বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছিল করোনা ভাইরাস, হঠাৎ করেই সকলের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল এই ভাইরাস সংক্রমণের দুশ্চিন্তা। ক্রমে আক্রান্ত হতে শুরু করে অসংখ্য মানুষ, অনেকেই নিজের স্বজন হারিয়েছেন এই মহামারীতে। ভয়ে সবাই নিজেকে বাড়িতে বন্দী করে দিতে শুরু করে।
বিভিন্ন দেশের সরকারও নড়েচড়ে বসে। জারি হয় বেশ কিছু সরকারি নির্দেশিকা, যা সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে সহায়তা করেছিল। প্রায় এক বছর ধরে আমাদের দেশের মানুষও ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে কাটিয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২১ সাল অবধি বিশ্বজুড়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়, বহু লোক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থও হয়ে ওঠেন।
কোভিড-১৯ এর উৎপত্তি, Origin of Covid-19
কোভিড রোগের ভাইরাস প্রথমে কীভাবে এবং কোথায় ছড়িয়েছিল তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি, এ নিয়ে বহু মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে এই ভাইরাসটি “গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস” বা “Severe Acute Respiratory Syndrome-related Coronavirus” বা সংক্ষেপে SARS‐CoV এর অনুক্রম।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অনুমান ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে চিনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়। সেসময় এই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, ফলে এক মাসের মধ্যেই রোগীর সংখ্যা মারাত্মক আকারে বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে বেশিরভাগ রোগী ছিল উহান শহরের, আক্রান্ত ব্যক্তিগণ দক্ষিণ সমুদ্রের খাবারের পাইকারি বাজারের সঙ্গে জড়িত ছিল।
তাই সন্দেহ করা হয় যে এইসব সামুদ্রিক প্রাণী থেকে কোভিড-১৯ ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করেছে। তবে কিছু চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ধারণা যে অন্য কোনো প্রাণী যেমন- বাদুড়, পাম সিবের্ট, পেঙ্গুলিন প্রভৃতি প্রাণী থেকেই এই মারণ ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে এখনও কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।
কোভিড ১৯ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, Outbreak of the covid 19 virus
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি নোভেল করোনাভাইরাসকে পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি অব্ ইন্টার্নেশনাল কনসার্ন হিসাবে ঘোষণা করে। এর কিছু সময় পরে একই সালের মার্চ মাসে এই রোগকে অতিমারী রোগ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০২০ সালের ২৭শে জুন পর্যন্ত বিশ্বের ২১৩টি দেশে এই মারণ ভাইরাসের আক্রমণে অসংখ্য ব্যক্তি সংক্রমিত হয়েছিলেন। বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে এই সংক্রমণে। রোগের প্রভাব কম করতে বিভিন্ন দেশ প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা জারি করেছিল যাতে সংক্রমণ এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের লক্ষণ সমূহ, Symptoms of corona virus infection
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই সংক্রামিত কোনো ব্যক্তির দেহে রোগের লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পায় না। সাধারণত দুই দিন থেকে চৌদ্দ দিনের ভিতরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। এই ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণগুলো হলো-
- সর্দি
- গলা ব্যথা
- কাশি
- মাথা ব্যাথা
- জ্বর
- হাঁচি
- অবসাদ
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
- শরীর ঠাণ্ডা
- বমি বা বমি-বমিভাব
- নাক বন্ধ
- ডায়রিয়া
- হ্যামোপটোসিস
- কনজাঙ্কটিভাইটিস
এই লক্ষণগুলো সাধারণ ফ্লু ভাইরাস আক্রান্তের লক্ষণের মত বলেই মনে হয়, কিন্তু সময়ের সাথে এটি দেহে অনাক্রম্যতার অভাব ঘটিয়ে সংক্রমিত ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর ক্ষতি করে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে সংক্রমণ হওয়া সত্বেও তাদের মধ্যে উক্ত কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় নি। বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়াই তারা সুস্থ হয়ে উঠছেন।
কোভিড-১৯ এর প্রতিকার, Cure for Covid-19
করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ ভাইরাসের সঠিক কোনোও চিকিৎসা এখনও অবধি আবিস্কার হয়নি। বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও এগুলো করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা করবে বলে নিশ্চিত কোনো প্রতিশ্রুতি চিকিৎসকরা দিতে পারেন নি। তাই এ নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। তবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হলে নিজে কিছু ক্ষেত্রে সাবধান থাকার চেষ্টা করতে হবে। এরজন্য নিচে উল্লেখ করা বিধিমালা মেনে চলা আবশ্যক।
- হাঁচি বা কাশি দিতে সময় মুখের সামনে হাত বা রুমাল বা টিস্যু পেপার রাখা উচিত। এর পরে হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে অথবা হাতে সেনিটাইজার লাগাতে হবে।
