তোমরা সকলেই হয়তো আমাকে দেখেছ। আমি হলাম এক প্রাচীন বট গাছ। আমার মত আরো হয়তো এমন বহু বট গাছ তোমাদের চোখে পড়েছে যেগুলো বছর বছর ধরে একইভাবে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তোমরা কখনও হয়তো এটা ভেবে দেখনি যে আমার মত একটি প্রাচীন বট গাছ কত অতীতের অভিজ্ঞতা জমিয়ে রেখেছে নিজের মধ্যে। তোমাদের অজানা কত সংগ্রামের পর আজ আমাদের এই বিশাল অস্তিত্ব। আমি নিজের আশপাশে ঘটে যাওয়া না জানি কত ঘটনার সাক্ষী। আজ আমার নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের আত্মকথা বলবো।
আমার বয়স, My age
কথায় আছে, বটগাছের বয়স নাকি মনে রাখতে নেই। তাই আমি নিজের বয়স মনে রাখিনি। জন্মের পর থেকে আশপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর হিসেব রাখতে রাখতে নিজের বয়সের হিসেব আজ বহুকাল ধরে রাখতে পারিনি। প্রতিটা গ্রীষ্মে কত যে শ্রান্ত পথিক কে আমি আশ্রয় দিয়েছি নিজের শীতল ছায়ায়, বর্ষায় একই দিনে বহুবার স্নান করেছি, বছর বছর ধরে শরৎ কুয়াশা আমায় স্নিগ্ধতা দিয়েছে, শীত আর বসন্তের বাতাস আমার শরীর ঘিরে প্রতিবার বয়ে গেছে। আজ আমি বয়সের ভারে জীর্ণ এক দীর্ঘাঙ্গী বট। আজ আমি স্মৃতিচারণায় বলে যাব আমার এই দীর্ঘ জীবনের গল্প।
আমার জন্ম, My birth
সময়ের জ্ঞান আমার নেই, তবে আমার যখন জন্ম হয় তখন চারপাশ ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। জন্ম থেকে ধীরে ধীরে চারপাশের পৃথিবীর বদলাতে থাকা রূপ দেখেছি। যেদিন আমার জন্ম হয় সেদিন বৃষ্টি ছিল মুষলধারে। দেখলাম অন্য আরেকটা গাছ তখন আমার মাথার উপর ছাতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরে জানতে পেরেছিলাম যে সেটা ছিল একটি কদম গাছ। সেদিন সে আমায় একটুও ভিজতে দেয়নি। আমার থেকে একটু দূরে ছিল বড় একটা দীঘি।
তাতে শালুক আর পদ্ম ফুটতো। দীঘির ওপাড়েও ছিল অরণ্যে ভরা। সুদূর প্রান্তর থেকে বয়ে আসত স্নিগ্ধ বাতাস; চারপাশে ভাসতো মিষ্টি ফুলের সুগন্ধ, আমার চারধারে সারাদিন ধরে মৌমাছি প্রজাপতি ফড়িং খেলা করে বেড়াতো; ধরিত্রীর বুকে দাঁড়িয়ে এমন মনোরম পরিবেশে ক্রমে আমি নিজের শিরা-উপশিরা বিছিয়ে দিতে শুরু করলাম, এভাবেই একটু একটু করে আমি বড় হতে লাগলাম।
চারপাশের পরিবর্তন, Changes around
আমি যখন একটু বড় হয়েছি; তখন একদিন দেখি আমার থেকে কিছু দূরে, একদল মানুষ জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। সেদিন মনে খুব ভয় হয়েছিল, ধারালো অস্ত্রের কোপ আমার গায়েও যদি পড়ে ! কিন্তু না অন্য সব গাছ কেটে নিয়ে গেলেও আমি রয়ে গেলাম, একটিও চোট পড়েনি আমার গায়ে। তারপর আমার চারপাশে মানুষ ঘর বানিয়ে বাস করতে শুরু করে, আমার সামনে দিকে একটি রাস্তা তৈরি হয়, এই পথেই কখনো হেঁটে আবার কখনো গরুর গাড়ি করে মানুষ আসা যাওয়া করতে শুরু করলো। প্রায়ই দেখতাম, ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে পালকি।
