বাঙালিরা ভ্রমণপিপাসু, একথা অস্বীকার করার নয়। যদিও শুধু বাঙালিরা নয় বরং সারা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন স্থান ভ্রমণ করার মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করেন; কখনো সমুদ্র সৈকত, কখনো বা পাহাড়ে ঘিরে থাকা মনোরম শহর। বিশেষত পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা, কারণ পাহাড়ী অঞ্চলগুলো সকলের কাছে ভ্রমণের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য বলে বিবেচিত হয়। এমনই একটি অতি মনোরম ভ্রমনস্থান হল দার্জিলিং। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সত্যিই অপরূপ, যা প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
দাজিলিংয়ের ভূ-প্রকৃতি, Nature at Darjeeling
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মধ্যে অন্যতম তথা উল্লেখযােগ্য জেলা হল দার্জিলিং। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিকে অবস্থিত দার্জিলিং জেলা, যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সত্যিই অপরূপ। দার্জিলিং শহরে হিমালয়ের পাহাড়ী অঞ্চলের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দার্জিলিং মনােরম প্রকৃতি ও দার্জিলিং চায়ের জন্য বিখ্যাত।
দার্জিলিং মূলত একটি পাহাড়ি অঞ্চল। তবে পাহাড়ের পাশাপাশি সমভূমিতে বসবাসকারী জনগণের কাছেও প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস হল হিমালয়ের সৌন্দর্য্য। দার্জিলিং “পাহাড়ের কুইন” নামে পরিচিত, এর কারণ দার্জিলিং কে ঘিরে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়, যারা প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে এই অঞ্চলের সৌন্দর্য্য অনেকটা বৃদ্ধি করে দিয়েছে। দার্জিলিংয়ে আরো দুইটি আকর্ষণীয় বিষয় হল, দার্জিলিং চা এবং হিমালয়ান রেলপথ। তাছাড়াও এই অঞ্চলে দিনগুলি সূর্যালোক ও কুয়াশার সাথে প্রায় সারা বছর ধরেই লুকোচুরি খেলে।
দাজিলিংয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, Experiences is of Darjeeling visit
দার্জিলিংয়ে ভ্রমণে গেলে অনুভব করা যায় যে এই পাহাড়ী শহরটি অসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বুক চিরে অবস্থান করেছে। এই পাহাড়ি এলাকার মধ্য দিয়ে একাধিক নদী প্রবাহিত হয়, সেই নদীগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলি হল তিস্তা, রঙ্গিত, বালাসন, প্রভৃতি।
এই নদীগুলোর জল খুব স্বচ্ছ, এবং পাথরের তীর ঘেঁষে যাওয়া নদীর জলের ধারা যেন প্রকৃতিতে এক অপরূপ মাধুর্য সৃষ্টি করে। দার্জিলিংয়ে সবুজ পাহাড়ি অঞ্চলগুলো মেঘ ও কুয়াশায় ঢাকা থাকে, যা দেখে মনে এক অনন্য আনন্দের সঞ্চার হয়। এখানকার মানুষ আদি-অন্ত হতেই মিশুক প্রকৃতির। দার্জিলিংয়ের জনপ্রিয় খাবার গুলোর মধ্যে রয়েছে মোমো এবং থুবকা (মাংস এবং নুডুলস দিয়ে তৈরি এক ধরনের ঘন স্যুপ) ইত্যাদি।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলার ভৌগলিক সীমানার কথা বলতে গেলে ভারতের অন্য ২ রাজ্য, এবং পার্শ্ববর্তী ২ টি দেশের নামও উল্লেখ করতে হয়, কারণ দার্জিলিংয়ের উত্তর দিকে সিকিম রাজ্য, দক্ষিণে বিহারের পূর্ণিয়া এবং উত্তর দিনাজপুর জেলা, পূর্বদিকে আছে ভুটান দেশ এবং জলপাইগুড়ি জেলা, আর পশ্চিম দিকে আছে নেপাল।
