গৃহপালিত পশু গুলির মধ্যে গরু একটি অন্যতম প্রাণী। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে মানুষের নানান উপকার করে এসেছে গরু। তাই আগেকার সময়ে প্রায় মানুষের বাড়িতেই গৃহপালিত পশু হিসেবে গরু ছিল, কিন্তু এখনকার সময়ে নিতান্তই গ্রামের কিছু বাড়িতে এই পশুটিকে দেখতে পাওয়া যায়। শহরাঞ্চলের খুব কম বাড়িতেই গরু পালন করা হয়, বরং বেশিরভাগ গরু রাস্তা ঘাটেই দেখা যায়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের জীবনে এমন কোনো ক্ষেত্র পাওয়া দুষ্কর যেখানে গরুর ভূমিকা নেই।
গরুর প্রকৃতি, Gorur prokriti
আমরা সকলেই জানি যে গরু একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। এর দুটি চোখ, একটি নাক, একটি মুখ, দুটি কান, দুই জোড়া পা এবং একটি লেজ আছে; তবে গরুর পায়ে কোনো আঙ্গুল থাকে না বরং আঙ্গুলের বদলে আছে খুর, অন্যদিকে দুই শিং আছে যা আত্মরক্ষায় কাজে লাগে। তাছাড়া এই প্রাণীটির মাথার উপরে একজোড়া শিং থাকে। সাদা, কালো, বাদামি নানা রঙের গরু দেখতে পাওয়া যায়, গরুর সারা শরীর ছোট ছোট লোমে ঢাকা থাকে। এছাড়া গরুর লেজের শেষের দিকে এক গুচ্ছ চুলও হয়।
গরুর বাচ্চাকে বাছুর বলা হয় এবং পুরুষ গরুকে বলদ বা ষাঁড় বলা হয়। তবে ষাঁড়ের শারীরিক গঠন একটু অন্যরকম, তাদের পিঠ একটু উঁচু হয়, গরু শান্ত প্রকৃতির হলেও ষাঁড় একটু মেজাজে প্রকৃতির হয়। গরু মূলত তৃণভোজী প্রাণী। সবুজ ঘাস এদের প্রিয় খাদ্য। তাছাড়া গৃহপালিত গরুকে লতাপাতা, খড় কিংবা সবজির খোসা অথবা ভাতের ফেন ইত্যাদিও খাওয়ানো হয়।
গরুর পেটে চারটি পাকস্থলী থাকে, যা গরুর খাবার হজম করতে সাহায্য করে। তবে প্রাণী হিসেবে গরু খুবই শান্ত প্রকৃতির হয়। এরা বিশ্রামের সময় জাবর কাটে, কারণ খাবার সময় এরা ঠিক ভাবে চিবোয় না, এমনি গিলে ফেলে, পরে ধীরে ধীরে জাবর কাটার মাধ্যমে ভালোভাবে চিবিয়ে নেয়, ফলে খাবার সহজে হজম হয়।
মানুষের জীবনে গরুর প্রাধান্য, priority of cow in human life
প্রাচীনকালে ভারতে গরুকে দেবী রূপে পূজা করা হত। ভারতের সমস্ত প্রাণীর মধ্যে গরুকে পবিত্রতম প্রাণী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন পবিত্র কাজে ব্যবহৃত হয় গরুর দুধ, পূজার সময় দেব – দেবী মূর্তির অভিষেকের জন্যও দুধ ব্যবহৃত হত। আমাদের দেশে গরু ‘ গো মাতা ‘ হিসেবেও সুপরিচিত। গ্রাম হোক কিংবা শহর, দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই গরু পাওয়া যায়। আমাদের দেশে গরু ছোট হলেও অন্য দেশে বড় গরু পাওয়া যায়।
মানুষের জীবনে গরুর ভূমিকা, Importance of cow in human life
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নিজের বাড়িতে নানা রকম পশু পালন করে এসেছে। বাড়িতে পোষা সমস্ত পশুদের বলা হয় গৃহপালিত পশু, আর গৃহপালিত পশুদের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে পরিচিত হল গরু। মানুষের জীবনে গরুর ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়।
খুঁজলে দেখা যাবে যে ইতিহাসে মানুষের জীবনের কোন না কোন ক্ষেত্রে এই প্রাণীটি আমাদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছে। এমনকি আজও পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে মানুষের জীবনে গরু গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাণী। তাই গরু অন্যান্য গৃহপালিত পশুদের থেকে অনেকখানি আলাদা। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন গৃহস্থের বাড়িতে গরু পরিবারের সদস্যের ন্যায় এক জরুরি অংশ হিসেবে পালিত হয়। গ্রামের মানুষ আবেগের বন্ধনে জড়িয়ে যান এই প্রাণীটির সাথে।
তাছাড়া গরু মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সাহায্য করে, পাশাপাশি এর প্রতিপালনে ঝামেলাও পোহাতে হয় না, বলতে গেলে গৃহপালিত পশুদের মধ্যে গরুর প্রতিপালন সবচেয়ে সহজ, তথা লাভজনক, এই কারণেও গরু মানুষের জীবনে গৃহপালিত পশু হিসেবে অন্যতম। এবার বিস্তারিতভাবে জেনে নিন গরু মানুষকে কি কি উপায়ে সহায়তা করে :
কৃষিকাজে গরুর ভূমিকা, Role of cow in agriculture
মানুষের কৃষিকাজে সুপ্রাচীন কাল থেকে গরু এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। জমিতে লাঙ্গল এর সাহায্যে চাষ করার কাজে সহায়তা করে গরু, সেই চষা জমিতে শষ্যদানার বীজ রোপন করেন চাষীরা এবং সেই বীজই ফসল রূপে মানুষকে জীবনধারণের অন্ন জোগায়। তাছাড়া ঘানি থেকে তেল উৎপাদনে ষাঁড় এবং বলদকে ব্যবহার করে মানুষ।
মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য দুধের জোগান দেয়, cow gives nutritious milk
গরুর দুধ মানুষের জন্য এক অন্যতম তথা সহজলভ্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে পরিচিত। চিকিৎসকরা গরুর দুধকে শিশুদের ক্ষেত্রে সুষম খাদ্য হিসেবে খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। তাছাড়া আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে অনেকেই গরুর দুধকে পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।
গরুর দুধ নিয়মিত পান করলে আমাদের মন তীক্ষ্ণ এবং স্মৃতিশক্তিও শক্তিশালী হয়, পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে দুধ খুব উপকারী। তাছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন খাবারের জিনিস তৈরিতেও দুধ কাজে লাগে। বর্তমান সময়ে দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করেই সারা পৃথিবীজুড়ে বেশ কিছু বৃহৎ শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। দুধ থেকে আমরা দই, পনির, ঘি, মাখন, মিষ্টি, আইস্ক্রিম, ইত্যাদি বিভিন্ন কিছু তৈরি করতে পারি।
মানুষের জীবনে গরুর গোবরের উপযোগিতা, Necessity of cow dung in human life
পৃথিবীতে খুব সম্ভবত গরুই একমাত্র প্রাণী যার ত্যাগ করা মলও অর্থাৎ যাকে আমরা গোবর বলে থাকি, তাও মানুষের বিভিন্ন কাজে লাগে। গরুর গোবর মানুষের জীবনে এক পরম উপযোগী বস্তু। মাটির ঘর লেপার কাজে গোবরের ব্যবহার হয়, পুজোর আগে উঠোনে শুদ্ধিকরণ করার ক্ষেত্রেও গোবর দিয়ে লেপা হয়, এমনকি পূজার কাজেও গোবর ব্যবহৃত হয়।
পঞ্চগব্য তৈরির জন্য বাছুরের মল ও মুত্র ব্যবহৃত হয়। বিয়েবাড়ির কিছু নিয়মেও গোবর ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে গোবর থেকে তৈরি ঘুঁটে অন্যতম প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, গরুর গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস তৈরি করা যায়।
অন্যদিকে গোবর গাছপালার সার হিসেবেও অত্যন্ত উপযোগী, আর এই গোবর সার কৃষি ক্ষেত্রে ভালো ফলনের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় বস্তু, কারণ এটি শস্যকে পুষ্টি যোগায়। তাছাড়া ভারতবর্ষের বেশ কিছু গ্রামাঞ্চলে আজও মানুষের বাড়ির আঙিনায় ভোর বেলা বা সন্ধ্যাবেলায় গোবর জলের ছিটা দেওয়ার প্রথা চালু রয়েছে, এতে নাকি খারাপ শক্তি বাড়ির অমঙ্গল করতে পারে না বলে বিশ্বাস করেন অনেকে।
অন্যান্য ভাবে মানুষের জীবনে গরুর ভূমিকা, The role of cows in human life in various other ways
উপরে উল্লেখ করা বিভিন্ন বিষয়গুলো বাদ দিলেও গরু মানুষের জীবনে আরো বিভিন্ন ভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাচীনকালে যাতায়াত ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম হিসেবে গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হতো।
এমনকি গরু মৃত্যুর পরও আমাদের অনেক উপকারে আসতে পারে। গরুর শিং এবং হাড়ও জৈব সার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গরুর তেল বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীতে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া গরুর চামড়া মানুষ ঢাক ঢোল ইত্যাদি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহার করে থেকে, তাছাড়া ব্যাগ, জুতো ইত্যাদি তৈরিতেও গরুর চামড়া ব্যবহার করা হয়। গরুর হাড় দিয়ে চিরুনীও তৈরি করা হয়। সুতরাং, আমরা বলতে পারি যে গরুর পুরো শরীর জীবিত অবস্থায় কিংবা মৃত্যুর পরও আমাদের বিভিন্ন কাজে লাগে।
উপসংহার, Conclusion
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, গরু মানব সভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের জীবনে গরুর ভূমিকা এত গুরুত্বপূর্ণ বলেই হয়তো আমাদের দেশের মানুষ এই বিশেষ প্রাণীটিকে নিজের মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন। বিশেষ করে গ্রামের মানুষেরা নিজেদের পালিত গরুকে নিজ পরিবারের সদস্য হিসেবে মনে করেন, তাকে আলাদা করে দেখেন না। এই চার পায়া প্রাণীটিও সারা জীবন ধরে, এমনকি মৃত্যুর পরও মানুষের বিভিন্ন কাজে লাগে।