শিশুশ্রম আজকের দিনে এমন একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে শিশু শ্রমিকের হার দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত বহু পরিবারের সন্তানরা দুবেলা দুমুঠো ভাত মুখে দেওয়ার জন্য প্রায় নিরুপায় হয়ে গিয়ে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। তাই সময়ের সাথে শিশুশ্রম এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
শিশু কারা ? Who are children?
শিশুশ্রম বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের জানতে হবে যে কাদের শিশু বলা হয়। শিশুদের বয়স নির্ধারণে বিভিন্ন দেশে মতানৈক্য রয়েছে। তবে জাতিসংঘ শিশু সনদে উল্লেখ করা আছে যে ১৮ বছরের কম বয়সি সকলকে শিশু ধরা হয় , অর্থাৎ জাতিসংঘে প্রযোজ্য আইন ও নীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ছেলেমেয়েকে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শিশুশ্রমের পরিণতি দেখে একে একটি সামাজিক ব্যাধি বলে মনে করা হয়। সমাজে শিশুশ্রমের পরিণতি হল :
- শ্রমের সাথে যুক্ত শিশুর শৈশব নষ্ট হওয়া,
- শিশুদের অপুষ্টি,
- শ্রম ক্ষেত্রে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন,
- দেশে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য,
- শিশু শ্রমের ফলে সামাজিক বিকাশের অভাব,
- দেশের বিভিন্ন অংশে শিশুশ্রমের অব্যাহত উপস্থিতি এবং শোষণ দেশের অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
- উক্ত কারণগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে শিশুদের পড়ালেখা হচ্ছে না, ফলে দেশ অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে।
শিশুশ্রম কেন ক্ষতিকর? Why is child labor harmful?
জাতিসংঘ শিশু জরুরি তহবিল (ইউনিসেফ) শিশুশ্রমকে এমন এক কার্যকলাপ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে, যা একটি শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এই সঙ্গে আরও বলা হয়েছে যে, শিশুশ্রম হল এমন একটি কাজ, যা শিশুদেরকে তাদের শৈশবের বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত করে দেয়। অন্যদিকে শ্রম ক্ষেত্রে শাসকরা তাদের শোষণ করার মাধ্যমে বিভিন্ন অসামাজিক কাজের জন্য শিশুদের অপব্যবহার করে।
একটি বিষয় হয়তো সকলেই লক্ষ্য করে থাকবেন যে শিশুশ্রম শিক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিশুদেরকে স্কুলে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেয় এবং দেশের দারিদ্র্যের আন্তঃপ্রজন্ম চক্রকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। বলা যেতে পারে যে শিশুশ্রম শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি প্রধান বাধা, যা বিদ্যালয়ে উপস্থিতি এবং কর্মক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। তাছাড়া শিশুশ্রম ও শোষণের অব্যাহত অধ্যবসায় আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই শিশুশ্রমকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে না।
শিশুশ্রমের প্রধান কারণ কি, main cause of child labour
দেশে শিশুশ্রম অব্যাহত থাকার বহু কারণ রয়েছে। এই কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :
দারিদ্র্য :
দেশে দরিদ্রতা অধিক পরিমাণ হওয়ার ফলে বহু পরিবার নিজের সন্তানদেরকে কাজে যাওয়ার জন্য বাধ্য করে তোলে, কারণ দিনমজুরদের ক্ষেত্রে সাংসারিক খরচ সামলানো কষ্টকর, তাই তারা নিজের ছেলেমেয়েদেরকেও শ্রমের জন্য পাঠান যাতে সকলে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পারে।
শিক্ষার সুযোগের অভাব :
আজকালের বহু শিক্ষাক্ষেত্র বেসরকারীকরণ হচ্ছে, আবার বহু সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রেও সহজে ভর্তি হওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে বহু মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়, বিশেষ করে গ্রামগঞ্জের তথা দরিদ্র পরিবারের মানুষজন, কারণ তারা শিক্ষার জন্য নিজের সন্তানদের প্রয়োজনীয় খরচের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ। তাই বহু শিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না।
শিশু শ্রম আইনের সীমিত প্রয়োগ :
শিশু শ্রম বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত আইন থাকলেও দেশে এর প্রয়োগ সীমিত, যারফলে শিশুশ্রম নিরসন করা কঠিন হয়ে পড়েছে।এছাড়াও শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে রয়েছে অপর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা, প্রাপ্তবয়স্ক এবং কিশোর-কিশোরীদের জন্য উপযুক্ত কাজের সুযোগের অভাব, অভিবাসন, বিশ্বায়ন এবং সস্তা শ্রমের চাহিদা।
শিশুরা প্রতিনিয়ত নির্মম নির্যাতনের শিকার, Children are constantly subjected to cruel torture
