‘আয় আয় চাঁদ মামা টি দিয়ে যা’— এই ছেলে ভুলানো ছড়া- র মধ্য দিয়ে দেশের প্রায় সব শিশুই হয়তো চাঁদ কে মামা বলে মনে করতে শুরু করে দেয়। কিন্তু এই মামা কতদূরে, কি করছে, কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে, এসব কিছুই হয়তো জানি না আমরা। কিন্তু এখন হয়তো আর কিছুই অজানা থাকবে না, কারণ ভারত চাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, কেননা চন্দ্রযান ৩ চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ করে নিয়েছে।
চন্দ্রযান ৩, ভারতের এক অসাধারণ সাফল্যের নজির হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। ভারতের এই বিজয়কে স্মরণ করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২৩ আগস্ট তারিখটি প্রতি বছর জাতীয় মহাকাশ দিবস হিসেবে পালিত হবে বলে ঘোষণা করেন। ISRO-এর কঠোর পরিশ্রম এর ফলস্বরূপ চাঁদে চন্দ্রযান ৩-এর সফট-ল্যান্ডিং নিয়ে প্রত্যেক ভারতীয় গর্বিত!
চন্দ্রযান ৩ এর উদ্দেশ্য কি ? What is the purpose of Chandrayaan 3?
ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ISRO) চন্দ্রযান ৩-এর মাধ্যমে বিক্রম ল্যান্ডার এর চাঁদের পৃষ্ঠে সফল অবতরণ অর্জনের জন্য প্রকল্পটি শুরু করেছিল। চন্দ্রযান ৩-এর প্রধান উদ্দেশ্য হল নিরাপদে চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ করা। উক্ত প্রকল্প চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে অবতরণকারী প্রথম মহাকাশ অভিযানে পরিণত হয়েছে।
চন্দ্রযান ৩-এ একটি ল্যান্ডার মডিউল (LM), একটি প্রপালশন মডিউল (PM) এবং একটি রোভার ছিল। ল্যান্ডার এর নাম দেওয়া হয় বিক্রম, আর রোভার এর নাম রাখা হয় প্রজ্ঞান। সৌর-চালিত রোভার প্রজ্ঞান চন্দ্র পৃষ্ঠের বিভিন্ন বিষয় অনুসন্ধান করবে এবং পৃথিবীতে ডেটা প্রেরণ করবে।
চন্দ্রযান-1 এবং চন্দ্রযান-2-এর পরে, চন্দ্রযান ৩ ভারতের প্রযুক্তিগত দক্ষতা সারা বিশ্বে প্রদর্শন করতে উৎসুক ছিল। চন্দ্রযান-১ এবং চন্দ্রযান-২ এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চন্দ্রযান-৩ ভারতের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী তথা সফল চন্দ্র অভিযান। চন্দ্রযান ৩ মিশনটি চাঁদের ভূতত্ত্ব, খনিজবিদ্যা এবং এক্সোস্ফিয়ার অধ্যয়নের করে চাঁদের উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে বোঝার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখবে।
ইসরো এর পূর্বের ভুল সমূহ, Previous mistakes of ISRO
চন্দ্রযান ৩ এর পূর্বে ২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২ এর ল্যান্ডারটি চাঁদের মাটিতে অবতরণ করার কথা ছিল। কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে শেষ মুহূর্তে ল্যান্ডার থেকে বিক্রম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চন্দ্রযান-২ এর ব্যর্থতা থেকে ভারতের বিজ্ঞানীরা নিজেদের প্রকল্পে থাকা ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টায় লেগে পড়েন, এক কথায় ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে সকলে মিলে চন্দ্রযান-৩ এর জন্য কাজ শুরু করে দেন। তবে চন্দ্রযান-২-এর মিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নি, আংশিক সাফল্য পাওয়া গেছে সেই প্রকল্পে, কারণ এর অরবিটর এখনও সক্রিয় রয়েছে বলেই বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
চন্দ্রযান ৩ উৎক্ষেপণের তারিখ ও সময়, Chandrayaan 3 launch date and time
