বর্তমান সময়ে বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, যার কারণে স্বাস্থ্য সমস্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। তবে শুধু মানুষ নয় বরং প্রাণীকূলও এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, দূষণের মাত্রাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানবজাতির অগ্রগতির সাথে। বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের বাসযোগ্য পরিবেশ।
মাটি, জল, ইত্যাদির পাশাপাশি বেড়ে চলেছে বায়ুদূষণের মাত্রাও। বিভিন্ন উপায়ে ক্ষতিকারক পদার্থ বাতাসে মিশে গিয়ে বায়ু দূষণ ঘটছে, আর এই দূষণের ফলে ক্ষতি হচ্ছে স্বাস্থ্যের, তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ভারসাম্যও। বায়ু দূষণের ফলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তরেও প্রভাব পড়ছে, ক্রমে পাতলা হয়ে যাচ্ছে ওজোন স্তুর, যার প্রভাব পড়ছে জলবায়ুর উপর।বলতে গেলে জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের মূল কারণ হল বায়ুদূষণ। এ অবস্থায় কবির কথাগুলো মনে পড়ে যায়,
“অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু, চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু।”
বায়ুদূষণের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, Increase in the rate of air pollution
গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণ বেশি হয়। এর কারণ স্পষ্ট; শিল্প, যানবাহন এবং নগরায়ন। কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় থাকে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাসও তাছাড়া যানবাহনের ক্রমাগত যাতায়াত ধুলিকণাজনিত দূষণ ঘটায়। বায়ু দূষণের জন্য দায়ী বিভিন্ন উপাদান ঘরের বাইরের আবহমণ্ডলে ছড়িয়ে আছে। যেমন – বিষাক্ত ধোঁয়া, ধূলিকনা, গ্যাস, কুয়াশা, কাঁকর, ধোঁয়াশা ইত্যাদি। বায়ু দূষণ আমাদের পরিবেশের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলছে।
দিনের পর দিন জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তা স্পষ্ট। তাছাড়াও প্রভাবিত হচ্ছে আমাদের জীবকুল। মানবজাতি এই বায়ু দূষণের প্রভাবে বিভিন্ন রোগের সম্মুখীন হচ্ছে, তাছাড়াও আরো নানারকম সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে বায়ু দূষণের দুই রকম কারণ রয়েছে, এক হল প্রাকৃতিক এবং অপরটি মানবসৃষ্ট। এমনটা নয় যে শুধু মানবসৃষ্ট কারণেই বায়ু দূষণ হচ্ছে, প্রাকৃতিক বেশ কিছু কারণেই বায়ু দূষণ ঘটে।
বায়ুদূষণের প্রাকৃতিক কারণ, Natural causes of air pollution
প্রাকৃতিক উপায়ে বায়ু বিভিন্ন ভাবে দূষিত হয়, যেমন –
দাবানল –
প্রাকৃতিক দূর্যোগ যেমন বজ্রপাত, গাছে গাছে ঘর্ষণ হওয়া ইত্যাদি কিছু কারণে অনেক সময় বনভূমিতে আগুন লেগে দাবানলের সৃষ্টি হয়। এই প্রাকৃতিক উপায়ে বনভূমি পুড়ে যাওয়ার ফলে বায়ুর সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, ছাই ইত্যাদি যুক্ত হয়ে বায়ুদূষণ ঘটায়।
আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত –
আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাতের সময় প্রচুর কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, যা বায়ুকে দূষিত করে তোলে।
ধূলিঝড়ের ফলে বায়ু দূষিত হয় –
মরুঅঞ্চলে দিনের বেলায় সাধারণত প্রচন্ড উত্তাপের ফলে ধূলিঝড়ের সৃষ্টি হয়, যার মাধ্যমে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ধূলিকনা বাতাসে মিশে গিয়ে বায়ুর ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। ফলে বায়ু দূষণ ঘটে।
পচনের ফলে নির্গত গ্যাস –
কোনো জীবের মৃতদেহে পচন ধরলে আমরা দুর্গন্ধ পাই, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না যে মৃত জীবদেহের পচনের ফলে বিষাক্ত গ্যাস যেমন মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে বায়ু দূষণ ঘটায়।
বায়ু দূষণে মানবসৃষ্ট কারণ, Man made reasons of Air pollution
অধুনিক সভ্যতা বিজ্ঞানের হাত ধরে ক্রমশ উন্নত হচ্ছে, কিন্তু এই উন্নতি পরিবেশের উপর আঘাত সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে প্রতিনিয়ত অবাঞ্ছিত বস্তু বায়ুমণ্ডলের সাথে মিশ্রিত হয়ে বায়ুদূষণ সৃষ্টি করছে। এই মানবসৃষ্ট কারণগুলো হল:
কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া –
শহরাঞ্চলে দিনের পর দিন কারখানার পরিমাণ বেড়ে চলেছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণ। শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলি থেকে নির্গত হয় কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, এর মত বিষাক্ত গ্যাস, এছাড়াও থাকে ধাতব কনা, বিষাক্ত ধোঁয়া প্রভৃতি। এই সব কিছু বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বায়ু দূষিত করে।
যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া –
বিভিন্ন যানবাহনে পেট্রোল ও ডিজেলের মত জ্বালানি ব্যবহার করা হয়, এগুলোর দহনের ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকার গ্যাস নির্গত হয়, যা বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। তবে গ্রামাঞ্চলের তুলনায় যানবাহনের আধিক্যের জন্য শহরাঞ্চলের বাতাস বেশি দূষিত হয়।
তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও পারমানবিক কেন্দ্র–
কয়লার উপর নির্ভর করা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস নির্গত হয়ে বায়ুর সাথে মিশে যায়, এছাড়াও বাতাসে প্রচুর পরিমানে ছাই মিশে যায়, ফলে বায়ু দূষিত হয়। অন্যদিকে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লিগুলোর মাধ্যমে প্রচুর পরিমানে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নির্গত হয়ে বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে বায়ুকে দূষিত করছে।
অন্যান্য বায়ুদূষণকারী বিষয় :
সভ্যতার অগ্রগতির ফলে মানুষ রোজই অরণ্য সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে। কিন্তু এই অরণ্য ধবংসের ফলেই অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, যা বিভিন্নভাবে সমস্যার সৃষ্টি করছে।
অপচনশীল আবর্জনা তথা বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য পুড়ানোর ফলে উৎপন্ন হয় ধোঁয়া, ছাই যা থেকেও বায়ু দূষিত হয়।
শহরাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ বাড়িতে Ac বা শীততাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ব্যবহার করেন, যার থেকে নির্গত হয় CFC, অর্থাৎ ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন, যা বাতাসে মিশে ওজোন স্তরকে ধ্বংস করছে।
বায়ু দূষণের ফলে সৃষ্ট রোগ, Diseases caused by air pollution
বায়ুদূষণের প্রভাবে রোজই কেউ না কেউ অসুস্থ হচ্ছেন। অনেকের ক্ষেত্রে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মানুষ এই বায়ু দূষণের ফলে ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসজনিত রোগ যেমন হাঁপানি, ল্যারিঞ্জাইটিস, ব্রংকাইটিস সহ আরো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়াও দূষিত বায়ু হৃদরোগ সহ মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে তার অধিকাংশই বায়ু দূষণজনিত। গবেষণা অনুযায়ী জানা যায় যে, বহু মানুষ প্রতি বছর বায়ুদূষণ জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যায়। তাই আজ থেকেই সতর্ক হতে হবে এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে।
বায়ুদূষণ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, Ways to control air pollution
বায়ুমন্ডল কে দূষণ মুক্ত রাখতে হলে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং নিম্নলিখিত পদক্ষেপ অবলম্বন করতে হবে :
বনসৃজন –
আমরা সকলেই জানি যে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে গাছ সাহায্য করে, তাই অরণ্য ধ্বংস না করে বরং প্রচুর পরিমানে বৃক্ষ রোপন করলে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের ভারসাম্য ঠিক থাকবে, যার ফলে বায়ু দূষণ এর প্রভাব কম হবে।
অপ্রচলিত শক্তিগুলোর ব্যবহার –
অন্যান্য দূষণ সৃষ্টিকারী জ্বালানি ব্যবহার না করে বরং দূষণ মুক্ত সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জোয়ার ভাটার শক্তি ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশুদ্ধ জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধি –
সালফার বিহীন কয়লার ব্যবহার তথা সিস বিহীন পেট্রোল ব্যবহার করলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বায়ু পরিশোধক যন্ত্র স্থাপন –
বায়ুদূষণের উৎস গুলিতে যেমন শিল্পকারখানা , তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এই সব স্থানে বায়ু পরিশোধক যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে যাতে বায়ু দূষণের পরিমান হ্রাস পায়। কারখানাগুলোর চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া থেকে ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটরের মাধ্যমে বায়ু থেকে ধূলিকনা পৃথক করে নেওয়ার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে ক্যাটালেটিক কর্নভার্টার বসিয়ে বায়ুদূষণ হ্রাস করা সম্ভব হবে।
কঠোর আইন প্রনয়ন –
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ দ্বারা বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে দূষণ কারীদের বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি –
বায়ুদূষণ সৃষ্টির উৎস এবং এর কুফল সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে, তবেই বায়ু দূষণ রোধ করা সম্ভব।
উপসংহার, Conclusion
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মানুষের পারিপার্শ্বিক বায়ুমণ্ডলে অবাঞ্ছিত ও দূষিত পদার্থের উপস্থিতি বিপদজনক মাত্রা অতিক্রম করে নিলে জীবজগতের পক্ষে যে ক্ষতি হয়, তাকে বায়ুদূষণ বলা হয়। তাই এই দূষণ রোধ করা এবং আমাদের পরিবেশ ও সভ্যতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের হাতেই। উপরিউক্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে সচেতনতার সাথে এগিয়ে গেলে সবাই মিলে বায়ুদূষণ রোধ করতে সক্ষম হতে পারবো।