শিশুশ্রম, আমাদের দেশে অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যা। চোখ ফেরালে দেখা যায় যে আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়তই ঘটছে শিশু শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন। বহু এমন ঘটনা আছে যেখানে শিশু পরিচারিকা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ভুলে প্লেট ভেঙে ফেলেছে, এই অপরাধে মালিকের নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে; হোটেলের কোনো শিশু কর্মচারী গ্লাস ভাঙা বা অন্য কোনও ভুল করার অপরাধে মালিকের অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুনছে, কারখানায় শিশু শ্রমিক কোনো কাজে ভুল করায় তাকে বেঁধে লোমহর্ষক নির্যাতন করা হয়, পেটানো হয়।
এমন সব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত আছে বহু শিশু, আর এই শিশুরা প্রতিনিয়ত কীভাবে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয় তা আমাদের অনেকেই চাক্ষুস করেছে, এছাড়াও আমরা গণমাধ্যমে প্রায়ই এমন ঘটনা দেখে থাকি। একটি শিশুর যে বয়সে বই হাতে নিয়ে বিদ্যালয়ে তাদের দুরন্ত শৈশব অতিবাহিত করার কথা, সেই বয়সে তাকে ইটভাটা বা শিল্পকারখানায় গিয়ে শ্রম দিতে হচ্ছে। দেশের সব ক্ষেত্রে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ, তা সত্ত্বেও ঘর থেকে বের হলে অহরহই দেখতে পাওয়া যায় শিশুশ্রমের করুণ চিত্র।
ইটভাটা, হোটেল, মোটেল, লঞ্চ, বাস, পাথর ভাঙা, কলকারখানা, মোটর গ্যারেজ, অ্যালুমিনিয়াম কারখানা, বাসাবাড়ি তৈরির কাজ, তামাকশিল্প, মিষ্টি ও বিস্কুট ফ্যাক্টরি, চামড়াশিল্প, চাশিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিশুশ্রমের নির্মম চিত্র প্রতিনিয়ত দেখা যায়।
শিক্ষা কিভাবে বঞ্চিত শিশু ও শিশুশ্রমকে সাহায্য করতে পারে, How education can help disadvantaged children and child labour?
শিক্ষার আলো দুরন্ত শৈশব ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত থেকে বঞ্চিত শিশু ও শিশু শ্রমিকদের আলোকিত করে তুলতে পারে, যাতে তারা নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় । শিক্ষা নিঃসন্দেহে একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাছাড়াও এটি শিশুদের ভবিষ্যতকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দিতে পারে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যায়।
শিশুশ্রম বন্ধে আমাদের করণীয়, What we can do to end child labour
শিশুশ্রম নিজে থেকেই কম হয়ে যাবে না, বরং বাধা না পেলে এটি আরো বেড়ে উঠবে। তাই জনগণকেই এই সমস্যা সমাধানের জন্য একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধে আমাদের করণীয় :
- ১. শিশুশ্রমকে দারিদ্র্যের ফসল বলা হয়, ফলে বুঝতে বাকি থাকে না যে শিশুশ্রমের মূলে রয়েছে দারিদ্র্য। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে প্রথমে দেশ থেকে দারিদ্র্য নিরসন করতে হবে;
- ২. অমানবিক শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে নিজেদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে, অন্যের শিশুকেও নিজের সন্তানের মতো মনে করা উচিত;
- ৩. প্রতিটি রাজ্যের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিশুদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে;
- ৪. শিশুশ্রম বন্ধ করতে গ্রাম ও শহরভিত্তিক পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে, অর্থাৎ অভাবের কারণে যেসব পরিবারের শিশু শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে, তাদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদেরকে শিশু ভাতা প্রদান করার ব্যবস্থা করতে হবে;
- ৫. শিশুশ্রম নিরসনে দেশে যেসব আইন রয়েছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে;
- ৬. বিভিন্ন কারখানা বা অন্য শিল্পক্ষেত্রে কিছু মালিক আছেন, যারা বেশি টাকা বেতন হিসেবে দিতে হবে বলে বড়দের কাজে রাখেন না, বরং কম বেতনে শিশুদের দিয়ে কাজ করান, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে;
- ৭. শ্রমের সাথে যুক্ত প্রতিটি শিশুর শিক্ষাগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে;
- ৮. শিশুশ্রম বন্ধ করা এবং শিশুদের অধিকার আদায় সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
শেষ কথা, Conclusion
আজকের শিশুরা আগামীর ভবিষ্যৎ, তারাই দেশের প্রাণশক্তি। এই জনশক্তিকে যদি জনসম্পদে রূপান্তর করতে না পারা যায় তাহলে আমাদের সার্বিক উন্নতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
সময়ের সাথে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দেশে এভাবেই বাড়তে থাকলে পুরো দেশ ও জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে, কারণ, আজকের শিশুদের ওপরই আগামীর দেশ ও জাতির উজ্জ্বল ও উন্নত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। তাই আমাদের সকলকে এগিয়ে এসে শিশুদের শ্রম থেকে মুক্তি দিয়ে তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের দুরন্ত শৈশব, তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তুলতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক তথা বাস্তবধর্মী কার্যকর পদক্ষেপ। সর্বোপরি, এই ব্যাপার নিয়ে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।