কুটিরশিল্প আমাদের দেশের গৌরব ও ঐতিহ্যের পরিচায়ক। একটা সময় ছিল যখন কলকারখানা তৈরি হয়নি বা ভারী কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না, তখন কুটিরশিল্প মানুষের জীবনের নানা অভাব দূর করেছিল। মানুষ তখন নিজ হাতে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করত। অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছিল কুটিরশিল্প। কিন্তু আজ সেই স্বর্ণময় গৌরবের দিনগুলো ইতিহাসের দূস্তরতায় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন কারণে ভাঙন ধরেছে কুটিরশিল্পেও।
কুটিরশিল্প কী? What isCottage industry?
‘কুটির’ শব্দটির মূল অর্থ হল পত্র নির্মিত ছোট ঘর, আর ‘শিল্প’ কথাটির অর্থ গৃহকার্যে ব্যবহার্য সামগ্রী। কুটিরশিল্প বলতে বোঝায় পরিবারভিত্তিক সামান্য মূলধনবিশিষ্ট শিল্প। এর উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রধানত স্থানীয় কাঁচামাল, কারিগরি দক্ষতা ও সহজ দেশজ প্রযুক্তিনির্ভর দ্রব্যাদি ভিত্তিক। কারিগরি দক্ষতা সাধারণত শিল্পীদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। কুটিরশিল্প সাধারণত গ্রামদেশেই বেশি দেখা যেত, তবে এখনকার সময় গ্রাম ও শহর উভয় এলাকাতেই এই শিল্প বিদ্যমান।
কুটিরশিল্পের বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি, Features of Cottage Industry
কুটিরশিল্প বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যেমন :
- কুটিরশিল্পের ক্ষেত্রে অল্প খরচে দ্রব্য উৎপাদন করা যায় বলে পুঁজি কম লাগে এবং খরচ কম বলে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যও কম।
- ঘরে বসেই কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য তৈরি করা যায়, এরজন্য কোনো কারখানায় যেতে হয় না বা বড় যন্ত্রের ব্যবহার করা হয় না।
- কুটিরশিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এই ক্ষেত্রে শিল্পপ্রতিভার ছাপ মেলে।
- শিল্পীর স্বহস্তে তৈরি দ্রব্যগুলো দেখতেও সুন্দর হয় এবং এর স্থায়িত্বও বেশি দিন।
কুটিরশিল্পের বিস্তৃতি, Expansion of cottage industries
কুটিরশিল্পের পরিচয় বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। ঘরে বসে বোনা তাঁতের কাপড়, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পিতলের বাসন-কোসন, বাঁশ বেতের জিনিসপত্র, খেলনার বিভিন্ন জিনিস, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, সোনা-রুপার গয়না, সুতি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন শিল্প, শীতল পাটি, মোড়া, চাটাই, কাঁথার নকশা ইত্যাদি সামগ্রী দেশের উল্লেখযোগ্য কুটিরশিল্প। দেশের উল্লেখযোগ্য কিছু কুটিরশিল্পের বিবরণ :
তাঁত শিল্প :
আমাদের দেশের তাঁতিরা লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি, গেঞ্জি, বিছানার চাদর, মশারির কাপড় সহ আরো বেশ কিছু জিনিস উৎপাদন করে থাকে। তাছাড়াও আদিবাসীদের হাতে বোনা পাছড়া ইত্যাদিও গুণগত মানের দিক থেকে খুবই উন্নত। পাশাপাশি এর উপর করা নকশাগুলোও দেশের কুটিরশিল্পের বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে।
মৃৎশিল্প :