যখন আমি খানিক শক্ত সমর্থ হয়েছি; তখন থেকে আর বাতাসও আমায় টলাতে পারে না, যত জোরে আসুক না কেনো। আমার বড় ডাল থেকে আরো শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করেছি, অল্প অল্প করে তাতে সবুজ রঙের ছোট ছোট পাতা গজিয়েছে। আমার ডালে ক্রমে রংবেরঙের পাখি এসে ভিড় জমায়, গান গায়, খেলা করে। আমার শরীর থেকে ঝরে পড়া ছোট ছোট ডালপালাগুলো নিয়ে গিয়ে তারা আমারই শাখা-প্রশাখায় বাসা বাঁধছে। সেই বাসাগুলোতে পাখিদের ডিম রাখা থাকতো, যা আমি নিজের ডালে থাকা পাতা দিয়ে সযত্নে আগলে রাখতাম। তারপর সেই ডিমগুলো ফুটে যেদিন ছোট্ট ছোট্ট ছানা বের হতো, আমার মনটা যেন আনন্দে ভরে উঠতো।
সময়ের সাথে সাথে মনে হল যেন চারপাশে লোকের আনাগোনা বাড়ছে দিনের পর দিন। যাওয়া-আসার পথে অনেকেই আমার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিত। তাদের ব্যস্ত-সন্ত্রস্ত জীবনে আমার শীতল ছায়াতে তারা শান্তি খুঁজে পেত। কিছুদিনের মধ্যেই আমার চারপাশ আর আগের মত রইলো না। চারিদিক ধীরে ধীরে একটা ছোট গ্রামের চেহারা নিয়েছে।
এরপর থেকে ক্রমে একের পর এক বছর পেরিয়ে যাচ্ছে আর আমি আমার চারপাশকে ধীরে ধীরে আরো ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখেছি, আরো দেখেছি যে মানুষ নিজের বাসস্থান হিসেবে ছোট-বড়ো বাড়ি গড়ে তুলছে। এখন আরেকটি পরিবর্তনও লক্ষ্য করেছি যে পালকি আর তেমন দেখা যায় না আজকাল। যানবাহনের ধরনও বদলে যাচ্ছে।
কালবৈশাখী ঝড়ের অভিজ্ঞতা, My experience of kal Baisakhi
প্রত্যেক গ্রীষ্মকালে কম বেশি ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছি আমি। তবে একবারের ঝড় ছিল ভয়ঙ্কর। কোন এক গ্রীষ্মকালের বৈশাখ মাসের পড়ন্ত বিকেলের কথা বলছি, সেদিন কেমন জানি গুমোট গরম পড়েছিল। সাধারণত অন্যদিন বিকেলে আমার আশেপাশে অনেক লোকজন বেড়াতে আসে, শিশুরা খেলা করে, অনেকে আমার নিচে বসে বসে গল্প করে। কিন্তু সেই দিনের পথঘাট ছিল একেবারে জনমানব শূন্য।
সারাদিন ধরে এতটাই গরম ছিল যে একটি পাতা নাড়ানোরও সামর্থ্য আর আমার নেই। হঠাৎ দেখলাম আকাশে কালো মেঘ ভেসে চারিদিকে অন্ধকার করে তুলেছে, শুরু হল মেঘের গর্জন, তেড়ে এলো তুমুল ঝড়। সেই প্রবল ঝড়ের মধ্যেও মাথা তুলে কিভাবে যে ধরিত্রীর বুক সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে নিজের আব্রু
বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেটা একমাত্র আমিই জানি। এমন সময় দেখতে পেলাম অনতিদূরে থাকা জাম গাছটা হুড়মুড় করে পড়ে গেলো। আরো দেখলাম দিঘির ধারে থাকা শিমুল গাছের একটা মস্ত ডাল ভেঙে পড়লো দীঘির জলে। কি জানি কোথা থেকে কয়েকটা কাপড়, ছাতা, ছনের টুকরো ঝড়ের দমকা হাওয়ায় উড়ে এসে আটকে গেল আমার ডালগুলোতে। সেই ঝড়ের কবলে পড়ে শত চেষ্টা করেও আমার শাখা-প্রশাখায় থাকা পাখির বাসাগুলো এবং তাতে রাখা পাখিদের ছোট ছোট ডিমগুলোকে আর বাঁচাতে পারিনি। ঝড় শেষ হতে না হতেই বৃষ্টি নামল মুষলধারায়।
যে গাছগুলো প্রবল বাতাসে ভেঙে পড়েছিল সেইখানকার সকল পাখিগুলো এসে আশ্রয় নিল আমার ডালে, তাদেরকে পাতা দিয়ে আড়াল করে রাখলাম যেন তাদের কোনো কষ্ট না হয়। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি ও ঝড় থামলো, দেখি চারিদিকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে আছে উপড়ে পড়া গাছগুলো, নাম-না-জানা বহু পাখির মৃতদেহ পড়ে আছে গাছের পাশে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় তথা ভীতিপ্রদ অভিজ্ঞতা ছিল।
বর্তমান কালের অবস্থা, My present condition
আজকাল কেনো জানিনা আগের তুলনায় গরম পড়ে বড় বেশি। কিন্তু বৃষ্টি খুব কম হয়। আমার চারপাশে আমার অন্য বন্ধু গাছগুলো আগের থেকে আরো কম হয়ে এসেছে। কিন্তু আমি সময়ের সাথে আরো দীর্ঘ হচ্ছি। আমার আকার এখন এতই বিশাল যে নিচে কেউ দাঁড়ালে আজকাল আর আকাশ দেখতে পায় না।
আমার বিভিন্ন কান্ড থেকে নিচের দিকে নেমে গেছে বড় বড় ঝুরি। রোজ বিকেলে শিশুদের দল আমায় ঘিরে লুকোচুরি খেলে, আমার ঝুলে থাকা ঝুরিগুলো ধরে দোল খায়, দুপুরে শ্রান্ত ক্লান্ত পথিকদেরকে আজও আমি শীতল ছায়া দেই, এই ছায়ায় তারা দু’দণ্ড বিশ্রাম নিয়ে যায়। আমি বড় হওয়ার পর থেকে যে বিষয়টা এখনও বদলায়নি সেটা হল, সুপ্ত কোন মনোবাঞ্ছা পূরণের আশায় পরম বিশ্বাসে আমায় পুজো করে আমার শরীরে লাল সুতো বেঁধে দেওয়ার রীতি।
আজও যখন কেউ এসে আমার কাছে নিজের মনের বাসনা জানিয়ে সুতো বেঁধে দেয়, তখন আমিও ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যেন তাদের সকল আশা পূরণ হয়।
উপসংহার, Conclusion
আমার দীর্ঘ জীবনের সংক্ষিপ্তসার বলে দিলাম। অনেকের কাছে হয়তো আমার জীবন কাহিনী একঘেয়ে মনে হবে। তবে আমার নিজের কখনো এমনটা মনে হয় না, কারণ জন্ম থেকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে, আমি সময়ের যে ওঠাপড়া দেখেছি, সে অভিজ্ঞতা হয়তো আর কারো নেই। যেসব মানুষ জীবনের চাহিদা অর্জনে প্রতিনিয়ত দৌড়ায়, তাদেরকে আমি ছায়া দিয়েছি, নিরীহ পাখিকুলকে খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিল। এসবের মধ্যে দিয়েই যেন আমার জীবনের সার্থকতা।