সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-র লেখা ‘ঝড়’ কবিতা আমরা সকলেই হয়তো ছোটবেলায় পড়েছিলাম। সেই কবিতায় কয়েকটি পঙক্তি ছিল—ঝড় রুষিয়ে / ধায় ঢুসিয়ে / ফোস ফুঁসিয়ে / খুব হুঁশিয়ার। দানবীয় সাইক্লোন আমফান-এর রাক্ষুসে কামড় খেয়ে এই কবিতার কথা হয়তো অনেকেরই মনে পড়েছিল। আমফানের ধ্বংসলীলা বাংলার সকলের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। যদিও আবহাওয়া দপ্তর পূর্ব থেকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, ব্যবস্থা করা হয়েছিল উপযুক্ত সরকারি ব্যবস্থাপনারও। কিন্তু ঝড়ের বিধ্বংসী রূপের কাছে হার মানতে হয় সবকিছুকেই।
আস্ফান কী ? What is Amphan
আস্ফান একটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়। ভয়ংকরতার নিরিখে এই শতাব্দীর সেরা ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচিত হয় এটি। এর আমফান বা UMPUN হল একটি থাই শব্দ—যার অর্থ আকাশ। ২০০৪ সালে থাইল্যান্ড ঘূর্ণিঝড় আস্ফানের নামকরণ প্রস্তাব করেছিল, আরবসাগর ও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অন্যান্য রাষ্ট্রগুলাের সহমতের ভিত্তিতে ঘূর্ণিঝড়ের এই নাম নির্ধারিত হয়। ২০২০ সালে ১৬ মে এই ঝড়ের উৎপত্তি হয় এবং ২১শে মে, এই ঝড় বিলুপ্ত হয়।
কোভিড-১৯ এর লকডাউন চলাকালীন, ২০২০ সালের ২০শে মে, ১৮৫ কি.মি. গতিতে, রাতের নিকষ অন্ধকারে দুই মেদিনীপুর, দুই চব্বিশ পরগনা, কলকাতা ও হাওড়া, হুগলিতে ও অন্যান্য জেলায় প্রচণ্ড তাণ্ডব চালিয়ে মানুষকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল এই ঘূর্ণিঝড়।
ঘূর্ণিঝড়ের স্বরূপ, The horrific side of Amphan
ঘূর্ণিঝড় আমফান সুপার সাইক্লোন হিসেবে বিবেচিত। মায়ানমার সংলগ্ন একটি বিপরীত ঘূর্ণাবর্ত হল আমফানের সুপার সাইক্লোন হয়ে ওঠার কারণ। উক্ত ঘূর্ণাবর্তের ঘেরাটোপেই ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পর ধীরগতিতে বাংলার দিকে এগিয়েছে আস্ফান। এর গতি ধীর থাকায় দফায় দফায় শক্তিও সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছিল আম্ফান।
১৮ মে বিকেলের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গের দীঘা থেকে এই ঝড় ১২০০ কিমি. দূরে ছিল, তা প্রথম ৪৮ ঘণ্টায় মাত্র ৩৪০ কিমি. সরে গিয়েছিল এবং পরের ৪৮ ঘণ্টায় ৮৬০ কিমি. পথ পেরিয়ে সরাসরি পশ্চিমবাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঢুকে পড়েছিল। ঘূর্ণিঝড় দ্রুতগতি না থাকলে তা আরাে বেশিক্ষণ তাণ্ডব চালাতে পারত। ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে মেদিনীপুর, দুই চব্বিশ পরগনা, কলকাতা, হুগলি ও হাওড়ায় ভারী বৃষ্টি ও ঝড় হয়েছিল। আম্ফানের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২৮০ কিমি. ১ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল—তখন মনে হয়েছিল যেন বাড়িগুলাে ও গাছপালা দুলছে এবং তারাও যেন ঝড়ের সঙ্গী হতে চায়। ঘরে বসে থেকে যেন আতঙ্ক বিরাজ করে মনে যে ঝড় বাড়ির ছাদ উড়িয়ে নেবে, কোনো বড় গাছ বাড়ির উপর ভেঙে পড়বে, নাকি প্লাবিত জল ঘরের ভেতর ঢুকে পড়বে। বন্যাপ্রবণ অঞ্চলগুলো বিশেষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।
সাধারণ ঝড় বৃষ্টি যেসব এলাকার অবস্থা খারাপ করে দেয়, সেইখানে আম্ফানের মত সুপার সাইক্লোন কতটা ক্ষতি করতে পারে ভাবলেই যেন গা শিউরে উঠে। স্বভাবতই বহু মানুষ এই ঝড়ের দাপটে ঘরছাড়া হয়, খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয় তাদের।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃতি, Nature of Cyclone
আমফান বাংলায় আঘাত করা সকল ঘূর্ণিঝড়গুলির মধ্যে তীব্রতার নিরিখে পঞ্চম স্থানে আছে। ২০ মে এই ঝড় তাণ্ডব দেখাতে শুরু করেছিল এবং পূর্ব কলকাতা ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিল। ঝড়ের সাথে ছিল ভারী বৃষ্টিপাত যা শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট বন্যায় বেশ ক্ষতি হয়েছিল।
এক কথায় বলতে গেলে আস্ফান উন্মত্তের মতাে এগিয়ে গিয়ে চারিদিক সম্পূর্ণ নিষ্প্রদীপ তথা চারিধার নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে পরিণত করে দিয়েছিল। ঝড়ের তান্ডব পর কানে তালা লাগানাে ঝিঝির ডাক আর কোলাব্যাঙের নিরন্তর গােঙানি শোনা যাচ্ছিল। ভয়, নিরাশ্রয়তা এবং অনেকের সর্বস্ব হারানাের স্মৃতিতে ভরপুর হয়ে থাকবে এই সর্বগ্রাসী ঝড়ের তান্ডব। রাস্তায় উপড়ে পড়ে আছে বিদ্যুতের খুঁটি, টিনের চাল, বাড়ির সীমানার দেয়াল, বড় বড় গাছ। খােলা আকাশের নিচে আশ্রয় হারিয়ে অসহায় হয়ে গিয়েছিল বহু মানুষ। সেই আঁধার রাতে অনেক নিরাশ্রয় মানুষ যেন এক শ্মশানের ভয়াবহতাকে নিরীক্ষণ করছিল।