আমাদের দেশের মৃৎশিল্প বিশ্ব ব্যাপী খ্যাত। দেশের গ্রামের মানুষজন এখনো মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, বাসন-কোসন, কলস, থালা-গ্লাস ইত্যাদির ব্যবহার করে থাকে। আগেকার সময়ে শৌখিন দালান, বেশ কিছু মসজিদ, বিভিন্ন মন্দির প্রভৃতিতে টেরাকোটার কাজ দেখা যেত, কিন্তু এখনকার স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে টেরাকোটা বিলুপ্তপ্রায়। অন্যদিকে মাটির তৈরি গৃহসজ্জার সামগ্রী বর্তমানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মৃৎশিল্প সারা দেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। তাছাড়া আজকাল রেস্টুরেন্ট বা বাড়িতে সৌখিন রান্নার ক্ষেত্রেও মানুষ মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করে।
বাঁশ ও বেতশিল্প :
বাঁশবেত দিয়ে যে কতকিছু তৈরি করা হয় তা হয়তো না দেখলে বুঝতে পারা যাবে না। আমাদের দেশে বেতের তৈরি চেয়ার, সোফা, শীতল পাটি ও অন্যান্য হস্তশিল্প ব্যাপক জনপ্রিয়। তাছাড়া আজও বাঁশের তৈরি বিভিন্ন গৃহস্থালি সামগ্রী ছাড়া গ্রামীণ জীবন যেন অচল। অন্যদিকে বাঁশ দিয়ে নানা ধরনের কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী বিদেশেও রপ্তানি করা হয়।
ধাতুশিল্প :
আমাদের দেশে তামা, কাঁসা, পিতল, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতুর ব্যবহার করে নিত্যব্যবহার্য হাঁড়ি, পাতিল, জগ, গ্লাস প্রভৃতি তৈরি করা হয়। পিতলের ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয় গৃহসজ্জামূলক জিনিসগুলো, যেগুলো এখানও জনপ্রিয়তা হারায়নি, আজও এসবের ব্যবহার করেন বহু মানুষ, তাছাড়া এগুলোর গুণগত মান ভালো।
চামড়াশিল্প :
কুটিরশিল্পের মধ্যে চামড়াশিল্পও আমাদের দেশে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চামড়ার তৈরি বিভিন্ন ধরনের জুতা, সুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ ইত্যাদিও উল্লেখযোগ্য। তবে শুধু দেশে নয়, বরং দেশের বাইরেও এ সকল পণ্যের সমান চাহিদা রয়েছে।
অন্যান্য কুটিরশিল্প :
দেশের অন্যান্য কুটিরশিল্পজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে নকশিকাঁথা, ঝিনুকের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী, চুড়ি, মাটির পুতুল, উলের পুতুল, মোমের পুতুল প্রভৃতিও উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন মেলায় দোকান সাজিয়ে এইসব জিনিস নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। এইসব শিল্প দেখলে অবাক লাগে এবং পাশাপাশি মন ভরে ওঠে জিনিসগুলোর সৌন্দর্যে।
কুটিরশিল্পের সোনালি অতীত, Golden past of cottage industry
দেশের কুটিরশিল্পের অতীত ইতিহাস নিঃসন্দেহে গৌরবময়। বিদেশের কথা বলতে গেলেও ইউরোপে আঠারো শতকে হওয়া শিল্পবিপ্লবের আগে কুটিরশিল্পই ছিল তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি। আমাদের দেশে ইংরেজদের আগমন হওয়ার আগে কুটিরশিল্প যেভাবে বাজার ধরে রেখেছিল ও সুনাম অর্জন করেছিল তা ইতিহাসে স্বীকৃত। দেশের বহু ঐতিহাসিক শিল্প সামগ্রী আজও সংরক্ষণ করে রাখা আছে সরকারি সংগ্রহশালাগুলোতে। এই শিল্পগুলো কদর আজও কম হয় নি।
আগেকার সময়ে প্রায়ই মেলায় বিভিন্ন কুটির শিল্প বিক্রি করা হত, মানুষ বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে যেতেন এইসব মেলায়। জিনিসগুলো দেখে সকলেরই হয়তো কবির লেখা কথাগুলো মনে পড়ত;
“নানান রকম কুটির শিল্প বসেছে হোথা জন্তু, বাঁশ, বেত, মাটি, কাগজ, কাপড়ের কাজ আর কথকতা । নানান ধরণ মাটির পুতুল, মুখোস জানোয়ার রকমারী রঙ বাহারি গরম পোষাক, পশমের বাহার ।