দার্জিলিং এর কিছু দর্শনীয় স্থান, Places to visit in Darjeeling
দার্জিলিং এর জনপ্রিয়তা কোনো নতুন ব্যাপার নয়, ব্রিটিশ রাজের সময় থেকেই এই অঞ্চলের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে দার্জিলিং নিজের অনাবিল সৌন্দর্য এবং মনোরম জলবায়ুর কারণে ছুটির দিনে ঘুরতে যাওয়ার মত এক জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে আসছে। এখানকার বেশিরভাগ দর্শনীয় স্থান তিব্বতী আদলে নির্মিত। এখানকার বেশ কিছু দেখার জায়গা রয়েছে যা এই অঞ্চলের সংস্কৃতি তুলে ধরে পর্যটকদের কাছে। দার্জিলিং জেলার বিভিন্ন অংশে বেশ কিছু পর্যটন স্থান রয়েছে, সেগুলি হল:-
জাপানিজ টেম্পল এবং পীস প্যাগোডা
দার্জিলিং শহরের খুব কাছে অবস্থিত জাপানিজ টেম্পল। জীপে যেতে মাত্র ১০ মিনিটের মত সময় লাগে। উক্ত বৌদ্ধ মন্দিরটি এক জাপানী সাধুর অর্থায়নে তৈরি করা হয়েছিল বলে এটি জাপানি টেম্পল হিসেবে পরিচিত। মন্দিরের একটি দরজায় বিশাল সোনালি রঙের দুটি সিংহ মূর্তি আছে এবং মন্দিরের ভিতরে জাপানি সাধুর একটি বড় মূর্তিও রয়েছে। এই মন্দিরের উল্লেখযোগ্য তথা আকর্ষণীয় বিষয় হল পেস প্যাগোডা।
টাইগার হিল
দার্জিলিং শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত একটি উঁচু স্থান যা টাইগার হিল পয়েন্ট নামে পরিচিত। পর্যটকের বিশ্রামের সুবিধার্থে এখানে একটি ঘরও বানিয়ে রাখা হয়েছে। এই টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া এই বিশেষ পয়েন্ট থেকে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াও দেখা যায়। উক্ত স্থান থেকে দূরের পাহাড়ের চূড়ায় দিনের প্রথম সূর্যের সোনালী কিরণ দেখতে পাওয়ার ব্যাপারটা যে কতটা মনমাতানো সেটা হয়তো বলে বোঝানো যাবে না।
বাতাসিয়া লুপ
টাইগার হিল যাবার পথে পড়বে বাতাসিয়া লুপ, এই স্থানটি অপরূপ সুন্দর আর এখানেই দার্জিলিং এর টয় ট্রেন ৩৬০ ডিগ্রীতে ঘুরে আবার ঘুম ষ্টেশনের দিকে চলে যায়। এই বাতাসিয়া লুপ কিছুটা পার্কের আদলে তৈরি, যেখানে একটি সেনার বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিও আছে। উক্ত স্থানে হঠাৎ করে কুয়াশা নেমে আসে এবং চারিদিক ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যায়, আবার হঠাৎ করেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা উপভোগ যে করেছে সেই বুঝতে পারবে কতটা ভালো লাগা আছে এমন মুহূর্তে।
ঘুম মনেস্ট্রি
টাইগার হিলের দিকে যাবার পথে ঘুম মনেস্ট্রি নামে পরিচিত এই বৌদ্ধ মন্দিরটি পড়ে। রাস্তার পাশেই এই মন্দির, তবে একটু নিচের দিকে। মূল রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নিচে নেমে যেতে হয়। এই মন্দিরের ভিতরে বিশাল বৌদ্ধ মূর্তি আছে। মন্দিরে বেশ কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকে, যারা মন্দিরের দেখাশোনা করেন। তাছাড়া মন্দিরের গেটের পাশে ফুটপাতে বেশ কিছু বাহারি জিনিসের দোকান বসে, যা মূলত পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যই সেখানে থাকে। এইসব দোকানে টুপি, রুমাল, ইত্যাদি সহ বিভিন্ন তিব্বতী জিনিস পাওয়া যায়।
রক গার্ডেন