আম্ফান ঝড়ের কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি, Damage caused by Amphan storm
“গােদের উপর বিষফোঁড়া” অর্থাৎ এক যন্ত্রণার উপর তীব্রতর আরেক যন্ত্রণা। এমনটা বলার কারণ হল কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আর এক দুর্যোগ ছিল আমফান, যা সমগ্র বঙ্গবাসীর দুর্দশা বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং সকলকে আতঙ্কের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছিল।
প্রথমেই করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চারিদিকে পরিযায়ী শ্রমিকের নিরন্নতা, বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মী ছাঁটাই, করােনার মতাে মহামারী রােগের মােকাবিলা করা, তার উপর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ—যার কারণে জনজীবন হয় অবরুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ মানুষ ভোগে আশ্রয়হীনতা ও নিরন্নতায়—এই হল ঘূর্ণিঝড়ের ফলাফল। কত চাষির ফসল নষ্ট হয়েছিল। মাঠ নােনা জলে পরিপূর্ণ ছিল, ঘরবাড়ি ছিল বিধ্বস্ত, স্বজন হারানাের দুঃখে কাতর ছিল বহু মানুষ এবং সর্বোপরি ভয় ও আতঙ্ক মানুষকে গ্রাস করেছিল।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, টেলি যােগাযােগ, মােবাইল পরিষেবা, রাস্তাঘাট সবই বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের অভাবে অনেক সমস্যা সৃষ্ট হয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করতে গিয়ে দেখা গিয়েছিল যে শুধু কলকাতা শহরেই প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গাছ উপড়ে গিয়েছে এবং মাটি ক্ষয় হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ৩.৮৯ কোটি মানুষের ক্ষতিসাধন করেছিল এই ঝড়। ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
বন্যার সাথে পশু পাখি, গৃহপালিত পশু ভেসে গিয়েছিল। এছাড়াও ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে, কৃষিক্ষেত্রে ধান, তিল, সবজি এবং পুকুরের মাছেরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।
বিপর্যয়ের পর ত্রাণ ও উদ্ধারকার্য, Post-disaster relief and rescue operations
যে কোনাে বিপর্যয়ের ধ্বংসলীলার পর প্রথম এবং প্রধান কাজ হল ত্রাণ ও পুনর্বাসন। আমফানের পর কোভিড পরিস্থিতিতেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল সরকার ও বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। প্রশাসনিক তৎপরতায় বিভিন্ন দুর্দশাগ্রস্ত অঞ্চলে খাদ্য, আশ্রয়ের ব্যবস্থা, ঔষধপত্র, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট পরিষ্কার প্রভৃতির কাজ সম্পন্ন করা হয়।
হেলিকপ্টার, স্পিডবােট নামিয়ে দুর্গতদের উদ্ধার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ঝড় বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করেছিলেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি বেশ কিছু খ্যাতনামা ব্যক্তিগণ আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন। দুর্গতদের সাহায্যার্থে এবং পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এবং যথা সম্ভব সাহায্য করেছেন।
কলকাতা শহরের ত্রাণ সহায়তা ইত্যাদি করে অবস্থা স্বাভাবিক করতে সময় লেগে গিয়েছিল ৫-৬ দিন, সেখানে উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষেত্রে কতটা সমস্যা হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রশাসনিক উদ্ধারকারীরা বহু মানুষকে সাহায্য করেছিল এবং তাদের খাদ্য ও পানীয়ের সমস্যা দূর করতে সহায়তা করেছিল, নাহলে হয়তো বহু মানুষ না খেয়েও মারা যেত।
উপসংহার, Conclusion
২০২০ সাল-এর করােনা পরিস্থিতিতে আমফান ঘূর্ণিঝড় সকলের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর কারণ তখন দেশের মানুষ মহামারীর প্রভাবে জর্জরিত তো ছিলই তার উপর প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমফান। এই আমফান ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা প্রাণহানি, শস্যহানি, ক্ষয়ক্ষতি, আতঙ্ক, ভয় , নিরাশ্রয়তা এবং অনেকের সর্বস্ব হারানাের স্মৃতিতে ভরপুর হয়ে থাকবে। বাংলার বুকে থাবা বসানো এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ছিল আস্ফান। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ সবাইকে মনে করিয়ে দেয় যে, “প্রকৃতি যেমন নির্মাতা তেমনি ধ্বংসকারী।”