বিজ্ঞাপনের সুবিধা ও অসুবিধা, Advantages and Disadvantages of Advertising in Bengali

বিজ্ঞাপনের সুবিধা ও অসুবিধা

বর্তমানের আধুনিক যুগে মানুষের জীবন বেশকিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আবর্তিত হয় বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে। বিজ্ঞাপন আজ কোন না কোনভাবে পৌঁছে গিয়েছে মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। এককথায় বিশ্বায়নের যুগে বিজ্ঞাপন সর্বব্যাপী বিস্তৃত। তবে এই বিস্তারের বেশ কিছু কুফলও দেখা হয়। বিজ্ঞাপনের এই সর্বব্যাপী বিস্তারের প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো আমাদের আজকের এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমে।

মানব জীবনে বিজ্ঞাপনের প্রভাব, Effects of advertisements on human life

বর্তমান যুগে মানব জীবনের এক অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন ছাড়া বর্তমান যুগে মানব জীবন প্রায় অচল। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক জীবনের অসংখ্য সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে। বলাই বাহুল্য মানুষের জীবনে বিজ্ঞাপনের এই ব্যাপক প্রভাব একদিনে আসেনি। বরং সুদীর্ঘ কালের ইতিহাস তথা বিজ্ঞাপনের বিবর্তনের কাহিনী রয়েছে এর পেছনে।

বিজ্ঞাপন কি? What is advertisement?

বিজ্ঞাপনের ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগে বিজ্ঞাপন কি তা জেনে নেওয়া ভালো। আপনাদের মনে কি কখনো প্রশ্ন এসেছে যে বিজ্ঞাপনের মূল ভিত্তি আসলে কি! বিজ্ঞাপনের প্রকৃত সংজ্ঞা লুকিয়ে আছে তার উদ্দেশ্যের অন্তরালে। তবে একথা আমরা সকলেই জানি যে বিজ্ঞাপনের প্রকৃত ও প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো প্রচার।

বিজ্ঞাপন কি?

প্রয়োজন অনুসারে কোনো বিষয়কে পূর্বনির্ধারিত জনগণ বা টার্গেট অডিয়েন্স-এর মধ্যে প্রচার করার উদ্দেশ্যে প্রাথমিকভাবে যে মাধ্যমটিকে বেছে নেওয়া হয় তা হল বিজ্ঞাপন। জন মনে আগ্রহ জাগিয়ে তুলে বিজ্ঞাপন নির্দিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। সেই আগ্রহ মানুষকে নির্দিষ্ট কিছু বস্তু কিনতে উদ্বুদ্ধ করে, আবার কখনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ দেয়। বিজ্ঞাপন ব্যক্তিকে বস্তুর গুণ, মান, ব্যবহার প্রণালী, স্থায়ীত্ব ডুবে থাকা প্রভৃতি ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে।

বিজ্ঞাপনের ইতিহাস, History of advertisement

 বিজ্ঞাপনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। বিজ্ঞাপনের সূত্রপাত আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে হয়। তবে আগেকার সময়ের বিজ্ঞাপনের চরিত্র বর্তমান যুগের মত ছিল না। মেসোপটেমিয়া, মিশরীয় কিংবা চৈনিক সভ্যতার মত বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতাগুলির ক্ষেত্রে সিলের বা প্যাপিরাসের উপর বিভিন্ন বিজ্ঞাপনগুলি লেখা হতো।

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপনগুলি শাসকগোষ্ঠী অনুমোদিত বিজ্ঞপ্তিনামা ছিল। এছাড়াও বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের উদাহরণও পাওয়া গেছে। রোমান সভ্যতা কিংবা গ্রিক সভ্যতাতেও বিজ্ঞাপনের নিদর্শন পাওয়া যায়। সেই সময়কালে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপনের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। তখনকার সময়ে ধনী মানুষকে ক্রীতদাস কেনাবেচাতে বিজ্ঞাপন দ্বারা উৎসাহিত করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এই সময় বিজ্ঞাপনগুলি তৈরি করা হতো পাথরের গায়ে, বাড়ির দেওয়ালে।

বিজ্ঞাপনের ইতিহাস

বিজ্ঞাপন ও আধুনিক জীবন, Advertising and Modern Life

আধুনিক যুগে বিজ্ঞাপন আমাদেরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য করছে। আমরা খুব সহজেই জানতে পারছি যে কখন কোথায় কী হচ্ছে, যেমন কোনো রাজ্যের বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন, কোনো কোচিং সেন্টারের উদ্বোধন, কোনো ঐতিহ্যবাহী মেলা, সরকারি অনুষ্ঠান, কোনো বিশেষ ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ছাড় সম্পর্কে, অথবা কারও নতুন ব্যবসার শুরু সম্পর্কে।

এক কথায় ঘরে বসেই বিভিন্ন লেনদেনের সম্পর্কে জানতে পারছি আমরা, তবে শুধু লেনদেনই নয় আরো বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞাপন দেখে আমরা বুঝতে পারছি কোথায় কি হচ্ছে। তাই বলা যায় যে বিজ্ঞাপন বর্তমান যুগে নিজের পরিধিকে বিস্তার করার মধ্য দিয়ে এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যেখানে বর্তমান বাজার অর্থনীতি কেন্দ্রিক বিশ্বের সকল ক্ষেত্র স্পর্শ করতে পারছে। যখনই বাজারে কোন নতুন সামগ্রী আসে, তা বিজ্ঞাপনের প্রচারের মাধ্যমেই সেই পণ্য সম্পর্কে জানতে পারে মানুষ। তাছাড়া বিজ্ঞাপন প্রচার মাধ্যমগুলোর কাছে মোটা অর্থ আয় হিসেবে আসে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন থেকে।