২০২৩ সালের ১৪ ই জুলাই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে চন্দ্রযান ৩ উৎক্ষেপণ করা হয় এবং চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণের মিশন সফলভাবে চালু হয়।
চন্দ্রযান ৩ এর সাথে যুক্ত বিজ্ঞানী, Scientists associated with Chandrayaan 3
চন্দ্রযান ৩-এর পরিকল্পনা ও উন্নয়নের সাথে যুক্ত প্রধান বিজ্ঞানীদের নামগুলি হল : এস সোমানাথ, ইসরো চেয়ারম্যান; পি ভিরামুথুভেল, চন্দ্রযান ৩ এর প্রকল্প পরিচালক; এস উন্নিকৃষ্ণান নায়ার, বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার (ভিএসএসসি) এর পরিচালক, এ রাজারাজন, লঞ্চ অথরাইজেশন বোর্ড (ল্যাব)এর চেয়ারম্যান, এবং এম শঙ্করন, ইউ আর রাও স্যাটেলাইট সেন্টার (ইউআরএসসি) এর পরিচালক,।
চাঁদে অবতরণ- এ সাফল্য অর্জনকারী অন্য দেশ, Other countries to achieve success in landing on the moon
ভারতের পূর্বে চাঁদে সফল অবতরণ করা সফল দেশগুলো হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন। উক্ত দেশগুলো সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করেছিল। চন্দ্রযান ৩ এর সফল অবতরণের মাধ্যমে ভারত সেই তালিকার চতুর্থ দেশ হিসেবে গণ্য হবে।
চন্দ্রযান ৩ কবে চাঁদে পৌঁছায়, When did Chandrayaan 3 reach the moon?
চন্দ্রযান ৩ এর মডিউলটি উৎক্ষেপণ করার সময় এর পর থেকে চাঁদে পৌঁছাতে প্রায় এক মাস সময় নেবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট, বিকাল ৫ টা বেজে ২০ মিনিট এ চাঁদের পৃষ্ঠে চন্দ্রযান ৩ অবতরণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। চন্দ্রযান ৩ নির্ধারিত দিনেই ৬ টা নাগাদ চাঁদে অবতরণ করেছিল।
চন্দ্রযান ৩ এর প্রযুক্তিগত দিক, Technical aspects of Chandrayaan 3
ISRO এর লাইভ সম্প্রচার এর মাধ্যমে আমরা সকলেই দেখেছি সোনায় মুড়ে প্রায় চার লক্ষ কিমি. দূরে গেছে ভারতের চন্দ্রযান-৩। তবে এই সোনা আসলে পলিমাইড ও অ্যালুমিনিয়ামের একটি মিশ্র ধাতু, যন্ত্রটির সামনের দিকটায় রয়েছে পলিমাইড পদার্থ এবং পেছনের দিকে অ্যালুমিনিয়াম।
‘বিক্রম’ ও ‘প্রজ্ঞান’ কে সচল রাখার জন্য এবং সূর্যের বিকিরণ থেকে রক্ষা করার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, নয়তো মহাজাগতিক রশ্মির ঝড়- ঝাপটায় যন্ত্রগুলি গরম হয়ে বিকল হয়ে পড়বে। রোভারটি ২৬ কেজি ওজনের এবং ৬ টি চাকাযুক্ত।
মহাকাশযানের বৈশিষ্ট্য, Characteristics of spacecraft
- প্রস্তুতকারক সংস্থা : ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)
- উৎক্ষেপণ ভর : ৩৯০০ কেজি
- পেলোড ভর : প্রপালশন মডিউল: ২১৪৮ কেজি, ল্যান্ডার মডিউল (বিক্রম): ১৭২৬ কেজি, রোভার (প্রজ্ঞান): ২৬ কেজি,
- ক্ষমতা : প্রপালশন মডিউল: ৭৫৮ ওয়াট, ল্যান্ডার মডিউল: ৭৩৮ ওয়াট, রোভার: ৫০ ওয়াট।
চন্দ্রযান-৩ এর অর্থায়ন, Financing of Chandrayaan-3
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে, ইসরো চন্দ্রযান-৩ প্রকল্পটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এর নিকট প্রাথমিক অর্থায়নের জন্য অনুরোধ করে, যার পরিমাণ ছিল ৭৫ কোটি। এই অর্থের মধ্যে ৬০ কোটি টাকা যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামাদি ও অন্যান্য ব্যয়ের জন্য ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে এবং বাকি ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব ব্যয়ের জন্য চাওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ইসরো সভাপতি কে. সিভান জানান যে উক্ত অভিযানে প্রায় ৬১৫ কোটির কাছাকাছি ব্যয় হয়েছে।