ফেলে দেওয়া ছোবড়া -খোলায় বানান খেলনা , দেখেই না চোখে জুড়িয়ে গেলো রঙএর বাহানা । ভুট্টা ছোবড়া, ধান দিয়ে তৈরি হরেকরকম ফুল। কত আছে গহনা কাঠি আর কানের দুল । কতই না খেলনা পুতুল, নারকেল খোল ও শাঁখের কাজ আর আছে একতারা,মাদল, মৃদঙ্গ,সানাই বাদ্যের রেওয়াজ । ধান, পুঁতি, কাগজ, কাঠির হার, দুল, চুড়ি মনোহারী, হরেকরকম কাগজের ফুল, ফল, রঙবাহারি।”
কুটিরশিল্পের বর্তমান অবস্থা, present scenario of cottage industries
ইউরোপে শিল্পবিপ্লব আঠারো শতক থেকে শুরু হয়, তখন থেকে দিকে দিকে ঘটল কলকারখানা সম্প্রসারণ। বৃহৎ যন্ত্রশিল্পের সাথে তাল মিলিয়ে ক্ষীণপ্রাণ কুটিরশিল্প অসম প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিল। আমাদের কুটিরশিল্পকে রাজনৈতিক চক্রান্ত, হীন ব্যবসায়িক- বুদ্ধি দিনের পর দিন বিধ্বস্ত করে তুলেছে।
বৃহদায়তন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটার ফলে কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে, ফলে এর মূল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে অনেক কম সময়ে বেশি দ্রব্য উৎপাদন করা যায় বলে দ্রব্যগুলোর মূল্যও কম হয়। তাছাড়া কারখানায় তৈরি পণ্যও বেশিরভাগ সময় নিখুঁত হয়। এজন্যই কারখানায় তৈরি পণ্যগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, অন্যদিকে বিপরীত অবস্থা হয়েছে কুটিরশিল্পের ক্ষেত্রে।
কুটিরশিল্পকে বাঁচানোর জন্য গৃহীত পদক্ষেপ, Steps taken to save cottage industries
কুটিরশিল্প দেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। ইতিহাসের সাথে এই শিল্প যুক্ত, বলতে গেলে কুটির শিল্প নির্দিষ্ট দেশের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে। দেশের কুটিরশিল্পের উপযোগিতা বিবেচনা করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কুটিরশিল্পের প্রয়োজনীয় উৎকর্ষ সাধানের জন্য।
ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্রায়তন ও বৈচিত্র্যময় কুটিরশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে কারিগরদের প্রশিক্ষণ দান, উৎপাদন প্রক্রিয়ার উৎকর্ষ সাধন, বাজার ব্যবস্থাপনা, মূলধন সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে একটি কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে শুধু কুটিরশিল্পের পুনরুজ্জীবনই সব নয়, বরং এর পাশাপাশি প্রয়োজন পণ্য-বৈচিত্র্য ও উৎপাদন-উৎকর্ষের সাধনা।
উপসংহার, Conclusion
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কুটিরশিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আমাদের দেশের কুটিরশিল্প বিশ্ববাজারে কৌতূহলী ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যথেষ্ট সমর্থ হয়েছে। তাছাড়া জনবহুল দেশের বেকারত্বের সমস্যা সমাধান করার ক্ষেত্রেও কুটিরশিল্প বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
কুটিরশিল্পের সঙ্গে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র জনগণের ভাগ্য জড়িত রয়েছে। তাই কুটিরশিল্পের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে, আর এমনটা করতে পারলেই আমাদের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। এই জন্যই সরকার ও জনগণের সম্মিলিত ঐকান্তিক চেষ্টা প্রয়োজন।
মোট কথা, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের কথা ভাবতে গেলে দরিদ্র জনসাধারণের ভাগ্য পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে কুটিরশিল্পের প্রয়োজন ও গুরুত্ব অপরিসীম।