তাই বিজ্ঞাপনের উপর বহু মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল। বিজ্ঞাপন প্রচার করার মাধ্যম হিসেবে দেয়ালে লেখা, হ্যান্ডবিল-লিফলেট ছাপানো, পোস্টার সেঁটে দেওয়া, হোর্ডিং, ফেস্টুন ইত্যাদি তৈরি করে জীবিকা অর্জন করছে বেশ কিছু লোক। এছাড়াও পত্র-পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগে ও বেতার, টেলিভিশন ইত্যাদিতে প্রচারিত বিজ্ঞাপন কার্যক্রম রূপায়ণেও কর্মরত আছেন অনেকেই।

বিজ্ঞাপন ও আধুনিক জীবন

এইভাবে ব্যাপক বিস্তার তথা প্রসারের মধ্য দিয়ে বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞাপন রীতিমত এক ইন্ডাস্ট্রির পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, যার ফলে আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞাপনকে ব্যবহার করে বাজারে বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করা যাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে মানুষও যথেষ্ট প্রভাবিত হচ্ছে। বলাই বাহুল্য যে আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞাপনের বহুমুখী চরিত্র এবং মানব জীবনে এর প্রভাব ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

বিজ্ঞাপনের সুফল ও কুফল, Advantages and Disadvantages of Advertising

সবকিছুর ক্ষেত্রেই যেমন ভালো এবং খারাপ দুই দিক রয়েছে তেমনি বিজ্ঞাপনেরও নির্দিষ্ট কিছু সুফল ও কুফল রয়েছে।

বিজ্ঞাপনের সুফল ও কুফল

এক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় বিজ্ঞাপন প্রচারের সুফল সম্পর্কে।

  • একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে বিজ্ঞাপনকে ব্যবহার করে যেভাবে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা যায় তা এক কথায় অতুলনীয়। 
  • সাধারণ মানুষের সঙ্গে নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের সংযোগ স্থাপন করার কাজে বিজ্ঞাপনের জুড়ি মেলা ভার।
  • বিজ্ঞাপন বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচার-প্রসারে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। 
  • বর্তমান সময়ে বিজ্ঞাপন একটি সার্বিক ইন্ডাস্ট্রির পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, যার দরুন অসংখ্য মানুষ শুধুমাত্র এই বিজ্ঞাপন তৈরির কাজের ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

তবে উল্লেখ্য সুফলগুলোর পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের বেশকিছু কুফলও রয়েছে। সেগুলি হল :

  • বর্তমান যুগে জীবনযাত্রা বেশি মাত্রায় বিজ্ঞাপনকেন্দ্রিক হয়ে ওঠার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন অসাধু উদ্দেশ্যেও বিজ্ঞাপনকে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে। 
  • বিজ্ঞাপনের আকর্ষণীয় উপস্থাপনা বিভিন্ন সময়ে মানুষকে বেশ কিছু ক্ষতিকর জিনিস কিনতেও উৎসাহিত করছে। 
  •  বিজ্ঞাপন কিছু ক্ষেত্রে ধর্ম বৈষম্য, শ্রেণী বৈষম্য, বর্ণ বৈষম্য ইত্যাদির মতো বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। 
  • বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলির উপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থাকেনা, ফলে নিজেদের অভীষ্ট লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংস্থাগুলো বিজ্ঞাপন দ্বারা সমগ্র সমাজকে হীনপথে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।

বিজ্ঞাপনের ভবিষ্যৎ, Future of adverisement

বিজ্ঞাপনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে উত্তরাধুনিক যুগে বিজ্ঞাপনের সাথে তথ্যপ্রযুক্তির যে মেলবন্ধন ঘটেছে, তা নিয়ে কথা না বললে আধুনিক জীবনে বিজ্ঞাপন বিষয়ক আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমরা সকলেই লক্ষ্য করছি যে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আজকের যুগে মানুষের সামাজিক চিন্তাধারায় আমুল বিবর্তন ঘটেছে, বিজ্ঞাপনও সেই বিবর্তন থেকে বাদ পড়ে যায় নি।

বিজ্ঞাপনের ভবিষ্যৎ

বিজ্ঞাপন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় আজ ইন্টারনেটের ব্যবহারে বিবর্তিত হয়েছে, তাই এখন এই বিজ্ঞাপনই যেন ঠিক করে দিচ্ছে মানুষ কি খাবে, কী দেখবে, কি পরবে এমনকি কিভাবে চিন্তা করবে। একথা আলাদা করে বলার কিছু নয় যে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষত ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়েই বিবর্তিত হয়েছে, সাথে বিজ্ঞাপনী মাধ্যমকেও যুক্ত করেছে এই বিবর্তনের ধারায়।

গুগল কিংবা বিং এর মতন সার্চ ইঞ্জিনগুলি বর্তমানে বিজ্ঞাপনের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, অপর স্তম্ভটি হল ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া, আর এই দুটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করেই বিকশিত হচ্ছে ভবিষ্যতের বিজ্ঞাপনী মাধ্যম। 

উপসংহার, Conclusion 

মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে বিজ্ঞাপনকে আর পৃথক করে হয়তো কখনোই দেখা যাবে না। বিজ্ঞাপনের সর্বব্যাপী প্রসার মানুষের স্বাভাবিক জীবনকেন্দ্রিকতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগিয়ে তোলে, কারণ মানব জীবনকে যদি শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তাহলে তো সবাই চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে এবং বাজার অর্থনীতির দাসানুদাস হয়ে যাবে। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটির কথা চিন্তা করে আধুনিক জীবন ও বিজ্ঞাপনের মধ্যে উপযুক্ত ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করা উচিত।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts