজাতির এই অঙ্গীকার নেওয়া উচিত যে সবাই মিলে পরিবেশ রক্ষা করবো। কবির ভাষায় বলতে গেলে –
“চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
উপসংহার, Conclusion
বৃক্ষহীন পরিবেশ আমাদের জীবন তথা জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে এক ভয়ঙ্কর হুমকির মত। তাই বন সম্পদের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি পূরণের দায়িত্ব আমাদেরই, এর জন্য লাগামহীন বৃক্ষনিধন বন্ধ করে বরং বৃক্ষরোপণ করার প্রতি আমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। তাই ‘ আসুন গাছ লাগাই, পরিবেশ বাঁচাই’ স্লোগানকে সামনে রেখে সকলে মিলিতভাবে বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধি করি এবং পরিবেশকে সুন্দর করে তুলি।