- আপনার মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে বাড়ির অন্য ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলতে শুরু করুন, নিজে একটি আলাদা কক্ষে থাকুন, আপনার জিনিসগুলো কাউকে ব্যবহার করতে দেবেন না।
- নিজেকে যথা সম্ভব হাইড্রেট রাখতে হবে।
- খাবার আগে ও পরে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া।
- বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে।
- হাতে মুখে হাত লাগানো থেকে বিরত থাকুন, সম্ভব হলে কিছুক্ষণ পর পর হাত সেনিটাইজ করুন।
- ধোঁয়াটে এলাকাগুলো বা ধূমপান করা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলতে হবে।
- ভিড় থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন, বাইরে অন্য মানুষের থেকে যথাযথ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি।
- সংক্রমণ চলাকালীন সময়ে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ীর বাইরে না যাওয়া।
- সরকার প্রদত্ত সমস্ত বিধি-নিষেধ মেনে চলুন।
- অনাক্রম্যতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
কোভিড-১৯ এর নির্দিষ্ট চিকিৎসা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন উপসর্গ অনুযায়ী এর চিকিৎসা প্রদান করা হয়। তাই এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় হল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং টিকাকরণ এজন্য উপরিউক্ত বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন থাকা জরুরি।
কোভিড ১৯ সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া, Covid19 detection process
কোভিড১৯ সনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরীক্ষাগুলো হল:
- রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (RT-PCR) পরীক্ষা।
- অ্যান্টিজেন র্যাপিড টেস্ট।
সরকারি নির্দেশিকা সমূহ, Government guidelines
কোভিড ১৯ এর সংক্রমণ মানুষের সাথে মানুষের মেলামেশার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল দ্রুতভাবে। তাই বিভিন্ন দেশের সরকার অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য লকডাউন ঘোষণা করে, ফলে মানুষ নিজেদের বাড়ি ঘর থেকে বের হতে পারবেনা, শুধু হাসপাতাল এবং অন্যান্য জরুরী পরিষেবা চালু রাখা হয়, কিন্তু তাও সম্পূর্ণ সতর্কতা এবং বিভিন্ন রকম প্রতিরোধ ব্যবস্থা বজায় রেখে সেই সকল পরিষেবা চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
প্রায় এক বছর ধরে এই লকডাউন জারি ছিল, বেশিরভাগ মানুষের কাজ কর্ম বন্ধ ছিল, ছাত্রদের পড়াশুনাও বন্ধ ছিল তখন, কিন্তু এভাবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটা হ্রাস পায়।
করোনা ভাইরাসের জন্য আবিষ্কৃত টিকা সমূহ, Vaccines Discovered for Corona Virus
করোনা ভাইরাস এর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে গবেষণা করে কয়েকটি টিকা আবিষ্কার করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করেন। পরবর্তী সময়ে আরও বিভিন্ন দেশ এই ভাইরাস এর প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কার করেছেন। এরমধ্যে কিছু দেশ সম্মিলিত ভাবে কাজ করে টিকা তৈরি করেছেন। করোনা ভাইরাসের টিকা সমূহের নাম জেনে নিন :
- ফাইজার-বায়োএনটেক নামক কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কারক দেশগুলো হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি।
- মডার্না কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
- এইচজিসি০১৯ নামক টিকা আবিষ্কার করেছে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
- জাইকোভ-ডি নামক কোভিড টিকার আবিষ্কারক দেশ হল ভারত।
- স্পুটনিক ভি নামক কেভিড-১৯ টিকা আবিষ্কার করেছিল রাশিয়া।
- কোভিশিল্ড নামক কোভিড টিকা আবিষ্কার করেছে যুক্তরাজ্য।
- জনসন অ্যান্ড জনসন কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কারক দেশগুলো হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , নেদারল্যান্ডস , বেলজিয়াম।
- কনভিডেসিয়া নামক টিকা আবিষ্কার করেছে চীন।
- বিবিভি১৫৪ নামক কোভিড টিকা আবিষ্কার করেছে ভারত।
- সিনোফর্ম বিবিআইবিপি-কর্ভি কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কারক দেশ হল চীন।
- করোনাভ্যাক আবিষ্কার করেছিল চীন।
- কোভাক্সিন টিকা আবিষ্কার করেছে ভারত।
- নোভাভ্যাক্স নামক কেভিড-১৯ টিকা আবিষ্কার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে ও ভারত সম্মিলিতভাবে।
- কর্বেভ্যাক্স নামক টিকা আবিষ্কার করে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে।
উপসংহার, Conclusion
কোভিড-১৯ সারা বিশ্বে ত্রাস ছড়িয়েছিল ঠিকই কিন্তু উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে এই মারণ ভাইরাসকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই ভাইরাস পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় নি, তাই এতে আর কেউ কখনো আক্রান্ত হবে না এটা ভাবা ভুল। এজন্যই সারা বিশ্ব করোনার ভ্যাকসিন আবিস্কারের জন্য এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দিকে তাকিয়ে আছে। সকলেই আশাবাদী যে চিকিৎসা বিজ্ঞান একদিন সফলতার শিখরে পৌঁছে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিস্কারে সক্ষম হবেই।