কক্ষপথ থেকে চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ, Landing from orbit to the surface of the Moon
চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলটির ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকরা অনুসন্ধানের বিশেষ আগ্রহ রাখে, কারণ উক্ত পৃষ্ঠটি পৃথিবী থেকে দেখা যায় না। চন্দ্রযান-৩-এর উৎক্ষেপণের জন্য এলভিএম৩-এম৪ রকেট ব্যবহার করা হয়, যার ওজন ছিল ৬,৪২,০০০ কেজি এবং উচ্চতা ৪৩.৫ মিটার ছিল। চন্দ্রযান-৩ ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট তারিখে ১,৮৩৫ সেকেন্ডের প্রচেষ্টায় চাঁদের ১৬৪ কিমি X ১৮০৭৪ কিমি কক্ষপথে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল।
১৭ই আগস্ট ল্যান্ডার মডিউলকে সফলভাবে প্রপালশন মডিউল থেকে আলাদা করা হয়েছিল। অবতরণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বিক্রমের গতি ১,১৫০ মিটার প্রতি সেকেন্ডে কমিয়ে আনা হয়েছিল, যাতে অবতরণে কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ের অবতরণ প্রক্রিয়া ১৯ মিনিট ধরে চলেছিল। অবতরণ স্থলের চন্দ্র স্থানাঙ্ক ছিল ৬৯.৩৬৭৬২১° দক্ষিণ অক্ষাংশ ও ৩২.৩৪৮১২৬° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।
সম্ভাবনা, Possibility
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, চন্দ্রযান ৩ এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ফলে চাঁদ পৃথিবীতে শক্তির চাহিদা মেটাবে, হয়তো একসময় শক্তির প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে কয়লা বা প্রাকৃতিক গ্যাস এর প্রয়োজন আর হবে না। চাঁদের শক্তির প্রভাবে পৃথিবী উষ্ণায়নের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আগামী ৩০ বছরের মধ্যেই এইসব ঘটতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে, কেননা আমাদের পৃথিবীতে ৫ হাজার কিলোগ্রাম ওজনের কয়লা পোড়ালে যতটা শক্তি উৎপাদন হয়, চাঁদের মাত্র ৪০ গ্রাম হিলিয়াম মৌল থেকেই ততটা শক্তি তৈরি হবে।
সূর্যের হিলিয়াম-৩ মৌলটি পৃথিবীর পুরু বায়ুমণ্ডলে বাধা পেয়ে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছায় না, কিন্তু চাঁদে বায়ুমণ্ডল না থাকার ফলে সূর্য থেকে আসা হিলিয়াম-৩ মৌল অবিকৃতই থেকে যায় চাঁদের পৃষ্ঠে। ইতিপূর্বে চাঁদে আমেরিকা থেকে যতগুলি ‘অ্যাপোলো’ মিশন পাঠানো হয়েছিল, তাদের সকলেরই লক্ষ্য ছিল, পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহে উক্ত তেজস্ক্রিয় মৌলগুলি সন্ধান ও সেগুলি কী পরিমাণে রয়েছে তাঁর খোঁজখবর নেওয়া।
উপসংহার, Conclusion
চাঁদের রহস্য উদঘাটনে ভারতের দৃঢ় সংকল্প রূপে তৈরি করা হয় চন্দ্রযান ৩ মিশন। সতর্ক পরিকল্পনা এবং শক্তিশালী আকৃতির মাধ্যমে, চন্দ্রযান ৩ আমাদের চাঁদে অবতরণ এবং এর গোপন রহস্য আবিষ্কারের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে।
চন্দ্রযান-৩-এর মাধ্যমে, ভারতের লক্ষ্য ছিল দেশের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা এবং মহাকাশ অনুসন্ধানে নিজের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করা। চন্দ্রযান-৩ এর সফলতা বিশ্বব্যাপী মহাকাশ সম্প্রদায়ে ভারতের অবস্থান আরও মজবুত করে তুলেছে। চন্দ্রযান ৩ মিশন ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।