এই স্থানটি মূলত ঝর্নার জন্য আকর্ষণীয়। এই বাহারি ঝর্নার বাগান দেখতে হলে শহর থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট নিচে নেমে যেতে হবে। এই অপরূপ ঝর্নার প্রতিটা জলক্ষেপ দেখার জন্য আছে সিঁড়ির ব্যবস্থা। তাছাড়াও এখানে আছে বেশ কিছু বাহারি ফুলের বাগান। অন্যদিকে নেপালিদের ঐতিহ্যবাহী সাজে সাজার জন্য এখানে ভাড়া করে নেপালী পোশাক পরিধান করার ব্যবস্থাও রয়েছে।
চা-বাগান
দার্জিলিং গিয়ে যদি এখানকার চা বাগান পরিদর্শন না করা হয় তাহলে কেমন যেন ভ্রমণটা অসমাপ্ত বলে মনে হতে পারে, কারণ আমরা সকলেই জানি যে এই শহরটিতে উৎপাদিত হওয়া দার্জিলিং চা সারা বিশ্বে সুখ্যাত। শহরের খুব কাছেই অবস্থিত দার্জিলিংয়ের দৃষ্টিনন্দন চা বাগান, আর এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো বাগানের আশেপাশে থাকা চায়ের দোকানগুলো, সেখানে বসে এক কাপ চা পান করার মজাই আলদা ।
দার্জিলিং রোপওয়ে/কেবল কার
এখানকার বিশেষ আকর্ষণ হল দার্জিলিং রোপওয়ে বা কেবল কার, অনেকেই এই কেবল কার দিয়ে পাহাড়ের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়ার জন্য উৎফুল্ল হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে একদিন থেকে অন্যদিকে যেতে সময় লাগে প্রায় ১৫ মিনিট।
হিমালয় মাউন্টেন ইন্সটিটিউট, মিউজিয়াম
উল্লেখ্য স্থানে একসাথে আছে মাউন্টেন ইন্সটিটিউট ও মিউজিয়াম। কোনো পর্বত আরোহী একটি পাহাড়ে ছড়ার জন্য কি কি কাজ করবে, কীভাবে ট্রেকিং করবে, কিভাবে উপরের দিকে চড়তে হয়, কোথায় কীভাবে পারাপার হবে, ইত্যাদি এখানে শেখানো হয়; তাছাড়া মিউজিয়ামের মধ্যে এভারেস্ট জয়ীদের বিভিন্ন স্মৃতি চিহ্নসহ আরো বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিষয় সংরক্ষিত আছে।
দার্জিলিং ম্যাল
দার্জিলিং শহরের সবচেয়ে উঁচু চূড়ার নাম হল ম্যাল চূড়া। এই উঁচু অঞ্চল থেকে আশেপাশের প্রকৃতি খুব ভালোভাবে উপভোগ করা যায়, তাছাড়া আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে তাহলে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াও দেখা যায়। এখানে বিভিন্ন জিনিসের দোকান রয়েছে, তাছাড়াও খাবারের দোকানে স্থানীয় খাবার থেকে শুরু করে অন্য বেশ কিছু খাবার পেয়ে যাবেন সুলভ মূল্যে। তাছাড়াও থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল আছে যা অনেক কম দামে ভাড়া করে নেওয়া যায়।
ধীরধাম মন্দির
কাঠমান্ডুর বিখ্যাত পশুপতিনাথ মন্দিরের অনুরূপ হল এই ধীরধাম মন্দির। অনেকেই এখানে গিয়ে পশুপতি নাথের পুজো করেন, এবং মন্দিরের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসে সময় কাটান।
উপসংহার, Conclusion
দার্জিলিং-এ পর্যটনে যাওয়ার জন্য শ্রেষ্ঠ সময় দুই ভাগে রয়েছে, এক হল সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এবং অপরটি হল এপ্রিল থেকে মে মাসের সময়কাল। যোগাযোগের ব্যবস্থা নিয়ে এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই, কারণ আকাশপথে আসার জন্য এখানকার নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট হল বাগডোগরা, সেখান থেকে গাড়ি করে খুব সহজেই শহরে পৌঁছে যাওয়া যায়। তাছাড়া নিউ জলপাইগুড়ি এবং শিলিগুড়ি জংশন হল এখানকার নিকটস্থ রেল-স্টেশন, দার্জিলিং ও শিলিগুড়ির যোগাযোগ নিয়মিত বাস চলাচলের মধ্যে দিয়ে অনেকটাই সহজ।